উপরের ছবিটি  যে বই আসছে তার প্রচ্ছদ। 

                                                                                                                      প্রাক কথন 

          প্রায় তিরিশ বছর সরকারী হাসপাতালে চাকরী করে, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে অবসর নিয়েছি। সরকারী চাকরীর বিচিত্র অভিজ্ঞতা , নিজে চোখের ডাক্তার হয়ে নানান রকম মানুষের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা এসব তো আছেই। তার সাথে, বিশেষ করে অবসর নেওয়ার পর দেশে বিদেশে ভ্রমণের নানান অভিজ্ঞতা। সবার উপরে আছে, এই ছেষট্টি বছর ধরে এই ধরাধামে পদচারণার বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বছর দশেকের বেশী হল, কাগজে কলমে না লিখে, মোবাইল ফোনের আর কিছু কম্পিউটারের কি বোর্ডে লেখার সুযোগ হয়ে , এই অধমের মত বেশ কিছু লোকের মনের ভাব লেখার অক্ষরে আনার খুব সুবিধা হয়েছে। শুধু লেখাই নয়, আমাদের মত বহু মানুষের পড়ার অভ্যাসও পাল্টে গেছে। এই আমার মত অলস আর ফাঁকিবাজ লোকও, গত বছর দশেকের মধ্যে অন্তত পঞ্চাশ হাজার পৃষ্ঠা পড়ে নিয়েছে। একটা পাঁচ-ছয়শ পৃষ্ঠার ছাপানো বই পড়তে হলে আমার অন্তত ছয় মাস সময় লেগে যায়। বাড়ীতে বসে, চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে বই পড়ার সময় কোথায়! অথচ মোবাইলের পর্দায় পিডিএফ বা ই-বুক পড়তে শুরু করে দেখলাম, মনের মত বই হলে, বনগাঁ লোকাল ট্রেনে দাঁড়িয়েও দুই -চার পৃষ্ঠা পড়ে নিয়েছি। শুধু হাসপাতালে যাতায়াতের পথেই কয়েক হাজার পৃষ্ঠা পড়ে নিয়েছি। 

     সাপের কামড় এর প্রশিক্ষণের কাজে হাজার হাজার মাইল ট্রেনে বা বিমানে যাত্রার সময় , মোবাইলেই কত হাজার পৃষ্ঠা পড়ে নিয়েছি তার হিসেব নেই। তবুও, মধ্যবিত্ত বাঙালির ক্রনিক আমাশা বা বদহজমের মত দুই একটা বই ছাপানোর রোগ আমারও হয়েছে। আমার নিজের মতোই, আপামর বাঙালির ছাপানো বই পড়ার অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও, ঐ পেট রোগা বাঙালির অভ্যাস মত, আর একটা বই ছাপানোর ইচ্ছা চাগার দিয়ে উঠল। অবসর নেওয়ার পর আবার আর একটি বাতিক রোগে ধরেছে। প্রায় মাসে মাসে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ছি। দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার প্রবল চাপে, শত শত পৃষ্ঠা লেখাও বেরিয়ে আসতে লাগল। 

  সব নতুন লেখকের অভিজ্ঞতা মতোই, এই অর্বাচীন লেখকও দুই-চারজন শুভাকাঙ্ক্ষীর উপরোধে গোটা কয়েক বই ছাপানোর প্রবল নেশা কাটাতে পারেনি। গত বছর দেড়েক প্রায় সবই ভ্রমণ কাহিনী লেখা হয়েছে। মাঝে মাঝে অন্য কিছু অভিজ্ঞতাও লেখা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া যুগে, এই সব লেখালেখির খবর পরিচিতজনের কাছে দ্রুতই পৌঁছে যাচ্ছে। এই নতুন একটি বাংলা বই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে জেনে অনেকেই ভেবেছেন, এটা বোধহয় একটা ভ্রমণ কাহিনী সংকলন হবে। না, ভ্রমণ কাহিনী রঙ্গিন ছবি ছাড়া একেবারেই নুন ছাড়া রান্নার মত। আর ঐ রঙ্গিন ছবি দিয়ে বই ছাপিয়ে যা দাম পড়বে, কেনার লোক পাওয়া যাবে না। ওদিকে আমার কয়েক হাজার শুভানুধ্যায়ী জানেন যে, এই লোকটি ঘোষিত “ সাপ পাগল”; তাই তাঁদের ধারণা এই লোকটা সাপ ছাড়া আর কিছু নিয়ে লিখবেই না। সেটাও ঠিক নয়। শহরের রাস্তা দিয়ে সকালে হেঁটে যাওয়ার সময়, “ হিজল ফুলের গন্ধ” এসে ; বিগত সিকি শতাব্দীর উপর কোলকাতা শহরে বাস করা, দিল্লী, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু বিমানে ঘুরে বেড়ানো “ সাপের ডাক্তার” দয়াল বন্ধুর,  প্রায় ষাট বছরের পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। সেই হিজল ফুলের গন্ধ, মোবাইলের হরফ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে কয়েক ডজন সহৃদয় পাঠক পাঠিকা শুভানুধ্যা়ীদের মধ্যে।  তেমনি ভাবেই, প্রায় চল্লিশ বছর ধরে চোখের ডাক্তার দয়াল বন্ধু, নিজস্ব চেম্বারে চোখের রুগী দেখার সময় কিছু নাটকীয় মুহুর্তের সাক্ষী হয়েছে। সে কথাও অক্ষর হয়ে বেরিয়ে এসেছে। 

     সেই সকল ধরনের রচনাই এই সংকলনের মধ্যে রয়েছে। হ্যাঁ, গোটা দুই-তিন ভ্রমণ কাহিনী তো আছেই। আর আঠারো বছরের “ সাপের কামড়” এর অভিজ্ঞতা, তাও জীবনের অভিজ্ঞতা হিসেবেই অক্ষর হয়ে ফুটে বেরিয়েছে। শুধুই “ ইহা করিয়ো, উহা করিয়ো না “ , এভাবে সাপের কামড় নিয়ে কোন লেখা এই সংকলনের মধ্যে নেই। আমার শুভানুধ্যায়ী, সহৃদয় পাঠক পাঠিকা এই সংকলনটি পড়ে, কিছু ভাবনার বিষয় খুঁজে পাবেন। কিছু রচনাকে রম্য রচনা হিসেবেও ধরে নিতে পারবেন। সর্বোপরি একজন গণ্ড গ্রামের মানুষ, কি করে একটু একটু করে শহুরে মানুষ হয়ে গেল, সেই বিবর্তনের ইতিহাসও সচেতন পাঠক পাঠিকা খুঁজে পাবেন। 

    মহালয়া, ১৪৩২ সাল (২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ) । কলকাতা - ৭০০০৩০.


 

ভ্রমণ ও সাপের কামড় ছাড়া অন্য লেখাগুলি 

 

 

 

                হাতখান ধইরে দ্যাখ ক্যানে

                            ডাঃ দয়াল বন্ধু মজুমদার 

      নদীয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে সুশান্ত । কোলকাতার মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করার পর আরও বছর তিনেক জুনিয়ার ডাক্তার হয়ে কাজ করেছে। তারপর একদিন সরকারী চাকরী নিয়ে চলল উত্তর বঙ্গে। নতুন জেলা সদর থেকে আরও চল্লিশ মাইল দূরের একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার। মনটা একটু খারাপ ছিল; সেই চাকরীর চিঠিটা হাতে আসার পর থেকেই। স্নেহশীল বড় দাদার মত মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রত্যেকের মনের অবস্থা বুঝে, একেকজনকে একেক ভাবে সাহস জুগিয়েছেন। সুশান্তকেও বলেছেন, “ তোমার সবথেকে ভাল পোষ্টিং হয়েছে। আমাদের ট্রেন ধরতে  মালদা যেতে হয়; তোমার ওখানে দার্জিলিং মেল সহ বেশ কয়েকটা ট্রেন থামে। এক ট্রেনে কোলকাতা যেতে পারবে। 

  বিকেলের দিকে নিজের সামান্য বাক্স বিছানা নিয়ে বাস থেকে নেমেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোয়ার্টার পেয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। অনেক জায়গায় শুনেছে, বাস থেকে নেমে আবার চার পাঁচ কি মি রাস্তা ভ্যানে বা হেঁটেও যেতে হয়। পাশের কোয়ার্টারেই থাকে প্রায় সমবয়সি ফার্মাসিষ্ট। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ফার্মাসিষ্ট ছেলেটির সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সেও খুব উৎসাহ দিল। প্রথম রাতেই ঠিক হয়ে গেল , দুজনের রান্না একই জায়গায় হবে, একজন মাসিই সব কাজ করবে। 

  এত বছর মেডিক্যাল কলেজে কাজ করার অভিজ্ঞতা এক রকম ; আর একেবারে একা একা একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করা আর এক রকম। ফার্মাসিষ্ট একা একাই চালিয়েছে বছর খানেক। ওর কাছেই কাজের হালচাল জেনেছে , রাতের মধ্যে যেটুকু জানা যায়। সকালে নটার মধ্যে তৈরী হয়ে আউটডোরে বসে গেল সুশান্ত। ছোটখাট একটা লাইন। আসলে লাইন না বলে জটলা বলাই ভালো। গ্রামের লোকেরা অত শত লাইন টাইন বোঝে না। নতুন ডাক্তার আসার খবরটা “কুম্পান্ডার বাবুই” ওদের দিলেন। ফার্মাসিষ্টই হৈ হৈ করে বললেন, সবাই লাইন করে দাঁড়াও,  নতুন ডাক্তাবাবু এসেছেন। একটা লাইন মত হলও। কিন্তু সবাই একটু উকি দিয়ে দেখতে চায়, নতুন ডাক্তারটি কেমন দেখতে। একেবারেই গ্রামের গরীবগুর্বো লোকজন। এক এক করে রুগী দেখতে শুরু করল সুশান্ত। সবারই কথায় উত্তরবঙ্গের রাজবংশী টান। প্রথম দিকে লাইনটা দরজার বাইরে থাকলেও একটু পরেই ঘরের ভিতর জনা পাঁচেক রুগী ঢুকে গেল। এক দুবার ফার্মাসিষ্ট এসে দরজার বাইরে লাইন করে দাঁড়াও বললেও, পাঁচ মিনিটেই আবার ঘরের ভিতরে চার পাঁচ জন হয়ে গেল।

   এখানে এটাই দস্তুর। তার উপর নতুন ডাক্তার। ভালো করে দেখে নিতে হবে তো। পাড়ায় গিয়ে বলতে হবে না; ডাক্তারটা “হ্যান্টা” কিনা। 

         গ্রামের লোকেরা কোলকাতার মেডিক্যাল কলেজের আউটডোরে আসেনা এমন নয়। তাই ওদের দেখতে বা ওদের কথা বুঝতে খুব একটা অসুবিধাও হচ্ছিল না। ঘণ্টা দেড়েক রুগী দেখার পর এল প্রথম চমকটা। একটা কম বয়সের বৌ এসেছে দেখাতে। টুলে বসার পর সুশান্ত জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে? অসুবিধা কি? রুগী চুপচাপ। লজ্জায় মুখ নিচু করে বসে থাকল।  সাথে এসেছে একটু বয়স্কা মহিলা। রুগীর মা কিংবা শাশুড়ী হবেন। বার তিনেক জিজ্ঞেস করে কোন উত্তর না পেয়ে, সুশান্ত সাথের মহিলাকেই বলতে বলল। এবার যেন বয়স্কা মহিলা একটু বিরক্ত হয়েই বলল, " হাতখান ধইরে দেখ কেনে"! চমকে উঠল সুশান্ত। মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় বা জুনিয়র ডাক্তার থাকার সময়ও কেউ কোনদিন ওকে তুই করে কথা বলে নি।  সে তো গেল একটা দিক। এমন এক গ্রাম্য মহিলা তুই করে বলায় খুব একটা অপমানও মনে হয়নি সুশান্তর। কিন্তু হাত ধরে, মানে নাড়ি ধরে কি বুঝতে বলছে ওকে? এতো মহা ফ্যাসাদ। আপাত সুস্থ , কম বয়সি বধুটির তেমন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলেও তো মনে হচ্ছে না। নিজের বিব্রত ভাবটা গোপন রাখার জন্যই সুশান্ত  রোগিণীর পালস্ দেখতে শুরু করল। কোন গন্ডগোল নেই। ভালো করে দেখার জন্য অনেকক্ষন ধরে দেখল পালস্। ডাক্তারের মুখ দেখে বয়স্ক মহিলা বুঝল যে ডাক্তার " ধরতে পারছে না"! এবার যতোটা সম্ভব আস্তে করে বলল, " প্যাটে বাচ্চা আছে কি?" এবার সুশান্ত বুঝে গেছে। বৌ এর পেটে বাচ্চা আছে কিনা সেটা মুখে বলতে চাইছে না। বৌ তো লজ্জা পেয়ে চুপ করে থাকবেই। এতগুলি বাইরের লোকের কাছে , শাশুড়ীমাও বা কি করে বলে? এবার ডাক্তারকে একটু "হ্যান্টা" হতে হল। ঘরের ভিতর ঢুকে আসা বাকী লোকগুলোকে বের করতে হল। নাড়ি টিপে পেটে বাচ্চা আছে কিনা বলার শিক্ষা সুশান্ত পায়নি। সুশান্ত কেন, ওর কোন শিক্ষক ও কোনদিন এমন কথা শোনেননি। সে যাই হোক, কটা মাসিক বন্ধ আছে ইত্যাদি জেনে , ডাক্তারের রায়টা জানাতে পেরেছিল সুশান্ত।

         এ গল্প আমি সুশান্তর কাছে শুনেছি অনেক পরে। কিন্তু শোনার সাথে সাথেই আমার এক শিক্ষকের বহু পুরনো শিক্ষা মনে পড়ল। তখন আমরা সবে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।  মেডিক্যাল ওয়ার্ড এ ক্লিনিক্যাল ক্লাশ শুরু করেছি। ঐ একজন স্যারই বলেছিলেন, পালস্ দেখে অনেক কিছুই বোঝা যায়। এ কথা অনেক স্যারই বলেছেন, শিখেওছি। কিন্তু ঐ একজনই বলেছিলেন, সব রুগীর পালসে আগে হাতটা রাখবে। কিছুই হয়তো পাবে না , কিন্তু পালস্ এ হাত রেখে রুগীর সাথে কথা বলার অনেক সুফল পাবে। রুগী তোমার ওপর আস্থা রাখবে, তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে দ্বিধা বোধ করবে না। 

  একেবারে একশ ভাগ চোখের ডাক্তার হয়ে যাওয়ার আগে , স্যার এর ঐ শিক্ষা বেদবাক্য -এর মত মেনেছি। চোখের ডাক্তার এর পালস্ দেখার দরকার হয়  না সব সময়। তবুও অভ্যাসটা থেকে গেছে। এখন আবার উল্টোও ভাবে কেউ কেউ। এখন তো মেশিনের যুগ। গায়ে চুলকানি নিয়ে এসেও কেউ কেউ জানতে চায় , স্ক্যান করার দরকার আছে কি না!  পালস্ দেখে " ব্রাডি অ্যারিথমিয়া" পেয়ে , রুগীকে হার্টের ডাক্তারবাবুর কাছে পাঠিয়েছি। সেই রুগীর ইসিজি করে আমার রোগ নির্ণয় কে মান্যতা দিয়েছেন , হার্টের ডাক্তার বাবু। এখন আর লোকে পালস্ দেখে " সময় নষ্ট করে না"! বৈদ্যি নাকি? 

  আমার সামনে কোন রুগীকে হাঁপাতে দেখলেই আমার হাতটা রুগীর পালস এ চলে যায়। কে যেন অলক্ষে বলে, " হাতখান ধইরে দ্যাখ কেনে"!

 

 

২৪ না ৩২?

পৃথিবীর প্রথম এটম বোম পরীক্ষার পরই , সেই বিস্ফোরণ এর প্রবল অভিঘাত লক্ষ করে মহাবিজ্ঞানী ওপেনহাইমার একটি কবিতার মত শ্লোক আবৃত্তি করেন। পাশে থাকা বিজ্ঞানী তাঁকে জানতে চান, ওটা কি গ্রীক কবিতার লাইন বললেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, না , সংস্কৃত! নারায়ণ সান্যাল মশাই তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস , বিশ্বাসঘাতক এ এখানে একটি “ নাকি” ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ সান্যাল মশাই এর মতে, “ ওপেনহেইমার সাহেব নাকি গীতার একটি শ্লোক উচ্চারণ করেছিলেন।” সান্যাল মশাই এর ডজন খানেক বই পড়ে এটুকু বুঝেছি, উনি ব্যাপক গবেষণা না করে কোন তথ্য কোথাও লেখেন না। যেমন, নেতাজী রহস্য সন্ধানে বইতে, নেতাজীর বিবাহ, স্ত্রী কন্যা নিয়ে একটি কথাও লেখেনি। তার “ কৈফিয়ৎ” এ লিখেছেন, এ নিয়ে কোথাও কোন প্রমান পাননি, তাই কিছুই লেখেননি। সে যাই হোক, বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার হয়তো সেই অভূতপূর্ব, মহা বিস্ময়কর বিস্ফোরণের প্রচণ্ড অভিঘাত বর্ণনার জন্য কিছু একটা আবৃত্তি করেছিলেন। আমার সীমাবদ্ধতার কথা আগেও অনেক বার লিখেছি; আমি এই সমস্ত সাহিত্যের বই বেশ দেরি করে পড়তে শুরু করেছিলাম, পঞ্চাশ বছর বয়সের পর। আমার প্রিয় ডাক্তার ভাই গোপীনাথ এই বই পড়েছে স্কুলে পড়ার সময়। অনেক বছর আগে গোপী এই প্রসঙ্গে বলেছিল, ওপেনহাইমার গীতার শ্লোক আবৃত্তি করেছিলেন। খবরটা একজন ভারতীয় হিসেবে অবশ্যই শ্লাঘার। সান্যাল মশাই এর বই পড়ার বেশ কয়েক বছর পরে, রামকৃষ্ণ মিশনের শ্রদ্ধেয় মহারাজদের ভাষণে এই প্রসঙ্গের উল্লেখ শুনেছি।

“কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো

লোকান্ সমাহর্তুমিহ প্রবৃত্তঃ ।

ঋতেহপি ত্বাং ন ভবিষ্যন্তি সর্বে

যেহবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ ॥৩২॥”

গীতার একাদশ অধ্যায় এর এই বত্রিশ নম্বর শ্লোকের আলোচনার সময় , একজন মহারাজ এই বিজ্ঞানীর শ্লোক আবৃত্তি করার কথাটা বলেছেন।

সান্যাল মশাই তাঁর বইতে কিন্তু অন্য শ্লোকের কথা লিখেছেন,

“নভঃস্পৃশং দীপ্তমনেকবর্ণং

ব্যাত্তাননং দীপ্তবিশালনেত্রম্ ।

দৃষ্ট্বা হি ত্বাং প্রব্যথিতান্তরাত্মা

ধৃতিং ন বিন্দামি শমং চ বিষ্ণো ॥২৪॥”

অর্থাৎ, গীতার একাদশ অধ্যায় এর চব্বিশ নং শ্লোক।

আমার বিভ্রান্তি দূর করতে Meta AI search করে দেখলাম, ৩২ নং শ্লোকের কথা লিখেছে। এবার সোজা বাংলায় এই দুটি শ্লোকের মানে কি দেখা যাক। ২৪ নং শ্লোকের মানে দাঁড়ায়, “  তোমার আকাশস্পর্শী, তেজময়, বিবিধ বর্ণযুক্ত, বিস্তৃত মুখমণ্ডল ও উজ্জ্বল আয়্ত চক্ষুবিশিষ্ট তোমাকে দেখে আমার হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে এবং আমি ধৈর্য ও শম অবলম্বন করতে পারছি না।”

আর ৩২নং শ্লোকের মানে দাঁড়ায়, “( শ্রীভগবান বললেন)- আমি লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ কাল এবং এই সমস্ত লোক সংহার করতে এক্ষণে প্রবৃত্ত হয়েছি৷ তোমরা (পাণ্ডবেরা) ছাড়া উভয় পক্ষীয় সমস্ত যোদ্ধারাই নিহ্ত হবে।”

তাহলে বিজ্ঞানী কোন শ্লোকটি আবৃত্তি করেছিলেন? নিউ মেক্সিকোর মরুভূমির মধ্যে যেখানে পরমাণু বোমাটি পরীক্ষার জন্যে রাখা হয়েছিল, তার থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে ছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানতেন কী ভীষণ ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। একটু মাটির গর্তে, কানে তুলো দিয়ে, বিশেষ ভাবে তৈরী গগলস চোখে দিয়ে, তাঁরা সকলে শুয়ে ছিলেন। কয়েক মিনিট আগে থেকে কাউণ্ট ডাউন শুরু হয়। মাত্র তিন সেকেন্ড বাকী থাকতে, বিজ্ঞানী ফাইনম্যান উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ান। পরে উনি সেই মহা বিস্ময়কর বিস্ফোরণের বর্ণনা দিয়েছেন। চোখ বন্ধ আর গগলস এর নীচে থাকলেও, “ সহস্র সূর্যের” আলোর মত উজ্জল সাদা আলো ওনার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মাথা আর চোখে যন্ত্রণা শুরু হয়। সাদা আলোর ঝলকানি একটু কমলে উনি চোখ খুলে দেখেন, একটা কমলা রঙের ধোঁয়া আকাশে উঠে যাচ্ছে। সেই কমলা রঙের ধোঁয়া একটা সিঁদুরে রঙের আগুনে ঘেরা। এই বর্ণনার সাথে ২৪ নং শ্লোকের বর্ণনার মিল পাওয়া যায়। ওদিকে ৩২নং শ্লোকের একটা অদ্ভুত ইংরেজী অনুবাদ আছে , “ I am become death, destroyer of worlds!” পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে যে ব্যাপক ধংসের কথা বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার জানতেন, সেটা প্রত্যক্ষ করেই উনি ঐ মহাকালের কথা বলেছিলেন।

এবার আসি আমার মূল খটকার কথায়। বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার কি  "সংস্কৃতে" শ্লোকটি আবৃত্তি করেছিলেন? উনি একটি বিজাতীয় ভাষায় আবৃত্তি করেছিলেন এটা বোঝা যায়,পাশের বিজ্ঞানীর প্রশ্ন থেকে। কিন্তু ভাষাটি কি ছিল? একজন মহারাজ বলেছেন, মূল সংস্কৃতে নয়, সম্ভবত জার্মান বা ঐরকম কোন ভাষায় অনুবাদ থেকে আবৃত্তি করেছিলেন। মহারাজের আর একটা কথা ঠিক বুঝলাম না। উনি বলছেন, হাজার সূর্যের আলোর মত উজ্জল, কিন্তু চোখ ঝলসে যায় না। ওদিকে শ্রেষ্ঠতম ভক্ত অর্জুন ভগবানের বিশ্বরূপ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ভগবানের ভয়ংকর বিশ্বরূপ সম্বরণ করার জন্য স্তুতি শুরু করেছিলেন।  দিনের বেলা একটি সূর্যের দিকেই সরাসরি তাকানো যায় না, হাজার সূর্যের জ্যোতি চোখ ধাঁধানো হবেনা কেন? ২৭.৯.২৪

 

নিবন্ধ তালিকা 

১) ২৪ না ৩২? (গীতার শ্লোক)

২) চেম্বারের নাটক?

৩)  অতি বৃহৎ-এর খবর 

৪)  নিতাইয়ের চা দোকান

৫)   পন্ডিত স্যার -এর ছেলে

৬) মুরগী চোর 

৭) কম বয়সের খেলা - ২৯

৮ ) কোট নিয়ে কুট কচালি 

৯) পান্ডা এবং ফান্ডা 

১০) আঙ্গুর

 

 

ডা দয়াল বন্ধু মজুমদারের কয়েকশ  বাং লা লেখা পড়তে গুগুল ড্রাইভে চলে যান । লিংক নিচে থাকল। 



হিজল ফুলের গন্ধ

সকালে ছাতা নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে আজ একটা জায়গায়, হিজল ফুলের গন্ধ পেলাম। এই পাড়ায় এসেছি এগারো বছর পেরিয়ে গেছে। মন্দির ডান হাতে রেখে বাম দিকে এগোলে, বাঁ হাতে যে পুরনো বাড়িটা পড়ে, তার হাতার মধ্যে অনেক গাছ পালা আছে। আম, কাঁঠাল, নারকেল, দুটি ডেউয়া গাছ। আরও কি কি নাম না জানা গাছ আছে, জানি না। বাড়িটার এলাকার মধ্যে বেশ বড় একটা পুকুর ও আছে। মন্দিরে পৌঁছনোর আগে, বাঁ দিকে, ভাঙ্গা পাঁচিলের ভেতরে দেখা যায় পুকুরটা। এদিক থেকে নামার কোন ঘাট নেই। বাড়ীর ভেতর থেকে নিশ্চয়ই আছে। পুকুর পাড়ে অনেক গাছ দেখা যায়। কিন্তু হিজল গাছ কোনোদিন দেখিনি। আজ এই এগারো বছর পর ফুলের গন্ধ পেলাম, তার মানে, হিজল গাছ একটা আছে ওখানে।

এই হিজল ফুলের গন্ধ আমার প্রায় পঞ্চান্ন ষাট বছরের পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। আপনারা প্রায় সকলেই জানেন, আমার জন্ম, শৈশব, কৈশোর থেকে ষোল বছর বয়স পর্যন্ত কেটেছে, মেদিনীপুরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। সেই গ্রামের সাথে আজকের গ্রামকে মেলাতে গেলে সবই গণ্ডগোল হয়ে যায়। গ্রামের সবথেকে বড় পরিবর্তন যেটা হয়েছে, সেটা হল গ্রামের সাথে শহরের যোগাযোগ। আমরা সেই সময় পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে, লোয়াদা নামের গঞ্জে আসতাম। সেখানে কংসাবতী নদী পেরিয়ে বাসে উঠে, শহরের দিকে যাওয়া। এছাড়া গ্রামের বাড়িগুলি সব প্রায় পাকা হয়ে গেছে। দুই একটা যে মাটির বাড়ী আছে, তার সবই প্রায় দিন মজুর শ্রেণীর প্রান্তিক মানুষদের। আর আমাদের মত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিছু কিছু লোকের এক আধটা যে বাড়ী এখনও থেকে গেছে, সেগুলি পুর্ব পুরুষেরা বানিয়েছিলেন। তাঁদের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবেই রেখে দেওয়া হয়েছে। 

সবথেকে বড় যে জিনিসটা গ্রামে গেলে এখন চোখে পড়ে, সেটা হল গাছের অভাব। পঞ্চাশ বছর আগে যে সংখ্যায় গাছ দেখেছি, এখন তার সিকি ভাগও নেই। সবুজ পাতার গাছের বদলে এখন বড় রাস্তার পাশে পাশে শুধুই ইউক্যালিপটাস গাছ। ঐ রাস্তার পাশের বাবলা গাছের সারি , একেবারেই উধাও। আর একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে জাম গাছ। ছোট ছোট খুদি জামের গাছের লাইন ছিল, আমাদের বাস্তু ভিটার উত্তরে আর দক্ষিণে। সেই জাম গাছের ডাল কোমরে আটকে রাক্ষস সেজেছিল, আমার বন্ধু হরেন। সে কথা কোথাও লিখেছি। জ্ঞান হয়ে থেকে দেখেছি একটা বড় হিজল গাছ, আমাদের বড় পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে। গ্রীষ্ম কালে ফুলের ঝুরি ঝুলত। হালকা গোলাপী রঙের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ফুল। কোনদিন কোন কাজে লাগেনি সেই ফুল। দুপুরে পুকুরে স্নান করতে নেমে দেখতাম, পুকুরের জলে ভাসছে, হিজল ফুলের পাপড়ি। 

আমাদের এই বড় পুকুরের উত্তরে একটা ছোট চাষের মাঠ। তারপর গুছাইতদের একটা ডোবা পুকুর ছিল; এখনও আছে নিশ্চয়ই। ঐ পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে ছিল একটা মাঝারী মাপের হিজল গাছ। গ্রীষ্মের খরায় যখন মাঠের ঘাস ও শুকিয়ে যেত, ঐ হিজল গাছ থেকে ফুলের ঝুরি ঝুলতে দেখতাম। আর দুটি হিজল গাছ ছিল , বড় বৌদির বাড়ীর দিকে যেতে ডান হাতে যে বড় পুকুর ছিল, তার দুই কোণে। দক্ষিণ পুর্ব কোনের গাছটা একটু ছোট ছিল। কিন্তু আমাদের তেঁতুল তলার গুল্লি খেলার জায়গা থেকে মাত্র পনের কুড়ি হাত দূরেই। গ্রীষ্মে যখন গাছটা ফুলে ফুলে ভরে থাকত; আমরা ঐ তেঁতুলতলার থেকেই হিজল ফুলের হালকা মিষ্টি গন্ধ পেতাম। গ্রামে আর যেখানে দু একটা হিজল গাছ দেখেছি, সবই পুকুরের পারে বা খালের পাড়ে। 

প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল আমি গ্রাম ছেড়ে বেড়িয়েছি। প্রথমে পড়াশোনার চাপ, তারপর একটু একটু করে পেশার চাপে জড়িয়ে ধরলো। সরকারী চাকরী নিয়ে উত্তর বঙ্গে চলে যাওয়ায় আগে কয়েক বছর মেদিনীপুর শহরে থেকেছি। সেই সময় প্রায়ই গ্রামের বাড়ি যাওয়া আসা ছিল। যতদূর মনে পড়ে, সেই সময়ও আমার শৈশবের স্মৃতি জড়ানো ঐ তিন চারটি হিজল গাছ দেখেছি। ক্রমশ গ্রামের সাথে যোগাযোগ কমে এসেছে। কবে যে এক এক করে সেই সব হিজল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, আমার জানা নেই। আসলে প্রয়োজনের কথা ভাবলে , হিজল গাছ খুবই অকিঞ্চিৎকর একটি উদ্ভিদ। ওর ফল, ফুল বা পাতা কোন কাজে লাগে এরকম আমার জানা নেই। হিজলের কাঠও সেরকম কোন মজবুত কাঠ নয়। তবুও গ্রামে একসময় অনেক হিজল গাছ তো ছিল। ওদের কেউ কখনও লাগিয়ে, যত্ন করেছে, সেরকম শুনিনি। একেবারেই নগন্য একটি বুনো গাছ। সেই হিজল গাছ, বাংলার মাটির কবি জীবনানন্দের কবিতায় স্থান পেয়েছে। সে কথা অবশ্য জেনেছি, গ্রাম ছেড়ে চলে আসার অনেক বছর পর। তার বহু বছর আগেই, এই নগন্য একটি গাছের , নগন্য ফুলের বিশেষ একটি সুগন্ধ আমার স্মৃতির কোন অতলে স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে বসে গেছে। মাঝে বোধহয় তিরিশ চল্লিশ বছর তার কোনো খবর নেওয়া হয়নি। 

তবুও সে বসে ছিল আমার মনের গভীরে। শহরের কংক্রিটের জঙ্গলের আড়ালে ওদের কেউ আজও দাঁড়িয়ে আছে। নিঃস্বার্থ ভাবে বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছে তাঁর অকৃপণ সৌরভ। হে অদৃশ্য বৃক্ষ দেবতা, তোমাকে প্রণাম। ১৪. ৭. ২৫.

আজ রাত আটটা থেকে, আকাশবাণী কলকাতায় আমার একটি সাক্ষাতকার প্রচার করা হবে। আমিও তো ঐ হিজল গাছের মত, ডোবা পুকুরের পাড়ে অযত্নে বড় হয়ে ওঠা একটি গ্রাম্য মানুষ। শহুরে জীবনে বিন্দুমাত্র কোন প্রয়োজন নেই এরকম একটা বিষয় নিয়ে পড়ে আছি প্রায় আঠারো বছর। জানিনা,  আকাশে ভেসে আসা আমাদের আজকের আলোচনা, এই হিজল ফুলের গন্ধের মত কারো পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনবে কি না। 



ডি কে রায় স্যার

         একটা চোখের ডাক্তার সাপের কামড় পড়ায়! এ জিনিস হজম করাই অনেকের কাছে কঠিন। তারপর যদি বলাযায় লোকটা একটানা তিন ঘন্টাও বসিয়ে রাখে, পাগল ছাড়া অন্য কেউ ওসব জায়গায় যাবে না। তিনঘন্টায় তো চেম্বারে পনেরটা রুগী দেখা যাবে। ১৩ই জানুয়ারী বাঁকুড়ায় দারুন ঠান্ডা পড়েছিল। সি এম ও এইচ আপিসের মিটিং হলে একেবার হাতমোজা পর্যন্ত পরে বসতে হল। তবুও মাঝে দুপুরে খাওয়ার সময় নিয়ে ঘন্টা পাঁচেক আটকে রাখাগেল বেশ কিছু ডাক্তারবাবুকে। পরে আমার থেকে বছর দুয়েকের বড়, আমার কলেজের দাদা যখন জানাল, আমার পড়ানো ওরা উপভোগ করেছে ; একটু আত্মবিশ্বাস তো অন্তত বাড়ল।গত আট নয় বছর একটা মেডিক্যাল কলেজে কাজ করতেগিয়ে দেখছি, আমাদের কলেজ জীবনের সাথে বিস্তর ফারাক। আমাদের সময় যে শিক্ষক সবথেকে নামি ডাক্তার, তিনিই পড়াতে ভালোবাসতেন সবথেকে বেশী। আর ছাত্রদের আগ্রহ? বারবার একই কথা বললে লোকে ভাববে, জীবনে একজন তো শিক্ষক পেয়েছে, তাই তার কথাই বারবার শোনাচ্ছে। ১৯৭৯ -৮০ সালে, বাঁকুড়ার হাড়কাঁপানো শীতে, আমরা সকাল সাতটা থেকে ফিজিওলজি ক্লাশ করেছি। পঞ্চাশ জনের মধ্যে উনপঞ্চাশ জনই হাজির। এখন শুনি দেড়শোর মধ্যে পঞ্চাশজন এলেই শিক্ষক দারুন খুশি।আমাদের সময়ে কি বিরক্তিকর শিক্ষক ছিলেন না? আমাদের ব্যাচের সেই," থাক স্যার"! এক ঘন্টার ক্লাশ, পয়তাল্লিশ মিনিট হতেই পেছন থেকে," থাক স্যার"! আর হবে নাই বা কেন; যদি কোন শিক্ষককে, প্রসট্রেশন মানে কি স্যার, জিজ্ঞেস করলে বলেন, " এটাও জানো না, প্রসট্রেশন মানে হাইপার সিক্রিশন অফ প্রস্টেট!" ঐ শিক্ষকের ক্লাশে বসে সময় নষ্ট করবে কোন্‌ আহাম্মক? একজন শিক্ষক যে একটানা তিন ঘন্টাও পড়াতে পারেন, সে কথা জানলাম একেবারে ফাইনাল ইয়ারে। শুনেছি বিখ্যাত শিক্ষক, কালীকিঙ্কর ভট্টাচার্য্যও দুই আড়াই ঘন্টা একটানা পড়াতেন। আমি ওনাকে ক্লাশে পাইনি, তবে প্রিন্‌সিপ্যাল হিসেবে পেয়েছি। ওনার দীর্ঘ শিক্ষক জীবনে ওনার বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতাগুলি এখনও কিংবদন্তি। একটা অন্তত না বললে আপনার সাথে অবিচার হবে। আমার প্রিয় শিক্ষক,কল্যানদার কাছেই শোনা। এই কল্যানদাও যেমন তুখোড় বুদ্ধিমান ছাত্র ছিলেন, তেমনি ছিলেন বিচ্ছু। মেডিক্যাল কলেজের বিখ্যাত ক্যান্টিনে একদিন কে কে বি স্যার বসে কিছু খাচ্ছিলেন। ওনার স্ত্রীর নাম যে সুলেখা, তাতো ছাত্রদের জানার কথা নয়। এ সব কথা হচ্ছে সেই ১৯৭০ এর দশকের কথা। তখন তো বলপেন আসেনি। কল্যানদা একটা ঝর্ণা পেনের খাপ খুলে, " একটু কালী দিবি,একটু কালী দিবি" এই বলতে বলতে স্যারের আসপাশের বেঞ্চে বসা ছাত্রদের কাছে ঘুরতে থাকলেন। ব্যাপারটা বুঝতে স্যারের বেশী সময় লাগল না। উনি ডেকে বললেন," কল্যাণ, তোমার কি যে সে কালীতেই হবে? না কি সুলেখা কালীই চাই?"আমার মেজদা কলেজ জীবন শেষ করে বহু বছর টিউশন করে কলকাতায় জীবিকা নির্বহন করেছে। আমি বাঁকুড়ায় পড়তে যাওয়ার পর শুনতাম, কলকাতার একজন বিখ্যাত সার্জেনের ছেলেকে পড়ায়। আমি বাঁকুড়ায় থেকে কোলকাতার কোন মেডিক্যাল শিক্ষককেই চিনতাম না। আমাদের ফাইনাল ইয়ারে দাদা বোধহয় একটা পোষ্টকার্ডে খবর দিল, ডাঃ ডি কে রায় বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছেন। একদিন শুনলাম নতুন স্যার সার্জারী টিচার্শরুমে বসে আছেন। গেলাম দেখা করতে। মেজদার নাম করে আমার পরিচয় দিলাম।আমার কোন ইয়ার ইত্যাদি দু একটা কথার পর জানতে চাইলেন আমাদের সার্জারীর কি কি পড়া হয়েছে। শুনে বললেন, সবই তো বাকী। মাত্র মাস চারেক পর পরীক্ষা,পাশ করবি কি করে? তোদের সি আর কে কালই দেখা করতে বলবি। আমি সি আর, অর্থাৎ স্কুলের মনিটারের মত, জেনে একটু উচ্ছসিত হলেন। কখন কি ক্লাশ আছে জেনে বললেন, দুপুর দুটো থেকে পড়াবেন । আমরা সবাই একেবারে হৈ হৈ করে দৌড়ে সেমিনার রুম ভরে বসতে শুরু করলাম।প্রথমদিন ক্লাশ করেই আমরা অভিভুত। মেডিক্যাল কলেজে এসে থেকে দেখেছি, ক্লাশ বড়জোর এক ঘন্টার হয়। এই ক্লাশগুলি ঘন্টা তিনেক চলতে থাকল। সন্ধ্যের সময় যখন বেরোতাম, সবার মুখ চোখ খুশীতে উজ্জল। এক একদিন বড় বড় একটা চ্যাপটার পড়িয়ে শেষ করতেন। আমার প্রিয় বন্ধু বিদ্যুৎকে স্যার বলতেন, "বড় পন্ডিত"। যা কিছু পড়া ধরা হত, সব শেষে দেখাযেত বড় পন্ডিত ঠিক উত্তরটা দিচ্ছে। আজ প্রায় চৌত্রিশ বছর পর বুঝতে পারছি, শুধু ভালো পড়ানোই নয়,স্যার ঠিকই বুঝেছিলেন আমাদের কার কতোটা দৌড়।আমাকে নিয়ে একদিন স্যার হৈ চৈ বাধিয়ে দিয়েছিলেন। এই একটি ব্যাপারে দেখেছি সব বাঙালীর প্রবল উৎসাহ। স্যার একটু কঠিন বিষয় পড়াচ্ছিলেন। হাতের অপারেশন ইত্যাদি। হাতে যে রেখাগুলি দেখে জ্যোতিষীরা বিচার করে তাকে ইংরেজীতে বলে, পামার ক্রিজ। স্যার, পামার ক্রিজেস বলেই হাত তুলে দেখালেন। তারপরই স্যারের একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিতে বললেন, আরে, হস্তরেখা বিচার!তোদের মধ্যে কেউ হস্তরেখা বিশারদ আছে নাকি রে? ব্যাস, শুরুহল হৈ হৈ। স্যার, আপনার সামনেই, আপনার সামনেই! আমি প্রথম বেঞ্চেই মাথা নিচুকরে বসে রইলাম। কে রে, কে রে করতে করতে স্যার যেই বুঝলেন, আমার কথা বলছে সকলে; ধরলেন আমাকে। হাত বাড়ীয়ে বললেন, দ্যাখ আমার হাত! মিনিট পাঁচেক হৈ চৈ এর পরই আবার শুরু হল পড়ানো। আমি কলেজে যাওয়ার আগে একটা চটি বই পড়েছিলাম, কিরোর "হস্তরেখা অভিধান"। কলেজে গিয়ে, বিশেষ করে রাগিং থেকে বাঁচতে খুব হাত দেখতাম। ঐ যে বললাম, ঐ একটি ব্যাপারে বাঙালীর প্রবল উৎসাহ। ঐ দিন তো ক্লাশ শেষ হয়ে গেল। সব ক্লাশেই এমন দু একবার ঢিলা দিতেন স্যার। আসলে এও ছিল ওনার লম্বা লম্বা ক্লাশ নেওয়ার একটা নিজস্ব কায়দা।কিন্তু কদিন পর স্যার আমাকে একা পেয়ে আবার ধরলেন। কলেজের আপিস বাড়ীর সামনে বট গাছের তলায় একটা গাড়ীতে বসেছিলেন। আমাকে বেরতে দেখে ডাকলেন। আমার সাথে আগে থেকে একটা সম্পর্ক ছিল বলেই হয়তো খুব আপন কিছু হতাশার কথা আমাকে বলে ফেললেন। তারপর খুব আন্তরীক ভাবেই বললেন ওনার হাত দেখতে।বললেন, হাত দেখে বলতো, কবে এখান থেকে ছাড়া পাবো? একথা আমরা সবাই জানি, এসব কিছু হাত দেখে অন্তত বলাযায় না। স্যারের ব্যাকুলতার জন্যই বোধহয় কিছু একটা বলেদিয়েছিলাম। অনেক পরে স্যার বলেছিলেন, তুই কিন্তু ঠিকই বলেছিলি।

স্যারের ক্লাশের আর একটা এমনই,হাল্কা কথায় মাথা ছাড়িয়ে নেওয়ার উদাহরণ দিলে বুঝবেন কেন আশি-পঁচাশি বছর বয়সেও স্যার কলকাতার সবথেকে ব্যস্ত সার্জারীর শিক্ষক। গলব্লাডার পড়াচ্ছিলেন স্যার। গলষ্টোন বলতে বলতেই বললেন, পকেটে সবসময় একটা গলষ্টোন রাখবি। যখন ব্যাস্ত ডাক্তার হয়ে যাবি, বৌ তাজমহল দেখাতে নিয়েযেতে বললেই পকেট থেকে পাথরটা বের করে দেখাবি। কি ব্যাপার জানতে চাইলে, বেলি- লাভ খুলে দেখিয়ে দিবি, " গলষ্টোন ইজ আ টুম্বষ্টোন ইরেকটেড ইন দি মেমরী অফ আ ডেড ব্যাকটিরিয়া!" এই পাথরটাই একটা মৃত জীবানুর স্মৃতিসৌধ। আমার ক্লাশের শেষে যখন আমার থেকে বয়সে বড় ডাক্তারবাবুও এগিয়ে এসে হাত মেলান, গুরুবল কি জিনিস বুঝতে পারি। এই ২০১৭ সালে এসেও এরকম বৈদিক যুগের কথা বলছি, অনেকের অবাক লাগলেও, আমি কিন্তু সব সময় ওনাদের আশির্বাদ অন্তরে অনুভব করি।২৬.৫.২০১৭.



 

 

চেম্বারের নাটক?

অনেকদিন আমার চেম্বারে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা লেখা হয়নি। যতদূর মনে পড়ে, বছর দুই আগে শেষ লিখেছিলাম। সেই যে বাচ্চা কোলে এসে,  এক কম বয়সের গৃহ বধু, করুন ভাবে অনুরোধ করেছিল; তার স্বামীকে মদ খেতে বারণ করতে। এবারও এক মহিলা , বয়স বলল, আঠাশ বছর। বিবাহিতা কি না বোঝা গেল না। সম্ভবত না। যার সাথে এসেছিল, তিনি সম্ভবত এই মহিলার ভাবি। অবশ্য “ ভাবি” বলে একবারও ডাকতে শুনিনি। অনেকসময় পাড়া প্রতিবেশী কারও সাথেও আসেন, এরকম বয়সের মহিলারা। তবে কিনা, বহু বছর ধরে এরকম দেখতে দেখতে, একটা নিজস্ব দেখার চোখ তৈরী হয়েছে। অবশ্য মাঝে মাঝে ভুলও হয়েছে। যার চোখ দেখলাম তার সাথের কিছুটা কম বয়সের মহিলাকে হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করলাম, রোগের গুরুত্ব। আপনার মায়ের চোখের কিছু পরীক্ষা করতে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে হবে; এই বলার পর হয়তো বললেন, আমার মা না, পাশের বাড়ির লোক। কিংবা আরও মধুর ভাবে বললেন, “ আমার মা না, এটা আমার বৌদি।” সে যাই হোক, দুজন মহিলা এসেছিলেন। আমার বহু বছর এর অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আসল যে সমস্যার জন্য আমার কাছে এসেছেন, ঠিক সেই সমস্যার কথা খুবই কম লোকে , প্রথমে বলে। নানান আনুষঙ্গিক কথা বলে সময় নষ্ট করছেন দেখে, প্রায়ই বলতে হয়, “ ঠিক কোন অসুবিধার জন্য এখন এসেছেন, সেটা আগে বলুন।” এই মহিলা কিন্তু ঠিক যেজন্য এসেছেন, সেটাই বললেন। ওনার দুই চোখ লাল হয়েছিল দিন পাঁচেক আগে, ওষুধের দোকান থেকে একটা চোখের ড্রপ দিয়েছিল, সেটা লাগিয়ে লাল কমে গেছে। তবুও, সম্ভবত ওষুধের দোকানদার বলেছিল, একবার চোখের ডাক্তার দেখিয়ে নিতে, তাই এসেছেন। অনেকের ধারণা, “ হাঁড়ী কাঠের মত” যন্ত্রে মাথা রেখে বসলেই ডাক্তারের পক্ষে চোখ দেখা সম্ভব। আসলে কিন্তু আমাদের মত চুল পাকিয়ে ফেলা ডাক্তারের চেম্বারের দরজার কাছে দাঁড়ানো অবস্থায়ই রুগী দেখা শুরু হয়ে যায়। একজন রুগী দু হাত সামনে বাড়িয়ে, বাতাস হাতড়ে ঢুকছে , এর মানে সে সম্পুর্ণ অন্ধ। তাঁকে তো আর সামনের আলোজ্বলা বাক্সে কি লেখা আছে, পড়তে বলার কোন মানে হয় না। আবার হয়তো মায়ের কোলে, তোয়ালে জড়িয়ে আনা, ক্ষুদ্র একটি মানব শিশু এসেছেন, আমার ঐ গলির ভেতর প্রায় চোখে না পড়া ( ঐন্দ্রিল ভাই বলেন, খুপড়ি) চেম্বারকে পবিত্র করতে। ওকে তো আর ঐ হাঁড়িকাঠের সামনে বসতে বলি না। নতুন মা ওকে নিয়ে চেয়ারে বসতে বসতেই, ব্যাগ থেকে টর্চ লাইট বের করি। এরকম কতো ভাবেই আমাদের রুগী দেখা শুরু হয়ে যায়, কোন যন্ত্র পাতি ছাড়াই। আমাদের মত পুরনো দিনের ডাক্তারের কাছে কিন্ত , নিজের চোখ আর কানের দাম অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রের থেকে বেশী। এই মহিলা আমার সামনের মেশিনের উল্টো দিকে বসার সাথে সাথেই আমার চোখে পড়ল, ওনার দুটি চোখ সমান ভাবে খোলা নেই। বাম দিকের চোখ ডান দিকের থেকে বেশী খোলা মনে হচ্ছে। কিংবা, ডান দিকের চোখ বাম চোখের থেকে একটু কম খোলা লাগছে। উনি লাল চোখের কথা বললেন, কিন্তু মেশিন ছাড়াই দেখতে পাচ্ছি, চোখ তেমন কিছু লাল নেই। মেশিনে মাথা রাখার আগে , দূরের আলোকিত বাক্সের গায়ে লেখাগুলি পড়তে বললাম। দুচোখ খুলে সবই পড়ে দিলেন। এবার এক এক চোখ আড়াল করে পড়তে বললাম। ডান চোখ আড়াল করে বাম চোখে সবই পড়তে পারলেন। কিন্তু বাম চোখ আড়াল করে পড়তে বলতেই বোঝা গেল, ইনি ডান চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। কি হল? তিনটে লাইন খোলা আছে, উপরে লাইনও দেখতে পাচ্ছেন না? ঘাড় বাঁকিয়ে, একটু ট্যেরা করে, নানান ভাবে চেষ্টা করে দেখার চেষ্টা করে গেলেন। এবার আমি উঠে দাঁড়ালাম; একটা দড়ি টেনে, ঐ বাক্সের ক্রমশ বড় লেখা বার করে পড়ানোর চেষ্টা করে দেখলাম, একেবারে উপরের, সবথেকে বড় অক্ষরটিও পড়তে পারলেন না, ডান চোখে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বাক্সের লেখা ক্রমশ বড় করার সময় , সাথের ভদ্র মহিলাও উঠে দাঁড়িয়ে ওকে নানান ভাবে উৎসাহিত করে গেলেন। না, ডান চোখে প্রায় কিছুই দেখলেন না। ব্যাপারটা প্রায় ৯০% বুঝে গেলেও, কিছু কিছু কথা জেনে নিতে হয়। তাই , এরকম কম দেখেন, আগে জানতেন কি না? আগে কোনদিন চোখের ডাক্তার দেখানো হয়েছে কি? ডান চোখে কোনদিন কোন আঘাত পেয়েছেন কি না, এসব খবর জেনে নিতে হয় l এরপর সেই হাঁড়িকাঠে মাথা দিয়ে শুরু করে পরপর যেমন যেমন চোখ দেখা হয়, দেখলাম। কিন্তু মন বলছে, এ সেই বাঁকুড়ার স্যারের বোনের মতই হবে। চশমার পাওয়ার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলাম, ডান চোখটি “ লেজি আই” অর্থাৎ Ambliopic . সেই স্যারের বোনের,  লেজি আই ধরা পড়েছিল, কুড়ি বছর বয়সে। আর এনার বয়স আঠাশ। এত বয়সে লেজি আই প্রথম ধরা পড়েছে, এর আগে আমি শুনিনি। সাধারণত স্কুলে পড়ার সময়, ছয় সাত বছর বয়সে ধরা পড়ে যায়। কখনও কখনও বারো তের বছর বয়সে পেয়েছি। 

এই “ লেজি আই “ রোগটি কি? কেন হয়। আমি যত জনকে পেয়েছি, সবারই একটি চোখে অস্বাভাবিক বেশি প্লাস পাওয়ার ছিল। প্রায় জন্মগত ভাবে একটি চোখের পাওয়ার বেশী থাকে এদের। ছোট বেলা থেকেই ঐ চোখের দৃষ্টি অন্য চোখের থেকে কম থাকে। এই কম দেখতে দেখতে, ঐ চোখটি ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। ভালো চোখটি দিয়েই সব কাজ করার অভ্যেস তৈরী হতে থাকে। সাত আট বছর বয়সের আগে ধরা পরলে , এই কমজোরী চোখের পাওয়ার ঠিক করে চশমা দেওয়া হয়। অনেক সময় অপেক্ষাকৃত ভালো চোখটিকে কিছুদিন পটি দিয়ে বন্ধ করে, কমজোরী চোখের উপর নির্ভরতা বাড়িয়ে, ঐ চোখটি যাতে লেজি হয়ে না পড়ে তার চেষ্টা করা হয়। অর্ধেক ক্ষেত্রে ভালোই উন্নতি হয়ে যায়। কিন্তু দেখা গেছে, নয় বৎসর বয়সের পর চিকিৎসা শুরু করলে, বিশেষ লাভ হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই ঐ চোখটি ট্যারা হয়ে যায়। অপারেশন করে, ট্যারা চোখ সোজা করে দিলেও, দুই চোখের দৃষ্টি সমান আর হয় না। এজন্যই, যতো কম বয়সে রোগটি ধরা পড়ে, চিকিৎসায় উপকার হওয়ার সম্ভাবনা ততোই বেশী।

  কি করে বোঝা যায় যে বাচ্চার একটি বা দুটি চোখই কম দেখছে? বাচ্চার স্বাভাবিক কাজ কর্ম, খেলাধুলার দিকে একটু মন দিয়ে দেখলেই, কিছু কিছু গণ্ডগোল চোখে পড়ে যায়। বাচ্চা টিভি দেখার জন্য সামনে এগিয়ে গিয়ে বসে। এটা হয় ওর দূরের দৃষ্টি কম হলে। পড়াশুনা শুরুর পর আরও সহজে ধরা পড়ে যায়। বই খুব কাছে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে কি না লক্ষ করতে হবে। স্কুলের বোর্ড পিছনের বেঞ্চে বসে দেখতে পাচ্ছে কি না, সেটা স্কুলের শিক্ষক ভালো বুঝতে পারেন।

দেখাযায়, মা শিক্ষিতা হলে, বাচ্চার চোখের সামান্য অসুবিধাও তাঁরা নিজেরাই ধরে ফেলেন। আমার প্রতিবেশী এক ডাক্তার দম্পতির বছর আড়াই এর বাচ্চাটি, একদিন দেখি চোখে বেশ মোটা চশমা পরে, বাবার হাত ধরে টলটল করে হাঁটছে। ওর বাবাকে জিজ্ঞেশ করেই জানলাম যে, বাচ্চার মায়ের কিছু সন্দেহ হওয়ায় ওরা বাচ্চাটিকে নিয়ে চোখের ডাক্তার এর কাছে গেছলেন। এটা ওর মা নিজে ডাক্তার বলেই সম্ভব হয়েছে। নয়তো এত ছোট বাচ্চার চোখে চশমা লাগার মত সমস্যা, সাধারনত মায়েদের চোখে পড়ে না। আমি যখনই কোন লেজি আই রুগীর চোখ দেখি, এই প্রায় চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর পরেও, আমাদের স্যার এর বোনের কথাটা মনে পড়ে যায়। 

আমাদের কলেজেরই দাদা, আমাদের শিক্ষক হয়েছিলেন। আমাদের খুবই প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। নামটা খুবই প্রচলিত। এই যেমন, স্বপন, তরুণ বা অশোক এর মত। কলেজের দাদাদের কথা উঠলেই, কোন তরুণ দাদা, বা কোন অশোক দাদা এরকম প্রশ্ন হবেই। আমাদের এই দাদাকে আমরা একটি লুকানো নাম দিয়ে বোঝাই। “ আ টু পা টু “ দাদা , বললেই সবাই বুঝে যাই, কার কথা বলা হচ্ছে। এই আটুপাটু কথাটার বেশ গভীর তাৎপর্য আছে। বিশেষ করে বাঁকুড়ায়, কোন রুগী যদি বলেন, “ আটুপাটু লাইগছে” , তার মানে অনেক কিছু হতে পারে। রুগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, কিংবা বুক ধড়ফড় করছে, অথবা রুগী খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন; এমন আরও বেশ কিছু রোগ লক্ষণ ঐ আটুপাটু শব্দটি দিয়েই প্রকাশ করা হয়। এই জিনিসটি আমরা প্রথম শিখেছিলাম, ঐ স্যার এর কাছে। উনি ক্লাশে যেভাবে বলেছিলেন, সেই ইংরেজী মহা বাক্যটির প্রথম অংশ আমাদের ব্যাচের কাছে, কিংবদন্তি হয়ে আছে। আজও ওনার প্রসঙ্গ উঠলেই আমরা বলেফেলি, “ আটুপাটু মিনস ডিসপ্নিয়া!” সেই মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক দাদা একদিন তাঁর কলেজে পড়া বোনকে নিয়ে, হাসপতালের চোখের আউটডোর এ এসেছিলেন। একেবারেই আকস্মিক ভাবে ধরা পড়েছিল, ঐ কলেজ ছাত্রীর একটি চোখ লেজি আই। সম্ভবত আলোকিত বাক্সের উপরের একটি কি দুটি লাইন মাত্র পড়তে পারছিলেন। ঐ রকম শিক্ষিত পরিবারেও, এত বড় একটা গণ্ডগোল , কুড়ি বছর বয়সে হঠাৎই ধরা পড়েছিল। মাঝে মাঝে কোন স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে যেতাম। সেখানে , বাচ্চাদের চোখে কোন সমস্যা আছে কি না,  তার প্রাথমিক পরীক্ষা স্কুলের শিক্ষকদের করতে শেখাতে হত। সব জায়গায়ই আমার ঐ শিক্ষকের বোনের কথাটা উল্লেখ করতাম। আজও লেজি আই নিয়ে লিখতে গিয়ে, সেই স্যার আর তাঁর বোনের কথাটা লিখে ফেললাম। কলেজ ছাড়ার পনের কুড়ি বছর পরেও দুই একবার আমার প্রিয় সেই “ আটুপাটু” স্যার এর সাথে দেখা হয়েছে; পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছি। কুশল বিনিময়ের পরই কিন্তু আমার মনে পড়েছে, স্যার এর বোনের চোখ পরীক্ষার কথা। না, স্বাভাবিক ভদ্রতায় কোনোদিনই আর জিজ্ঞেশ করা হয়নি, স্যার আপনার সেই বোন কেমন আছেন? সরকারী ভাবে বরিষ্ঠ নাগরিক হওয়ার পর, আবার যদি দেখা হয় স্যারের সাথে! এখনও কি জিজ্ঞেশ করতে পারবো? ৬.১১.২০২৪.



           অতি বৃহৎ-এর খবর 

      পুজার মুখে একটা অতি বৃহৎ এর খবর আমাদের অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে। আসলে ব্যাপারটা এতই  দূরের যে, ও নিয়ে ভাবার কোন দরকারই পড়েনি আমাদের। 

  আমাদের বাড়ীর সামনে একটা বড় শব্দবাজি ফাটলেই আমরা চমকে উঠি। আজও এই পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও যুদ্ধ চলছে। একদিনে হয়তো শ’খানেক বোমা পড়ছে। ঐ মাপের একটা বোম পড়লেই, আমাদের বসুন্ধরা আবাসনের বাড়ীটা ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে। কিন্তু হাজার দশেক মাইল দূরে বসে আমরা কিছুই টের পাইনা। মাত্র চার লক্ষ মাইল দূরের চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কয়েকটি ছবি এসেছে শুনেই আমাদের কী শিহরণ! 

   যে খবর নিয়ে বলতে শুরু করেছি, সেটা কিন্তু সাড়ে তিনশো আলোক বর্ষ দূরের। আসলে দূরত্বটা এতই বেশি যে , দশ লক্ষ ভাগের একভাগ মাত্র বলেছি। সংখ্যাটা হল সাড়ে তিনশো মিলিয়ন আলোকবর্ষ । এই দূরত্বটা কিলোমিটার বা মাইলে লিখতে হলে, 35 এর পর এতগুলো শূন্য লিখতে হবে যে , সারা রাত ধরে শুধুই শুন্য বসিয়ে যেতে হবে। 

   আলোর গতিবেগ সম্বন্ধে একটু ধারনা না থাকলে , এই অতি দূরের ব্যাপারটা বোঝানো যাবে না ।  আলো সেকেন্ডে প্রায় এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল যেতে পারে । আমাদের নিজেদের তারা , সুর্যের থেকে , আমাদের কাছে আলো আসতে নয় মিনিট মত লাগে । এই সেকেন্ডে  এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল গতিতে আলো এক বছরে যতোদূর যেতে পারে , সেই দূরত্বটা হল এক আলোকবর্ষ। এটা কয়েক লক্ষ কোটি মাইল । এই হিসেবে , ঐ সাড়ে তিনশো মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরে একটা ঘটনা ঘটেছে।  

        বুঝতেই পারছেন , অত দূরের একটা খবর আমরা কতজন রাখি! এই বিজয়া দশমীর রাতে , আমাদের আবাসনের সবথেকে প্রাচীন বাসিন্দা , কালীটা চলে গেল। কালী আসলে এই আবাসন তৈরীর বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই এখানে থাকে। আমরাই বছর পাঁচ-ছয় আগে এসে ওর জায়গা দখল করেছি। একেবারে নগন্য দেশী কুকুর হলেও , আমরা অনেকেই ওকে নিজের লোক বলেই ভাবতাম। সেই কালীর চলে যাওয়ার খবরই আমি পেয়েছি দেড় দিন পরে।

   তবে , ঐ অতি দূরের ঘটনাটা , নাসার বিজ্ঞানীরা একেবারে “ লাইভ” দেখেছেন। মহাকাশ বিষয়ে আমার দৌড় , ল্যাটিন ভাষা জানার মত। ল্যাটিন একটি প্রাচীন ভাষা , আমাদের সংস্কৃত ভাষা যেমন বাংলা, হিন্দি ইত্যাদি কিছু ভাষার মূল ; ঐ ল্যাটিন তেমনি ইংরেজীর মত কিছু ভাষার মূল । ব্যাস, আমার দৌড় শেষ।

         এই যে এত কোটি কোটি মাইল দূরের ঘটনার ছবি, এ কিন্তু আমরা যেমন ক্যামেরা বা ছবি দেখি, সেসবের মত নয়। ডক্টর মানস প্রতিম দাস একবার একটা গ্রামের স্কুলের অনুষ্ঠানে বোঝাচ্ছিলেন। মহাকাশের এসব ছবি, আমি যা বুঝেছি, সাধারণ আলোর ছবি নয়। ইনফ্রারেড বা ঐ রকমের বিকিরণের সাহায্য নিয়ে ছবি তোলা হয়। সাধারণ আলো, আমাদের ঐ 350 মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে , আমাদের কাছে পৌঁছতে ঐ 350 মিলিয়ন বছর লাগবে। তাহলে কি নাসার বিজ্ঞানীরা , পঁয়ত্রিশ কোটি বছর আগের ঘটনা এখন দেখলেন? 

   এবার ঘটনাটা কি ঘটেছিল, বলি। ঐ কোটি কোটি মাইল দূরের একটি ব্ল্যাক হোল, একটি বিরাট তারাকে নিজের ভেতরে টেনে নিয়েছে। ঐ তারাটি আমাদের সূর্যের থেকে কয়েক লক্ষ গুন  বড় ছিল। ব্ল্যাকহোল, তারা গিলে খাওয়া ইত্যাদি ব্যাপার স্যাপার এতই বড় যে , আমাদের পক্ষে চিন্তা করাই মুশকিল। 

         এটা আমাদের বাড়ির ডোবা পুকুরের মাছেদের খাওয়ার ব্যাপারটা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। পুকুরের একটা বোয়াল মাছ যেমন পুকুরের জলে ঘুরে বেড়ায়। সামনে ছোট মাছ পেলে টুক করে গিলে নেয়, অনেকটা সেরকম। মহাকাশে, বা মহাবিশ্বে এরকম লক্ষ লক্ষ ব্ল্যাকহোল আছে। তারা বোয়াল মাছের মত অন্য তারাদের টুক করে গিলে নেয়।

   ব্ল্যাকহোল ঠিক বোয়াল মাছের মত ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় না। কিংবা হয়তো ঘুরে বেড়ায়; তাদের বিচরণের ক্ষেত্রটাও এতই বড় যে , আমরা কল্পনা করতেই পারছি না। ধরুন আপনি এরোপ্লেন-এ চড়ে আকাশে উঠেছেন। কয়েকশো ফুট ওপরে থাকার সময় পর্যন্ত নিচে গাড়ী চলছে বুঝতে পারবেন। কিন্তু কয়েক হাজার ফুট উঠে গেলে , আলাদা করে বাস-ট্রাকও বুঝতে পারবেন না। আদৌ তারা চলছে কিনা বোঝার উপায় নেই। কিংবা ভানুবাবুর সেই " স্পুটনিকং বিস্ফোরনং" এর যাত্রীর মত, এতবড় পৃথিবীকে , কুমড়ার মত, তারপর কমলা লেবুর মত...............আর দেখা যায়না । মাত্র তিন চারশো মাইল উপর থেকেই, এই পৃথিবীতে যে , রেলগাড়ি দৌড়ে চলেছে, তাই দেখা যাবে না। তাহলে কোটি কোটি মাইল দূরের কোন ব্ল্যাকহোল কেন, কোন গ্যালাক্সি ও দৌঁড়ছে কিনা , বোঝাই মুশকিল।

        ঐ যে একটা বিরাট তারা, আমাদের বড় কর্তা, সূর্যের থেকে কয়েক লক্ষ গুন বড় তারা, একেবারে পুকুরে ঢিল পড়ার মত , একটা ব্ল্যাকহোলের মধ্যে মিশে গেল, ব্যাপারটা ভাবলে শিহরণ হয়না? ঐ তারাটিও হয়তো আমাদের সৌরজগতের মত, বেশকিছু গ্রহ উপগ্রহ নিয়ে, সুখের সংসার পেতে বসেছিল, কোটি কোটি বছর। মহাবিশ্বের অনন্ত চারণক্ষেত্রে, এমন কত লক্ষ কোটি সূর্য তারা , দলে দলে চরে বেড়াচ্ছে।  কোথায় বসে কোন রাখাল রাজা তাঁর বাঁশিটি বাজিয়ে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখছেন, কে জানে? বিজ্ঞান বলছে, এক নিপুণ অংকের নিয়মে, বা গতি পদার্থবিদ্যার নিয়ম শৃঙ্খলার নিয়মে এই মহাবিশ্বের সকল কিছুই চলছে। তাহলে ঐ বিরাট তারাটিও নিয়ম মেনেই, এভাবে ব্ল্যাকহোলে  মিশে গেছে? আমাদের সৌর জগতেরও কি ঐ রকমের অন্তিম পরিণতি হবে? কে বলতে পারে, আজ থেকে 35 বা 40 কোটি বছর পরে, আমাদের এই তুচ্ছ সৌরজগৎও ওরকম একটা ব্ল্যাকহোল-এ অন্তিম ঝাঁপ দেবে না!

  আমাদের ভাষাবিদ , ডা পাত্র বলেন, কবিরা যে সব কথা বলে গেছেন , প্রত্যেকটি কথারই বিশেষ নিহীতার্থ আছে। তাহলে কি সেইসব মহাত্মা , “ পরমেশ্বরী কালিকা” বলে এদিকেই ইঙ্গিত করেছেন? পদার্থবিদ্যা এখনও পর্যন্ত , এ বিশ্বের সৃষ্টির মূলে , “ বিগ ব্যাং” বা মহা বিস্ফোরনের কথা বলছে। আবার এভাবেই , মহাবিশ্ব কি একদিন ,একে একে ব্লাকহোলে মিশে যাবে? “ সৃষ্টি করিয়া করিতেছ লয়” বলতে কি এই , মহা বিস্ফোরন – মহা সংকোচনকেই বুঝিয়েছেন? 

     আমরা অতি তুচ্ছ , অতি ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়েই ৭০-৮০ বছরের এক একটা মানব জীবন কাটিয়ে যাবো। অনন্ত মহাবিশ্বতো বহু দূরের কথা ; বিশ্ব মানবতার চিন্তাই আমাদের মাথায় আসে না। কয়েক হাজার বর্গ মাইলের একটা ভূখন্ডের দখল নিয়েই , প্রতিবেশী দুটি দেশ , দশকের পর দশক লড়াই করে যাচ্ছি। সেও তো মনে হয় বিশাল এক ব্যাপার ; আমাদের প্রতিদিনের তুচ্ছ স্বার্থের কাছে। সূর্যের থেকে ৬৫ লক্ষ গুন তারার কথা ভাবছি ; ওদিকে বনগাঁ লোকালের চার নম্বর সিটের জন্য বাকী তিনজন কেন এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়ছে না , তাই নিয়ে ঝগড়া। 

      ঐ অতি বৃহতের ডাক যে শুনেছে, তার কাছে এসব জাগতিক ব্যাপার স্যাপার তুচ্ছ হয়ে যায়। কত শত মহাত্মা , আজও , তুষারমৌলী হিমালয়ের দূর্গম গুহায় বসে , এই “ মহা বিদ্যা আদ্যা শক্তির” ধ্যানে মগ্ন আছেন ; আমরা  সংসারের কুম্ভিপাকে আবদ্ধ জীব, তাঁদের সাধনার গভীরতার কথা ভাবতেই পারি না। 

  আমদের পাশেই দীর্ঘ একাশি বছর কাটিয়ে যাওয়া ঋষীতুল্য মানুষটিই তো লিখে গেছেন ;  তোমাতে রয়েছে কত শশীভানু , কভু না হারায়ে অণু পরমাণু — আমার ক্ষুদ্র হারাধনগুলি , রবে না কি তব পায়? আমদের এই তুচ্ছ স্বার্থ বুদ্ধি ,পরমা প্রকৃতির চরনে সমর্পন করতে না পারলে, জাগতিক দুঃখ ক্লেশ থেকেও মুক্তি নেই।          ( ১২.১০.২০১৯)

       এই লেখাটি লেখার পাঁচ বছর পর, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে একজন মহাকাশ বিজ্ঞানীর সাথে আলাপ হল। আগে কোথাও লিখেছি, ইন্দোরের দিকে বেড়াতে গিয়ে, আইআইটি ইন্দোরের অধ্যাপক ডক্টর পাত্রের গবেষণাগার দেখে এলাম। সত্যি বলতে কি, আমি এই জীবনে কয়েকজন বিজ্ঞানীকে সামনে মঞ্চে বসে থাকতে দেখলেও এই প্রথম কোন বিজ্ঞানীকে তাঁর গবেষণাগারে ঢুকে দেখলাম। ওনার জন চার-পাঁচ ছাত্র সে সময় ঐ গবেষণাগারে বসে , মহাকাশ নিয়ে গবেষণার কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে, দেখলাম। আমি সামান্য কয়েক মিনিটে ওনাদের গবেষণার বিষয় নিয়ে অতি সামান্য ধারণাই পেয়েছি। আমার এই পাঁচ বছর আগে লেখা নগণ্য নিবন্ধে ওনাদের গবেষণার বিষয় নিয়েই কিছু আভাস দিতে পেরেছি; এটা ভেবেই রোমাঞ্চিত হয়েছি। 

প্রফ নরেন্দ্রনাথ পাত্র ও আমি

প্রফেসর পাত্রের কথা বলতে গিয়ে , আমার ইন্দোরে-ওমকারেশ্বর ভ্রমণ কাহিনীতে একটু আভাস দিয়েছি। উচ্চ পদের মহাকাশ গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত একজন বিজ্ঞানী, স্বামী বিবেকানন্দ লিখিত “ রাজোযোগ” বইটি পড়ছেন , দেখে এলাম। তাহলে কি একজন বিজ্ঞানী, শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান আর দর্শনের মধ্যে কিছু পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজছেন?!!!! আসলে সেইরকম চিন্তা করার যোগ্যতায় তো আমি পৌঁছতেই পারিনি। ঐ স্তরের মানুষ এর চিন্তা ভাবনার কথা ভাবলেই বিষ্ময়ে নীরব হয়ে যেতে হয়।( ২৪.১.২০২৫)

 



 “ নিতাইয়ের চা দোকান , কিংবা ফেসবুকের গল্প”

   আজ সকালে এক বিজ্ঞানকর্মিকে ফেসবুকের তুলনার কথা বলতে গিয়ে, একটি গানের কথা মনে পড়েছিল। " যতীনের চা দোকনে "! প্রায় বছর পনের - ষোল আগে শোনা গান, যতীনের চা দোকানে। সে সময় ঐ গানে , বয়স্ক শিক্ষা বা সাক্ষরতা নিয়ে বলা হয়েছিল। 

  সাক্ষরতার সংজ্ঞা ইতিমধ্যে পাল্টে গেছে। বছর দশেক আগেই শুনেছি, সাক্ষরতা বলতে বোঝাবে, কম্পিউটারের প্রাথমিক কিছু কাজ জানা। এর একটা বেশ গালভরা নাম ও বলেছিলেন, পৃথিবী বিখ্যাত ঐ বাঙালি পন্ডিত , “ কম্পিউটার লিটারেসি”।

          এখন অবশ্য কম্পিউটারের কাজ না জানলেও , এন্ড্রয়েড ফোনেই প্রায় সব করা যাচ্ছে। এই এন্ড্রয়েড ফোনে সস্তার জিও যোগ হয়ে , একটি সামাজিক বিপ্লব হয়েছে। ভালো মন্দ বিচারের ক্ষমতা আমার নেই। তার সময় ও হয়নি । যুগে যুগে যখনই কোন নতুন কিছু এসেছে, তার পক্ষে বিপক্ষে হাজারটা যুক্তি বলেছে লোকে। এই যে দুটি আটম বোমা , লক্ষ লক্ষ  মানুষের প্রাণ নিল, তার পক্ষে বলার লোকও নেহাত কম নেই।

         যতীনের চা দোকানে বসে , সদ‍্য সাক্ষর বয়স্ক মানুষের ,খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া দেখে, কোন গীতিকার গান লিখেছিলেন। এখন এই এন্ড্রয়েড ফোন নিয়ে, আবালবৃদ্ধবনিতার সোশ্যাল মিডিয়া বিচরন, ঐ খুঁটিয়ে কাগজ পড়ার মত। এখানে আদার ব‍্যাপারীও নির্বিকার ভাবে, জাহাজ তৈরির জন্য, বাঘা বাঘা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শ দিতে পারে। এই সেদিন দেখলেন না, চাঁদের বুকে , " বিক্রম গাড়ি টা" নামানো নিয়ে এই , সোস্যাল মিডিয়ার বিশেষজ্ঞদের লাখ লাখ পরামর্শ। আমিও লিখেছিলাম :-

 “ সোশ্যাল মিডিয়া গত দু দিনে প্রমাণ করেছে, ভারতের আর কিছু থাক বা না থাক, এ দেশে কোটি কোটি বিশেষজ্ঞ আছে। Space scientist তো লাখ লাখ । লাখ লাখ লোক বাড়িতে বসে , টিভির রিমোট টিপে , বিক্রম গাড়িটা চাঁদের বুকে নামানোর চেষ্টা করেছিল। কারনটাতো জানেনই, টিভি তে তো দেখতেই পেয়েছেন। যার গাড়ি আগে নামবে, তাকেই বুকে জড়িয়ে আদর! বিক্রম বেচারা এত রিমোটের ধাক্কা সামাল দিতে পারেনিকো!”

   ১লা সেপ্টেম্বর যখন এই লেখাটা শুরু করেছিলাম , তখনও অবশ্য এই “ বিক্রম, প্রজ্ঞান , শিভম স্যার” এদের নামটাও শুনিনি। আমার এই যতীনের চা দোকান , সোস্যাল মিডিয়ার কল্যানে, আমিও , অন্তত ওসব নামটামগুলিতো জেনেছি।

     কথা হচ্ছে , আজকের এই সোশ্যাল মিডিয়া কিভাবে একটা সামাজিক “ বিপ্লব” করে যাচ্ছে?  আমরা চন্ডী মন্ডপ দেখিনি, সাহিত্য বা সিনেমার পর্দায় যেটুকু দেখা। তার পরে এলো শহরের রোয়াক। তাও , আমরা যারা 75-80 সালের পর , হদ্দ গ্রামের থেকে কলকাতায় এসেছি, তারা ওই টেনিদা, ঘনাদার গল্প পড়েই যেটুকু জেনেছি। আমাদের দেখা বাঙালির নির্ভেজাল আড্ডার জায়গা হল , পাড়ার চায়ের দোকান।

  এবার একটু চা খেয়ে জিরিয়ে নিয়ে, জমিয়েই আড্ডাটা দেওয়া যাক। এই যেমন আমি বাজারে বেরিয়ে , আমার এক নাতি কুটুম্বর সাথে গল্প করতে করতে চা দোকানে ঢুকলাম। আমি জানতাম না দোকানদারের নাম নিতাই।

          ওর কোন বন্ধুস্থানীয় একজন রাস্তাদিয়ে যেতে যেতে একটা হালকা ডাকদিয়ে গেল, " কিরে নিতাই, আজ চায়ে ঠিকঠাক চিনি দিছিসত(অ) !"  এই যে একেবারে আকিঞ্চিতকর একটা হালকা রসিকতা, এর থেকেই জল অনেকদূর গড়াতে পারে। নিতাই সোজা সোজা মানুষ হলে, মৃদু হেসেই বন্ধুর রসিকতাটি হজম করতে পারে। যে বন্ধুটি বলে গেল, সেও হয়তো একেবারে রসিকতা করেই বলল। এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সামান্য কথাই কতদূর গড়াতে পারে দেখুন।

  এই যে দুটি নতুন লোক চা খাওয়ার জন্য বসে আছে, এরা ভাবতেই পারে, এই নিতাই লোকটা একটু ভুলো মনের মানুষ, গতকাল হয়তো চায়ে চিনি দিতে ভুলে গেছল। চিনি কম দিলে তো পরে মিশিয়ে নেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু বেশি দিলেই মুশকিল। আমার আবার প্রায় চিনি খাওয়াই বারন। আমার ডায়াবেটিস নেই, কিন্তু ওদিকে বেঞ্চে বসা প্রৌঢ় মানুষটি ব্লাডসুগারের রুগী, তিনি একেবারে হৈ হৈ করে উঠলেন। " এই নিতাই, এসব কি? তাইতো বলি, ভেলোরের ডাক্তার এর ওষুধেও সুগার কমে না কেন?" নিতাই বেচারা একেবারে কান টান ধরে একসা। “না কাকাবাবু , না, আপনি আমার এতোদিনের খদ্দের, কত বছর চিনি ছাড়া চা করে দিচ্ছি আপনাকে, ও ভুল কখনো হয়!”

   এই “ ভেলোরের ডাক্তার” শব্দবন্ধের উপর , বাঙালীর প্রবল দুর্বলতা। ঐযে চায়ের দোকানের কাকাবাবু ঐ যাদু শব্দ দুটি বলেফেললেন , সাথে সাথেই আড্ডার অভিমুখ ঘুরে গেল। ওনারা তিন প্রৌঢ় একেবারে , হিন্দুদর্শন আলোচনার মত , মেতে গেলেন , ভেলোরের ডাক্তার কত ভাল আর কোলকাতার ডাক্তার কত খারাপ , সেই আলোচনায়। 

  আমাদের ঐ সুগারের রুগী কাকাবাবুটির ভেলোর যাওয়ার ইতিহাসটিও বেশ রোমাঞ্চকর। উনি অবশ্য  ওনার সমবয়সী মানুষগুলীর সাথেই গল্পটা “ শেয়ার” করছিলেন। নাতি সহ আমি , আর বাকী জনা তিনেক চায়ের উপলক্ষে বসে থাকা লোকও , প্রবল আগ্রহ নিয়ে শুনে নিলাম । ( চুপি চুপি জানিয়ে রাখি ; কে বলতে পারে, কবে আমকেও যেতে হতে পারে , ভে-লো-র !) শ্রোতা পেয়ে, কাকাবাবু, এটা সম্ভবত 37 নম্বর বার , তাঁর ভেলোর ভ্রমনের গল্প বলতে লাগলেন। " আরে বুঝলে না, সুগারের জন্যে তো ভেলোরে যাওয়া নয়। বিডনস্ট্রিটের ডাক্তার বসুই তো বরাবর দেখেন আমাকে , সুগারের জন্য। এক রাতে নাকি আমি তিনবার জোরে জোরে বাতকর্ম করেছি। আমাদের বৌমা কিন্তু খুব শিক্ষিত মেয়ে, তার উপর ডাক্তারের বাড়ির মেয়েতো, ওর জ্যাঠা মশাই ক্যাম্বেলের ডেপুটি সুপার ছিলেন। আমাকে অবশ্য কিছু বলেনি। তো , সকালেই ছেলে অফিসে বেরনোর আগে বলল, বাবা , তুমি একবার ভেলোরে চেকআপ করিয়ে এস। কেন, ভেলোরে কেন? গত মাসেও তো সুগার 176.5 ছিল!" পাশের ভদ্রলোক বললেন, ওটা পিপি না ফাস্টিং? পিপি। তাহলে তো উইদিন কন্ট্রোল। " আরে ভাই, বলে না, উঠলো বাই তো কটক যাই! ছেলে ওইদিনই অফিসের কম্পিউটার থেকে, ডাক্তারের ডেট নিয়ে, যসবন্তপুর এক্সপ্রেসের টিকিট কেটে ফেলল। বলল বাবা, চলো, একবার সবাই মিলে ভেলোরে চেক করিয়েই আসি। বুঝলে না, ছেলে তো অফিস থেকেই সব পেয়ে যাবে। পাশের বন্ধু মানুষটির মুখটা একটু বিমর্ষ দেখাল। উনি বলেই ফেললেন , “ আরে দাদা, আমরা তো আর ছেলের কোম্পানির পয়সায় ডাক্তার দেখাতে পারিনা , আমি তো নীলরতনেই দেখাই। ডাক্তার চৌধুরীর নাম আছে ; শুনেছি বাইরে ১২০০ টাকা ফি নেন।“ এবার আমাদের কাকাবাবু বুক ফুলিয়ে , ভেলোরের ডাক্তারের গুনকীর্তন আর কোলকাতার ডাক্তারের বদমায়েসির ফিরিস্তি শুরু করলেন । এই একটি প্রসঙ্গে , চায়ের দোকান থেকে  লোকাল ট্রেন , মন্দির থেকে শ্মশান ঘাটে ,বাঙালী বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। কারোর মামাশ্বশুরের বাড়ীওলার ভাইপো , হয়তো সাড়ে সাত বছর আগে ভেলোরে গেছল ; সেই সুবাদে তিনিও “ ভেলোর বিশেষজ্ঞ”।

  যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। এর মধ্যে নাতিকে চিমটি কেটে চুপ করিয়েছি। এ পাড়ায় যে আমার এক পুরান ছাত্র থাকে জানতামই না। বর্তমানে আর জি করে এম ডি পাঠরত ছেলেটি, চায়ের দোকানে আমাকে দেখে, স্যার , বলে এগিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস এরা কলকাতার ডাক্তারদের শ্রাদ্ধকার্যে ব্যস্ত ছিল, নয়তো ছাত্রর সামনেই আমার জামা প্যান্ট খুলে নিত।

  ওকেও পাশে বসতে বলে , চুপচাপ শুনতে বললাম। নীলরতন হাসপাতালে দেখানো দাদু একটু বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, উনি কলকাতার ডাক্তার দেখিয়েই ভালো আছেন। কিন্তু চা দোকানের " খাপ পঞ্চায়েত"  ওনাকে বুঝিয়ে দিল যে, উনি আদৌ বেঁচেই নেই। যেখানে ভেলোরের ডাক্তার পনের মিনিট দেখে, সাড়ে তেইশ হাজার টাকার টেষ্ট করে , ওষুধ দিয়েছে; সেখানে কলকাতার সরকারী হাসপাতালে , চারশ জনের পিছনে লাইন দিয়ে , মাসে মাসে বিনাপয়সায় একটি দুটি টেষ্ট করেই চিকিৎসা! অসম্ভব!

       আমার এই ডাক্তার ছাত্ৰ, এখনও পেশায় প্রবেশ করেনি। এদের একেবারে বোবা- কালা ভাবার কোন যুক্তি নেই। আজকের সমাজ কেমন চিকিৎসা চায়, ওরাও সবই দেখছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালি , কিসে খুশি হয়, এদের আর আমাদের মত , প্রাচীন পন্থী শিক্ষকদের কাছে শিখতে হয়না, সমাজই শেখাচ্ছে।

   ভাবছেন এমন একটি খাপ পঞ্চায়েত এ তিনটি নতুন লোক এতো সময় বসে থাকল, অন্তত দোকানদার নিতাই কিছু বলল না? এই ব্যাটা দরকচা মার্কা কলকাতার ডাক্তারের এই একটি বাতিক। বিনা পয়সায় সিনেমা পেলেই বসে যাই। 

      নিতাই কে ভুলিয়ে রাখতে নিজে দুবার চা খেলাম, আর নাতি একবার একটা বিস্কুট খেল, আর একটা বাপুজি কেক। কেকটা অবশ্য ও পুরোটা খায়নি। নিতাইয়ের দোকানের লেজ নাড়া ভক্ত কুকুরকে অর্ধেক খাইয়েছে। 

  এই কুকুর নিয়েই বা কম কি হল ফেসবুকে। আরে আরে, কখন নিতাইয়ের দোকানে , আর কখন ফেসবুকে বসে আছি ,গুলিয়ে যাচ্ছে। নীলরতনে কুকুরের বাচ্চা মারা নিয়ে কি কান্ডই না হল। পুলিশ , কুকুর হত্যাকাণ্ডের অপরাধী ধরার আগেই, ফেসবুক এর খাপ পঞ্চায়েত, নীলরতন হাসপাতালটিই উঠিয়ে দিল। নিতাইয়ের দোকানেও ওই কুকুর নিয়ে আর এক কান্ড হয়েগেল। একজন গুগুল ঘাঁটা পন্ডিত , ঐ বাপুজি কেকের জন্য আসা কুকুর নিয়ে একটা জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে , নিতাইকে উপদেশ দিল, কুকুরটাকে ভ্যাকসিন দিতে। রাস্তার কুকুরকে ভ্যাকসিন দেওয়ার দায় তার নয় বলায় , লেগে গেল খটামটি। ভেলোরের সব আলো এবার পড়ল ঐ লেড়ি কুকুরের উপরে। আপাতত কুকুরের কল্যাণে , কলকাতার ডাক্তাররা বেঁচে গেল।

   চায়ের দোকানের আড্ডা বলে কথা। মিনিটের মধ্যে রং বদলায়। চিনি থেকে ভেলোরে, সেখান থেকে কুকুরে। তার পরই নাটক জমে গেল। চায়ের দোকান থেকে হাত চারেক দূরে , ড্রেনে এক বেচারা ঢোড়া সাপ দেখে , সে কি হৈ হৈ কান্ড। একজন লাফিয়ে এসে নিতাইয়ের ঝাঁপ আটকানোর বাঁশটা নিয়েই সাপ মারতে গেল। ভেলোর নিয়ে চুপ থাকতে বলেছি, সাপ নিয়ে তো আর বারন করিনি। আমার ছাত্ৰ , জুনিয়র ডাক্তারটি বলে বসল, “আরে ওটা ঢোড়া সাপ, বিষ নেই, কেন মারছেন?” ব্যাস, শুরু হয়েগেল ফেসবুকীয় পান্ডিত্য প্রকাশ। ছাত্রটি একবার বলার চেষ্টা করেছিল, স্যার কিছু বলুন। স্যার যে ঘর পোড়া গরু সেটা ওর জানার কথা নয়।

      স্যারের আবার ঘর কবে পুড়ল? সেই আবার ফেসবুক! যতোই ভাবি চায়ের দোকানের গল্প শোনাবো, সেই ঘুরে ফিরে ফেসবুক। বলতে যখন হবেই, ভ্যান্ত্যারা না করে বলেই ফেলি। একবার বিশ্বজিৎ দাস নামের এক ভদ্রলোক একটি খুব কাজের ভিডিও পোষ্ট করেছিলেন; তাতে আবার আমাকে ট্যাগ করা। বেশ । শাখামুটি সাপ যে খুব উপকারী সাপ , সেটা বোঝাতে ঐ ভিডিওটি বেশ কাজে লেগেছিল। এই অধম সাপপাগল ,ঐ ভিডিওটা বিশেষ ভাবে প্রচারের জন্য ফেসবুকে দিয়েছিল। আন্তর্জাতীক খ্যাতিসম্পন্ন সর্পবিদ বিশাল সাঁতরা , ঐ বিশ্বজীৎবাবুকে সুন্দর ভিডিওটির জন্য ধন্যবাদও দিয়েছিলেন। মাঝখান থেকে এক চ্যাংড়া মন্তব্য করে বসল , “ ওটা আদৌ শাখামুটি? ভুল হচ্ছে না তো” । মাথাটা গরম হয়ে গেল । লিখলাম, আপনার তাহলে ওটাকে ঠিক কী মনে হচ্ছে? আদৌ সাপ মনে হচ্ছে কি? উত্তরে চ্যাংড়া লিখল, “  you are over smart” !  সেই থেকে চায়ের দোকানের আড্ডায় আমি নির্বাক শ্রোতা। 

    নির্বাক থাকাও বিপদ । কদিন আগে , বাঁকুড়ার এক ভদ্রলোক , আমাকে ট্যাগ করে কি যেন একটা ফেসবুকে “ লেপে” দিলেন । এই লেপে দেওয়া কথাটা আবার এমনি এক পাক্কা আড্ডাবাজ , গোস্বামীবাবুর কাছেই শিখেছি। তো , একেবারেই আমার আগ্রহের বাইরের কি যেন বিশয় ছিল । চুপ করে থাকলাম। বাঁকুড়ার ভদ্রলোক দুদিন পরে আমাকে “ কমিউনিষ্ট” বলে গালাগাল দিলেন । জানিনা , চুপকরে থাকার “ বদগুনটা” আবার কবে থেকে ঐ বিশেষ মতাদর্শি লোকগুলির একচেটিয়া হল। 

  এই “ ট্যাগের” বিপদ নিয়ে দু একটা কথা না বললেই নয়। এই ট্যাগ হল , চায়ের দোকানের আড্ডায় আপনাকে জোর করে আটকে রাখা। ধরে নিতে পারেন ; নিতাইয়ের দোকানের সামনে দিয়ে আপনি বাজারে যাচ্ছেন; আপনার পরিচিত কেউ ডেকে বসাল। নিম্নচাপের বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। আপনার ছাতাটি নিয়ে , আপনার বন্ধুটি কোন জরুরী কাজে বেরিয়ে  গেল। আপনি বসে বসে , ওখানে , আপনার অপছন্দের যা কিছুর মধ্যে জড়াচ্ছেন। নিতাই হয়তো আঁচে কয়লা দিয়েছে; আপনি ধোঁয়ার মধ্যে বসে রইলেন। আর , অন্তত যে সব রাজা উজির মারা আলোচনা চলছে, আপনাকে বসে বসে শুনতে হবে। মায় ভেলোর ফেরৎ কাকাবাবুর বাতকর্মের শব্দ গন্ধ সবই সয়ে যেতে হবে। এখানে জনান্তিকে বলে রাখি , ভেলোরের ডাক্তার কিন্তু ওনার ঐ বাতকর্মের  সংখ্যাও কমাতে পারেননি , শব্দও কমাতে পারেন নি। ওটার জন্য যে , ভেলোরের ডাক্তারদের কোন সুপার স্পেশালিটি করা নেই, এই সার কথাটা বাঙালীকে কে বোঝাবে? বাস্তবে , আমার ভেলোরের বন্ধু প্রোফেসার হ্যাসডক , আমাকে প্রায় ঐ রকমই অনুযোগ করেছিল। “ তোমাদের ওখানকার লোক , তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারনে ভেলোরে দৌড়ে আসে কেন ? “ উত্তরটা সবারই জানা ; মধ্যবিত্তের বাতিক রোগ। 

  ঐ ভেলোর ফেরৎ কাকুর অফিসার ছেলের নামটা জানলে , ফেসবুকে খুঁজে বেরকরা কঠিন কিছু নয়। সেখানে দেখবেন , সচিত্র তিরুপতী ভ্রমনের বর্ননা। মায় , বাবার ডাক্তার দেখানো উপলক্ষে ভেলোর গিয়ে , বাকী সবার “ হোলবডি চেকাপের” সগর্ব ঘোষনা। 

    এই দেখুন , ফেসবুকের মহিমা। কোথায় হচ্ছিল, ঢোড়া সাপের বিষের কথা, কোথায় চললাম , ভেলোরের ডাক্তারের মহিমা কীর্তনে। আমার ওই ছাত্র তো একবারই বলেছিল , “ ঢোড়া সাপের বিষ নেই” । অমনি আমাদের নিতাই হয়ে গেল , চায়ের দোকানী থেকে সর্পবিষারদ। নিতাই আমার ঐ ডাক্তার ছাত্রকে পরিস্কার জানিয়ে দিল, তোমরা আজকালকার ছেলে, যা জানোনা, তাই নিয়ে কথা বলবে না। " জয় মা মনসা" বলে , মাথার উপরে হাত তুলে একটা বড় নমস্কার জানাল। ওসব দেখে আমার বাংলায় স্নাতকোত্তর পাঠরত নাতি কুটুম্বর মুখে একটা মৃদু হাসি দেখে, ওই সোজা সিধা মানুষ নিতাইয়ের কি রাগ। বলে দিল, “জানো, মনসা মঙ্গল এ বলেছে, শনি মঙ্গলবার সব সাপের বিষ থাকে।“ এবার প্রায় টানতে টানতে নাতিকে ওখান থেকে সরিয়ে আনলাম। বেচারা মঙ্গল কাব্যের উপর গবেষণা করছে; ওকেই কিনা , জ্ঞান দিয়ে দিল, পাড়ার চায়ের দোকানদার!

         এদিকে হয়েছে আর এক কান্ড, নাতিটি ওই আড্ডার মাঝে আমাকে নিয়ে একটা সেলফি তুলে, ফেসবুকে লেপে দিয়েছে জানতাম না। এর মধ্যে মেদিনীপুর থেকে ওর আর আমার চেনা একজন মন্তব্য করেছে, “এটা তোর ডাক্তার দাদু? অনেক দিন পর দেখলাম।“ নাতি খুশি হয়ে ওর মোবাইলটা আমার হাতে দিয়ে বলল, এই দেখ, হরেনদাদা কি লিখেছে? আমার ছোটবেলার বন্ধু হরেন,  আমিও ওকে , বহু বছর পর , এই ফেসবুক-এর কল্যাণে দেখলাম। ওর টাকটা  এই ক’বছরে আরও কত বেড়েছে ……।।  বলতে বলতেই, আর একটা মন্তব্য। এ লিখেছে, “তোর পাশের লোকটা কেরে? একেবারে হুনমানের মত দেখতে।“ সঙ্গে একটা চোখ মারা ইমোজি। কি আর করা! এই হল সোশ্যাল মিডিয়া। পরের মন্তব্যটা দেখিই নি, এমন ভাব করে, ওর মোবাইল ওকে ফেরৎ দিলাম। 

   আমাকে হনুমান বললেও, ওর ঐ সেলফির কল্যাণে একটা খবরও পেয়ে গেলাম। ছবিতে দেখলাম, আমার হনুমান মার্কা ছবির মাথার পিছনে লেখা ছোট্ট পোস্টার, "  এখানে ফ্লাট ও বাড়ী ভাড়ার সন্ধান দেওয়া হয়।“ গতকালই আমাদের এক বন্ধু জানতে চেয়েছিল, আমাদের পাড়ায়, ফ্লাট ভাড়ার খবর জানি কি না।

          আমারা ওর দোকানে বসে থাকতে থাকতেই , একজন নিতাই কে জিজ্ঞেস করে গেল, পাড়ার যে কাকু নবান্নে চাকরি করে, সে সন্ধ্যায় কখন ওর দোকানে আসে। 

   মনে পড়ল, আমার এক ভায়রা, মেয়ের বিয়ের আগে, হবু জামাইয়ের পাড়ার চায়ের দোকানে আধ ঘণ্টা বসে, জেনে এসেছিল, হবু জামাই ছেলে কেমন। 

  কাজের কাজ যে একেবারেই হয়না তা তো নয়। তবে ওই যে দু’একটা বললাম। এখানে বিশাল সাঁতরাকেও নিতাই চাওলা, সাপ নিয়ে জ্ঞান দিয়ে যায়। বেশিরভাগ মন্তব্যই ওই ," চিনি ঠিকঠাক দিছিসত" গোছের; অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে বলেনা লোকে। তবে হ্যা, নিতাইয়ের চা দোকান পাড়ার একটা দর্পণ। আমার মত মশলা সন্ধানীদের জন্য বেশ একটা, " শুনুকপাহাড়ীর হাট"। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই  লঘু-গুরু জ্ঞান থাকে না। শুনুকপাহাড়ীর হাটে বহু লোক হাঁড়িয়া খায় জানতাম; কিন্তু এখানে তো দেখি প্রায় সবাই মাতাল । ( ১৬.৯.২০১৯)

   



        পন্ডিত স্যার -এর ছেলে

   মনের কথা বলতে বলতে কদিন থেকে বেশ দূরে, একেবারে আমার এখনকার কাজের মধ্যে এনে ফেললাম। অনেকে ভাবছেন, তুমি কোথায় কি করছো তার ফিরিস্তি আমার শোনার কি দরকার। তাছাড়া আমার ফেস বুক আর হোয়াট্‌স আপ ব্যবহার করা বন্ধুরা ভাবছেন, কি সব গেঁয়ো চাষাভুষা নিয়ে কাজ লোকটার; তার আবার গল্প কিসের। আসলে শুরু করেছিলাম আমার খুব ছোট বেলার দু একটা গল্প দিয়ে। জন্মেছি মেদিনীপুরের গন্ড গ্রামে, ষোল বছর বয়স পর্যন্ত ঐ গ্রামেই কেটেছে। যতোই চাকরী সূত্রে শহরে থাকার অভ্যেস করিনা কেন, গ্রামের সংস্কার আজীবন থেকেই যায়। এখনও বাড়ী গেলেই মনে হয়, একটা গামছা নিয়ে পুকুরে লাফিয়ে পড়ি। 

     তাই আজ আবার আমার ছোটবেলার দুই খেলার সাথীর  গল্প শোনাই। বিমল আর মানস। দুজনেই আমার থেকে দু এক বছরের ছোট ছিল। আমাদের গ্রামের মাঝখানের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাঠই ছিল আমাদের খেলার জায়গা। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ওসব গ্রামে খেলা বলতে বৌ বসন্ত, লুকোচুরি এসবই ছিল। আমরা যখন ক্লাশ সেভেন বা এইটে পড়ি, হাস্পাতালের ডাক্তারবাবু, ডা অপুর্ব দাস আমাদের একটা ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি বলছি তারও কয়েক বছর আগের কথা। তখও হাস্পাতালে কোন ডাক্তারবাবু আসেননি।

       গ্রামের আট দশটা বাড়ির, বারো তেরোটা ছেলে মেয়ে বিকেল চারটা বাজতেই হাস্পাতালের মাঠে হাজির। আমাদের বাড়ি ছাড়া পন্ডিত স্যারের দুই ছেলে , এই ছিল মাষ্টারের বাড়ি, আর সব চাষির বাড়ি। হাসপাতালের কোয়ার্টারেই থাকত সুদা। বিমল আমার সমান, কিংবা একটু ছোট ছিল। ওদের বাড়িটা আমাদের বাড়ির দক্ষিনে আর পন্ডিত স্যাররা থাকতেন ঊত্তর পশ্চিমে, স্কুলের বোর্ডিং এর সাথে। বোর্ডিং এর পাশে ছোট দুটি কোয়ার্টারে ওরা ছাড়াও থাকতেন অতুলবাবুরা। অতুলবাবুর দুই ছেলেও ছিল আমাদের খেলার সাথি। মজার ব্যাপারটা হল, অতুলবাবুর পদবি ছিল পন্ডিত, আর পন্ডিত স্যারের পদবি পতি।

       বিমলের মুখটা এখনও চেষ্টা করলে মনে করতে পারি। একটু ফর্সা, গোলগাল চেহারা ছিল ওর। বোধহয় তখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ত। একদিন সকালে ওর মায়ের আর্ত চিৎকার করে কান্না শুনলাম। আমরা এতোই ছোট ছিলাম যে কেউ মারা গেলে দেখতে যাওয়ার মত সাহস হত না। পরে বহুদিন পর্যন্ত বিমলের দাদাদের কাছে শুনেছি, " বিমল টকসিন হয়ে মরেছে"। নিজে ডাক্তার হয়েও কোনদিন ওরকম কোন রোগের নাম শুনিনি।আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ঐ রকম গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা এর থেকে বেশী কিছু ছিল না। ২০১৪ সালেও হুগলীর জাঙ্গিপাড়া গ্রামীন হাসপাতালে এরকম বমি পেটব্যথা রুগীর বাড়ীর লোক " গ্যাস" হয়েছে বলে চিকিৎসা বিভ্রাট করেছে।

      সত্যিকথা বলতে কি জাঙ্গিপাড়ার ঐ রুগীর পর থেকেই আমার বার বার বিমলের কথাই মনে হচ্ছে। গত দশ বছর ধরে সাপের কামড়ে মৃত্যু নিয়ে কাজ করছি। বছর পাঁচ ছয় আগে ঐ বিমলের ছোট ভাই বিশ্বরঞ্জন ওদের একটা রাজ্য সম্মেলনে বলবার জন্য আমাকে মেদিনীপুরে নিয়ে যায়। ওখানেও এই কালাচ কামড়ের রহস্য নিয়েই বেশীরভাগ সময় বলেছি। কিন্তু এতো বছর পর বিশুরও নিশ্চয়ই  মনে হয়নি ওর দাদার সেই অপমৃত্যুর কথা।

    ঐ সন্মেলনে অতুল বাবুর দুই পুত্র, গোপী আর বিশুও ছিল। এই বিশু পন্ডিতের সমান বয়স ছিল সংস্কৃত পন্ডিত স্যারের ছোট ছেলে মানসের। মানসের দাদা তাপসদা আমাদের সাথে কোনদিন খেলেনি। আমি যখন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে,তখন পন্ডিত স্যারের হার্নিয়া অপারেশনের জন্য ওখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের বাঁকুড়ার স্যাররাও কিন্তু আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের খুব যত্ন করতেন। তাপসদা ঐ সময় এক - দু’ দিন আমার হষ্টেলে ছিল। তারপর আর ওর কোন খবর পাইনি। পন্ডিত স্যারকে নিয়ে বাঁকুড়া থেকে ফেরার কথা বেশ মনে আছে। দুর্গাপূজার ঠিক আগে আগেই স্যারকে ফিরতেই হবে। স্যার নিজের গ্রামের ওদিকে কোথাও পূজা করতেন। তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল বিশ্রী। সারা দিনে রাতে দুটি কয়লার ইঞ্জিনের প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলত। রাতের ট্রেনটা এগারোটা নাগাত বাঁকুড়ায়। পূজার ছুটিতে আমিও আসব বাড়ী। রিক্স করে ষ্টেশনে এসেই বুঝলাম পূজার ছুটির ভিড় আছে। তখন ওসব ট্রেনে রিজার্ভেশনের কোন বালাই ছিল না। সঙ্গে মা গোঁসাই ও ছিলেন। কোন রকমে মেঝেতে চাদর বিছিয়ে স্যারের জন্য শোওয়ার ব্যবস্থা হল। আজ যখন ফারাক্কা যাওয়ার জন্য জয়ন্তবাবু প্রথম শ্রেণীর রেলের টিকিট পাঠিয়ে দেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস না রেখে পারা যায়না। মনে পড়ে যায় পন্ডিত স্যারই বোধহয় পড়িয়েছিলেন, " কর্মন্যেবাধীকারস্তে........."!

      সেই পন্ডিত স্যার একবার সাইকেল সহ কাকদাঁড়ীর খালে পড়ে গেছলেন শুনেছি। জল ভর্তি ছিল খালে, তাই বেঁচে যান। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে পাকা বাড়ী বানাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা যান। 

   স্যারের ছোট ছেলে মানসকে একদিন সকালে বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম দেখতে। মানস মেঝের ওপর মাদুরে শক্ত হয়ে পড়ে আছে। পন্ডিত স্যার ওকে ধরে বিহ্বল হয়ে বসে আছেন। আজ পর্যন্ত ডাক্তারীর ছাত্র, পরে ডাক্তার হয়ে কয়েশ মৃত্যু খুব কাছের থেকে দেখলাম। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগের সেই মর্মান্তিক দৃশ্য আজও ভুলিনি। 

   কালাচ নিয়ে কয়েকশ জায়গায় বলেছি। খোলা বিছানায় উঠে ঘুমের মধ্যে কামড়ায়। আমার বাংলা সি ডি তে বলেছি, এমন কি ঘুমের মধ্যেও মারা যেতে পারে। পন্ডিত স্যার আমার সেই সি ডি শুনলে হয়তো জিজ্ঞেস করতেন, " দয়াল, আমার মানসও কি তাহলে.......?" স্যার, আপনার পড়ানো, শুক্তি রত্নাবলীর সেই শ্লোক, “  ঊদেতি সবিতা তাম্রস্তাম্র, এবাস্তমেপি চ। সম্পত্তৌ চ বিপত্তৌ চ মহতাম এক রুপতা।।“ সুর্য ওঠার সময় তামাটে, ডোবার সময় ও তামাটে। বিপদে সম্পদে মহৎ লোক একই রকম থাকে। 

 



মুরগী চোর 

মুরগী চোর, কথাটা এখন বাংলা ভাষায় একটি বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ। জানিনা ইংরেজী বিখ্যাত কোন অভিধানে ইতিমধ্যেই এটি ঢুকে গেছে কি না। আমাদের কুখ্যাত বাম আমলের “ ঘেরাও” শব্দটি অনেকদিনই বিখ্যাত অভিধানে স্থান করে নিয়েছে। সেদিন আমার প্রখ্যাত অধ্যাপক বন্ধু ডক্টর সেন জানালেন, “ বাজারিং” শব্দটি একটি বিশুদ্ধ ইংরেজী শব্দ বলেই বিবেচিত হয়; কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সহযোগী , পিয়ারসন সাহেব এই বাজারিং শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আমার আজকের আলোচ্য এই “ মুরগী চোর” শব্দবন্ধ শোনেননি এমন বাঙালি পাওয়া যাবে না। মূলত একটি গালাগালি হিসেবেই এর ব্যবহার। অথচ তেমন অশ্লীল কথা বলেও এর বদনাম হয়নি। অবশ্য , একেবারেই “ সংসদীয়” শব্দ বলে এখনও জাতে ওঠেনি। এই গালাগালিটি যাকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া হয়, সেই লোকটি কি আক্ষরিক অর্থেই কোনোদিন মুরগী চুরি করেছে? আমরা সবাই জানি, না, কোনোদিনই হয়তো লোকটি মুরগী চুরি করে নি। এমনকি মুরগী কেন, সেরকম কিছু চুরি করেনি। অবশ্য, ঠাকুমার বয়াম থেকে আচার চুরি করে খাওয়া যদি ‘ চুরি ‘ পদবাচ্য হয়, তাহলে তো আমরা সবাই চোর। আর প্রাইমারী স্কুলে বন্ধুর বই এর ব্যাগ থেকে এক দুবার কাঁচের গুলি চুরি না করলে, সে তো পড়াশুনাই করেনি। মুরগী চুরি আসলে সে অর্থে কোন চুরি করাকেই বোঝায় না। ঐ মুরগী চোর শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়, এক বিচিত্র রকমের ব্যক্তিত্ব বোঝাতে। লোকটি একটু যেন উপর চালাক, একটু যেন অমার্জিত, একটু যেন চিটচিটে স্বভাবের। ঠিক ঠিক ভাবে বলতে গেলে , অসামাজিক শব্দটি যেন অনেকটা ওর কাছাকাছি হয়। তো সে যাই তার মানে বোঝাক, মুরগী চোর শব্দবন্ধ দিয়ে অন্য যা কিছু বোঝার হোক, লোকটি একেবারে একটি মুরগী চুরি করেছে, এমনটি কিন্তু কখনোই বোঝায় না। তাহলে কি দাঁড়াল? মুরগী শব্দটি সকল অভিধানেই পাবেন, আর চোর কথাটা তো একটি শিশুও বুঝবে। কিন্তু এই অতি পরিচিত দুটি শব্দ একসাথে উচ্চারিত হলেই সম্পূর্ন আলাদা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এই মূল আক্ষরিক অর্থে না বলে, অন্য কিছু বোঝাতে বা অন্য কিছুর আভাস দিতে যে প্রয়োগ, তাকেই মূলত “ রূপক “ অর্থে প্রয়োগ বলা যায়। আর এইখানেই হয়ে যায় গণ্ডগোল। কোন কথাটা রূপকার্থে প্রয়োগ হয়েছে, আর কোনটা সরাসরি বলা হয়েছে, এই পার্থক্য ধরতে না পারলে , সবটাই ঘেঁটে ঘ। আমাদের সবার পরিচিত কত না বাউল ফকিরের গান আছে। পূর্ণ চন্দ্র দাস বাউল যখন গান ধরেন, “ বিড়াল বলে মাছ খাবো না, আঁশ ছোবো না, কাশী যাব”, আমরা বেশ বুঝতে পারি, কি ব্যাপারে কথা হচ্ছে। কিংবা লালন ফকির বলেছেন, “ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক-ম্-নে আসে যায় “ ( দয়া করে ‘ ক্যামনে ‘ পড়বেন না)। আমাদের কি কখনোই মনে হয়, লালন ফকির একটা খাঁচা নিয়ে বসে বসে পাখী ধরেছেন ? এই যে বাউল,ফকির, দরবেশদের গানের ভাষা, একে প্র্ণম্য সাহিত্যিক প্রয়াত সুধীর চক্রবর্তী মশাই বলেছেন, “ সান্ধ্য ভাষা।” ওনাদের গানে কিছু শব্দ বা বাক্য ওনারা উচ্চারণ করছেন এক রকম, আর তার ভেতরের অর্থ একেবারেই আলাদা। সাহিত্যে সঙ্গীতে এরকম রুপকার্থ শব্দ বা বাক্যের ব্যবহার অতি প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। শুধু লোকায়ত শিল্পীর গানেই এই রকম রূপকের দেখা পাই, সেরকম তো নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন, “ আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি” , তখন কি কোন ব্যক্তির কথা বলতে চান? আরও আধুনিক কবি বিনয় মজুমদার লিখেছেন, “ অন্ধকারে খেতে দেবে, মিষ্ট দ্রব্য, ফল।” অর্থাৎ, সাহিত্যে রূপক এর ব্যাবহার আবহমান কাল থেকে, আজও চলেছে। কিন্তু আমাদের মহাকাব্যের মধ্যে যে সকল ” রূপক” আছে, আমরা অনেকেই সেগুলির ভুল ব্যাখ্যা করি। আসলে হয় আমরা বুঝিই না, নয়তো এক রকমের উন্নাসিকতা আমাদের ভুল ভাবতে বাধ্য করে। আচ্ছা, আমাদের রামায়ণ মহাভারত না হয়, “ গাঁজা সেবন করে” লেখা, “ আষাঢ়ে গল্প” ; ঈশপের গল্প তো পড়েছেন? সেখানে শেয়াল, বাঘ, কাক, বক, হরিণ কি করে মানুষের ভাষায় কথা বলে? আসলে, ওগুলি তো ‘ সাদা চামড়ার মানুষের ‘ লেখা। ওকে গাঁজাখুরি গল্প বললে তো নিজেকে “ শিক্ষিত” বলা যাবে না। আমাদের প্রাচীন মুনি ঋষিরা যে সব কথা মুখে মুখে বলে গেছেন, তার মধ্যে অসংখ্য রূপক আছে। আর যে সব “ অতি রঞ্জন” নিয়ে তথা কথিত শিক্ষিত মানুষেরা “ হেঁ হেঁ” করেন তাঁরা ভুলে যান যে, ঐ সব প্রাচীন সাহিত্য লিখিত আকারে আসতে শুরু করেছে, মাত্রই কয়েকশ বছর আগে। পশ্চিমের পণ্ডিতেরা দ্বিধাহীন ভাবে বলেছেন, মহাভারত অন্তত চার হাজার বছর আগের সাহিত্য। রামায়ণ তারও আগের। হাজার হাজার বছর ধরে, শুধুই মুখে মুখে চলে আসছে এই সকল মহাকাব্য। মুখের কথা শুনে লিখতে গিয়ে কি রকম বিভ্রাট হতে পারে, আমার চোখের সামনে দেখেছি। মেদিনীপুর শহরে থাকতে একদিন পোস্ট অফিসে গিয়েছি, একটা টেলিগ্রাম করতে। সেই যুগে মোবাইল ফোনের কথা আমরা শুনিনি। মেদিনীপুরের সাংবাদিকেরা পোস্ট অফিসে সন্ধ্যা বেলায় গিয়ে, ট্রাঙ্ক কলে কলকাতায় খবর দিতেন। সেদিন মেদিনীপুর শহরের “ পঞ্চুর চকে” কি একটা দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে শুনলাম, রিপোর্টার ফোনে চিৎকার করে খবরটা কলকাতার অফিসে বলেছেন। পরদিন বিখ্যাত পত্রিকার খবরে দেখলাম লেখা আছে, মেদিনীপুর শহরে “ বাঞ্চুর “ চকে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এবার এই একজন শুনেই যদি পঞ্চু বাঞ্চু হয়ে যায়, তাহলে তিন চার হাজার বছরে, কয়েকশ বা হাজার বার কানে কানে ঘুরে ঐ “ পঞ্চু “ বানচু, মানচু, ক্রাঞ্চু, ঘেঁচু, কচু কী আকার নেবে ভগবান জানে। এখনই আমাদের বড় বড় নেতা নেত্রীর মুখে , মহাভারতের “ লেখক” নজরুল ইসলাম হয়ে গেছেন; জানিনা, হাজার বছর পরে বাইবেলের লেখক,  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে যাবেন কি না! অর্থাৎ, আমাদের মহাকাব্ব্যগুলির যে সব বিভ্রান্তি আজ আমাদের চোখে পড়ে, সেগুলি কত শত হাত ফেরতা হয়ে আজকের বকচ্ছপ আকার নিয়েছে, কে বলতে পারে!

এ গেল একটা দিক। আর একটা দিক হল , ভাষার সমস্যা। আমাদের প্রাচীন সাহিত্য সকল সংস্কৃত ভাষায় লেখা। আমরা লাখে একজনও মূল সংস্কৃতে ওসব পড়িনি। অথচ হাজার মাইল দূর থেকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা অর্ধ শিক্ষিত মাতব্বরের মন্তব্য পড়ে “ হা হা, হো হো” শুরু করে দিই। আচ্ছা আপনার পরিচিত শুধু শিক্ষিত ভদ্রলোক কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তো, “ রাম চন্দ্রের অকাল বোধন, মূল বাল্মীকি রামায়ণে নেই” এই খবরটা কজন জানেন? এটি আমাদের বাংলার কবি কৃত্তিবাস ওঝা নিজেই আমদানি করেছেন। এই খবর শুনে আপনার নব্বই শতাংশ বন্ধুই বলবে, তোমার এই ডা দয়াল বন্ধু একটা মাথা মোটা গাড়ল। একই শব্দের বাংলা ভাষায় এক অর্থ, আর সংস্কৃতে অন্য; এরকম হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যায়। আমার লেখা সেই “ বলাৎকার” নিবন্ধটি পড়েছেন? বাংলা খবরের কাগজে প্রতিদিনই এই শব্দটি পেয়ে যাবেন। অথচ, মধ্যম বায়োগ নাটকে , ভীম তাঁর ছেলে ঘটোৎকচকে বলেছিলেন, “ যদি তে শক্তিরস্তি , বলাৎকারেন মাং নয়।” অর্থাৎ, তোমার যদি গায়ে জোর থাকে, আমাকে ধরে নিয়ে চল। সামান্য “ করি” আর “ হয়” শব্দ দুটি নিয়ে কেমন মজা করা যায় দেখুন। “ মনেকরি করি করি, কিন্তু হয় ও হয় না।” এখানে করি শব্দের একটি অর্থ হাতি, আর হয় মানে ঘোড়া। এই সেদিন মহারাজের পাঠ শুনছিলাম; উনি বোঝালেন, “ ব্রহ্মার চার মাথা মানে, উনি চারটি বেদই জানেন।” এবার কোন মুরগী চোর স্বভাবের মানুষকে যদি এই কথা বোঝাতে যান, পুরোটাই পন্ডশ্রম হবে। কথায় আছে না,  “ইঙ্গিতে পণ্ডিত বোঝে , মূর্খ বোঝে কিলে!” ১০.১২.২০২৪.



কম বয়সের খেলা - ২৯

 গোলাম, চোদ্দ, টাকা, দশ। চোদ্দ জন গোলাম বা কাজের লোককে দশ টাকা করে দিতে হবে? না, তাই নয়। যারা এই চারটি শব্দের একসাথে উচ্চারণের মানে জানে, তারা বুঝে গেছেন, আমি কি নিয়ে বলছি। প্রতিটা শব্দই আমাদের সবার চেনা। কিন্তু এদের চারজনের একসাথে থাকার এক মজার ব্যাপার আছে। আরও মজার ব্যাপার হল এই চোদ্দ শব্দটা নিয়ে। ইংরেজিতে লেখা থাকে নয় অর্থাৎ নাইন সংখ্যাটি; কিন্তু বলা হয় চোদ্দ। কেন বলে, কোথা থেকে এই রকম বলা ব্যপারটা এসেছে, আমি জানিনা। কিন্তু খেলুড়েরা সব সময় ঐ চোদ্দই বলে। শুধু টাকা শব্দটিতে সাধারণত “টেক্কা “ বলা হয়। এতক্ষণে আপনিও নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, আমি একরকম তাস খেলার কথা বলছি। তাস খেলার বিভিন্ন ধরনের মধ্যে ” টুয়েন্টি নাইন” নামে একটি খেলা আছে। একেবারে কৈশোর বয়স পর্যন্ত, রং মিলান্তি বলে একটি বালখিল্য খেলার পর, এই টোয়েন্টি নাইন খেলাটি সকলে প্রথমে খেলে। বিড়ি সিগারেট খাওয়া যেমন বড়দের জন্য নির্দিষ্ট, তাস খেলা ও তেমনি বড়দের খেলা বলেই জানতাম। কিন্তু “ তাস পাশা বুদ্ধি নাশা” এই প্রবাদ বাক্য আমি কত কম বয়সে শুনেছি, আজ আর মনে নেই। ছোট বেলা থেকেই দেখতাম, বড়রা তাস খেলে। আমাদের বাড়ীতে অবশ্য কোনোদিনই তাস খেলা হয়নি। ক্লাবে আমরা ছোটরা ক্যারাম খেলতাম। বড়দের তাস খেলতে দেখেছি। আমার বড় দাদার মত কয়েকজনকে দেখতাম, সারা বছরই সন্ধ্যে বেলা, ক্লাবে তাস খেলতে যেত। আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার পর হঠাতই যেন বড় হয়ে গেলাম। পাড়ায় একটা জায়গায় বা কারো বাড়িতে তাস খেলা হত, দুপুরে। আমিও ওদের কাছে শিখে গেলাম, টুয়েন্টি নাইন খেলা। এই টোয়েন্টি নাইন খেলায় চারজন লোক লাগত। যদিও তাসের প্যাকেটে বাহান্নটি তাস থাকে; এই খেলায় বত্রিশটি তাস ব্যাবহার করা হয়। বাকী কুড়িটি তাস পাশে রাখা থাকে, মূল খেলায় তাদের কোন দরকার না থাকলেও অন্য কিছু কাজে তাদের দরকার হয়। এই টোয়েন্টি নাইন খেলায় অনেক খুঁটি নাটি নিয়ম কানুন আছে। অতগুলি নিয়ম মাত্র দুই তিন দিনেই কি করে শিখে গেলাম, এখন ভাবলে বেশ অবাক লাগে। তাস সম্বন্ধে যাদের একটু ধারণা আছে, তারা জানেন, লাল আর কালো দুই রঙের তাস হয়। কিন্তু তাসের চিহ্ন অনুযায়ী চার রকমের তাস। চিড়িতন, হরতন, রুইতন আর ইস্কাপন। এর মধ্যে হরতন আর রুইতন লাল রঙের আর বাকী দুটি কালো। এই চার দলের এক এক দলে তেরটি করে তাস। এক নম্বর বলে কিছু নেই। দুই থেকে দশ নম্বর আর থাকে টেক্কা, গোলাম, সাহেব আর বিবি। মজার ব্যাপার হল, এই ২৯ এর খেলায় টেক্কার এক পয়েন্ট, গোলামের তিন পয়েন্ট, দশের এক পয়েন্ট আর নয়, যাকে চোদ্দ বলে, তার দুই পয়েন্ট। তাহলে চার রকমের তাসের মোট পয়েন্ট হল আঠাশ। কিন্তু খেলাটার নাম ২৯ অর্থাৎ টোয়েন্টি নাইন কি করে হয়েছে, আমি জানিনা। এই খেলায় সাহেব বা রাজা আর বিবি বা রানীর কোন পয়েন্ট নেই। বিশেষ ক্ষেত্রে এরা দুইজন একসাথে থাকলে চার পয়েন্ট হয়ে যায়। এই ২৯ খেলায় দুই জন করে দুটি দলের মধ্যে প্রতিযোগীতা হয়। লটারীর মত করে এক এক জনের হাতে আটটি করে তাস যাবে। প্রথম চারটি তাস পাওয়ার পর এক এক করে ডাক দিতে থাকবে। এই সময় হাতের তাসের পয়েন্ট দেখে একটা হিসেব আন্দাজে করে নিতে হবে যে ঐ মোট ২৮ পয়েন্টের মধ্যে নিজেরা দুই জনে কত পয়েন্ট খেলে অর্জন করতে পারে। এটা ষোল থেকে আঠাশ যে কোন সংখ্যা হতে পারে। পরের চারটি তাস আমার ইচ্ছা বা অনুমান মত আমার কাছে আসবেই এমন কোন কথা নেই। নানান রকম সম্ভাবনা থাকতে পারে। তাই এই খেলায় সামান্য কিছু বুদ্ধি দরকার হলেও , ভাগ্যের জোর বেশী লাগে। তাসের আসল খেলা হল , ব্রীজ খেলা। সেখানে ঐ বহান্নটি তাস নিয়েই খেলা হয়। এতে বুদ্ধি করে খেলার ব্যাপারটি অনেক বেশি। কিন্তু ভাগ্যে যদি বারবার খারাপ তাস আসে, সেক্ষেত্রে শুধু বুদ্ধি দিয়ে খেলা জেতা মুশকিল। অবশ্য বড় বড় খেলুড়েরা নাকি বুদ্ধি করেই খারাপ তাস নিয়েও জিতে নেয়। এসব কঠিন ব্যাপার আমার জানা নেই। কলেজে পড়ার সময় ব্রীজ খেলা শিখেছিলাম। কিন্তু কোন তাস খেলেই আমি তেমন মজা পাইনি। কিন্তু ২৯ খেলাটা সহজ হওয়ায়, আজ প্রায় চল্লিশ বছর পর খেলতে বসলেও, খেলতে পারব। এখনও, লোকাল ট্রেনে মাঝে মাঝে কিছু লোককে ২৯ খেলতে দেখি। অস্বীকার করতে পারব না যে, একটু সময় ভালোই লাগে, ওদের খেলা দেখতে। কিন্তু সুযোগ থাকলেও কোনদিন ঐ নিত্য যাত্রীদের সাথে খেলতে শুরু করিনি। একবার কিন্তু আমি আর আমার বন্ধু সুবোধ, এই ২৯ খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আমাদের হোষ্টেলের একটা অনুষ্ঠানে নানান মজার সাথে এই ২৯ প্রতিযোগিতাও ছিল। চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমরা দুজন দুটি সাধারণ কলম পেয়েছিলাম। ঐ একবারই কোন খেলায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য ব্যপারটা একটি সুখ স্মৃতি হয়ে আছে , এমন কিছু নয়। আসলে ঐ ২৯ খেলার কথা উঠলেই আমার মনে পড়ে, বন্ধু সুবোধ এর কথা। সুবোধ অসময়ে চলে গেছে। ওকে নিয়ে কতো স্মৃতি। জীবনে সফল হওয়ার পর ও চলে গেল। ছেলেও বড় ডাক্তার হয়েছে। কিন্তু ওর এই চলে যাওয়া, আজও যেন মনে হয় ভুল খবর। সুবোধকে ফোন করলেই যেন ধরবে। না, সুবোধের কথা বলতে এই লেখাটা শুরু করিনি। যে কথার থেকে এই ২৯ খেলার কথা আমার চিন্তাকে একটু ব্যস্ত করল, সেই কথাটা এখানে আমি লিখতে ভয় পাচ্ছি।আমার বন্ধু শুভেন্দুবাবুর সাথে ওনার কলেজে একটা ক্লাশ নিতে যাচ্ছিলাম। এটা ওটা কথার পর আমাদের সাম্প্রতিক মন খারাপের ব্যাপারটা উঠল। আমার কন্যাসমা মেয়েটি খুন হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কেমন যেন সব ধামা চাপা পড়ে গেল। সাধারণ বুদ্ধিতে বোঝা যায় না, কি করে এমন হতে পারে। বন্ধু বললেন, আরে মশাই সবই ঐ ঊনত্রিশ এর খেলা। বাপরে! এসব তো ভেবে দেখিনি। মাত্র ২৯ জন খেলুড়ে দিয়ে এমন “ খ্যালা” হতে পারে; কে ভেবেছিল। আসলে আমি এখনও সেই রং মিলন্তি খেলার স্তরে আছি। ২৯ এর খেলাই বুঝতে পারছি না। কে জানে, কেউ কেউ ব্রীজ পর্যন্ত খেলছে হয়তো। আমার মত ক্ষুদ্র বুদ্ধির মানুষের কাছে সবই প্রহেলিকা।১.৫.২০২৫.



কোট নিয়ে কুট কচালি 

কোট, যাকে এখনকার ভাষায় বলে, ব্লেজার; তাই নিয়ে আমার কিছু গল্প আছে। আমরা যখন গ্রামে থাকতাম, মানে সেই ১৯৭৬ সালের আগে; আমাদের পরিচিত কাউকে কোট গায়ে দিতে দেখিনি। আমাদের শীতের পোশাক বলতে ছিল , একটা করে সুতির মোটা চাদর। সোয়েটারও সবার ছিল না। আমার প্রথম সোয়েটার গায়ে দেওয়ার প্রথম দিনটির কথা আজও পরিষ্কার মনে আছে। তখন ওয়েলিংটন স্কয়ারের পাশের ফুটপাথে বেশ জমজমাট ভুটিয়া বাজার বসত। কয়েক বছর আগেও দেখেছি, সেই রকম ভাবেই শীতের পোশাক, সোয়েটার, টুপী, মাফলার, চাদর এইসব নিয়ে, ভুটিয়া বা নেপালী মহিলারা অস্থায়ী দোকান সাজিয়ে বসেছে। আমি সেই ১৯৭৭ সাল নাগাদ, গ্রামের থেকে কলকাতায় এসে, উত্তর কলকাতার একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছি। থাকি মেজদার সাথে, ধরে নিন মেসেই। দাদার রোজগারের উৎস কয়েকটি টিউশনি। বেশ টেনেটুনে চলত আমাদের। আমার কোন ফুলপ্যান্ট ছিল না। সাদা পাজামার উপর খদ্দরের পাঞ্জাবী গায়ে স্কুলে যেতাম। বাইরে বেরোতে হলেও ঐ একই পোশাক। শীত এসে গেলে দাদার মনে হল, একটা সোয়েটার কেনা দরকার। তখনকার যা বাসের ভাড়া বা মেসের খরচ ছিল, সেই অনুপাতে একটা হাফ সোয়েটারের দাম দশ বারো টাকার মত ছিল সম্ভবত। সোয়েটার এর বাজার এর কথা এখন আর মনে নেই। কিন্তু ঐ সোয়েটার কিনে গায়ে চাপিয়েই, ধর্মতলায় আমেরিকান লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলাম। দাদা ওখানে প্রায়ই যেত। কিন্তু আমি সেই প্রথম। আমার মনে আছে, ভেতরে ঢুকে, দাদার পিছন পিছন এগিয়ে চলেছি; ভেতরের প্রায় সবাই আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে। বেশ বুঝতে পারছিলাম, ঐ রকম অদ্ভুত পোশাক পরিহিত বস্তু লোকজন খুব একটা দেখেনি। আজকালকার দিন হলে হয়তো, বাংলাদেশ থেকে আসা জঙ্গি ভেবে নিত। সেই দিনটা আমার আরও বেশি করে মনে থাকার কারণ, ফেরার সময়, দোতলা বাসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ফিরছিলাম। বেশ ভিড় ছিল। গুমোট গরম আর দুর্গন্ধে আমি বমি করে ফেলেছিলাম। দাদার সাথে, ঐ গলির অন্য প্রান্তের মেসের আর এক দাদা ছিলেন। ওরা আমাকে নিয়ে গিয়ে, ওদের মেসের একটা খাটে শুইয়ে রেখেছিল। সেই মেজদা , আমাদের সেই রাতের ডেরা থেকেই একটা চাকরী পেয়ে, ট্রেনিং নিতে কালিম্পং চলে গেল। বোধহয় মাস তিনেকের ট্রেনিং ছিল। আমি একাই সেই রাতের অস্তানায় থাকতাম, না কি সেজদা এসে আমার সাথে জুটেছিল, এখন আর মনে নেই। কিন্তু মেজদা ঐ, তখনকার দিনের সুদূর, কালিম্পং থেকে ফেরার সময় একটা সুন্দর কোট কিনে নিয়ে ফিরেছিল। দাম কত টাকা খরচ হয়েছিল জানিনা; কিন্তু কলকাতার থেকে চার পাঁচ ভাগের এক ভাগও দাম ছিল না ওটার। কিন্তু সেই অসম্ভব সুন্দর, ময়ূরকণ্ঠী রঙের কোট আমরা অনেক বছর গায়ে দিয়েছি। প্রথমে দাদা কয়েক বছর গায়ে দেওয়ার পর, আমি ওটা নিয়ে বাঁকুড়ায় হোস্টেলে চলে গেছলাম। আসলে ডাক্তারী পড়তে হোস্টেলে যাওয়ার আগে আমার কোন সোয়েটারও ছিল না, ফুল প্যান্টও ছিল না। ভাই হোস্টেলে থাকার জন্য যাচ্ছে, তাই আমার মেজদি খুব তাড়াতাড়ি একটা সোয়েটার বুনে দিয়েছিল। আর মেজদা বেশ কষ্টে টাকা জমিয়ে একটা নতুন প্যান্ট কিনে দিয়েছিল। আর একটা বোধহয় দাদার প্যান্ট দর্জির দোকানে আমার মাপে করে নেওয়া হয়েছিল। বাঁকুড়ায় প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম, সেইদিন রাত্রে বাঁকুড়া থেকে দশ বারো কিমি দূরে, ঝাঁটিপাহাড়ির এক গ্রামে ছিলাম। জীবনে সেই প্রথম জেনেছিলাম, “ ঠাণ্ডায় হাড় কাঁপানো” কাকে বলে। সেই জন্যই বোধহয় দাদা তার সখের কোট আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। অনেক বড় বড় মানুষের জীবনে আমার থেকেও অনেক বেশি দুর্দশা ছিল, পড়েছি। তাঁদের কেউ কেউ লিখেছেন, তাঁদের মা কিংবা ঠাকুমা নিজে না খেয়ে, একটাই রুটি ছেলে বা নাতিকে খাইয়েছেন। আমার মেজদা, আমাকে মানুষ করার জন্য কি কি আত্মত্যাগ করেছিলেন, আমি সব জানতেও পারিনি। আমার জীবনে সবথেকে বড় ব্যর্থতা, সেই দাদার মৃত্যুর সময় আমি তাঁর পাশে থাকতে পারিনি। সে এক চুড়ান্ত লজ্জার , চুড়ান্ত অসহায়তার কাহিনী।

 

 কোট এর গল্পে সেই সব কথা নাই বা বললাম। দাদার সেই কোট আমি বহু বছর গায়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার যখন নিজের পয়সায় একটার জায়গায় দুই তিনটা কোট কেনার ক্ষমতা হয়েছে, তখন হয়তো সারা বছরে একদিনও কোট গায়ে দেওয়া হয়নি। কলেজে সেই কোট গায়ে কোনোদিন ক্লাশে যেতে পারিনি। কেন? এতদিন পরে ঠিক কারনটা মনে করে লেখাও সম্ভব নয়। তবে মনে হয়, তখন কোন ছাত্রকে কোট গায়ে দিয়ে ক্লাশে যেতে দেখিনি। কোন শিক্ষককেও সম্ভবত না। কোট গায়ে দেওয়া ছাত্র, ব্যপারটা একটু ব্যাতিক্রমী ছিল ; সেটা অনেক বছর পর এক দাদার কথায় বুঝেছিলাম। বোধহয় সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়, সরস্বতী পূজার ভাসানে আমি কোট গায়ে দিয়ে বেড়িয়েছিলাম। তখনকার মেইন হোষ্টেল ছিল কেন্দুয়াডিহিতে। পরে সে হোষ্টেল ফার্মেসি কলেজকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কলেজের প্রধান পূজা ঐ মেইন বা ওল্ড হোস্টেলে হত। ওখান থেকে বাদ্যি বাজনা বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে, এখনকার গোবিন্দনগরের সব হোষ্টেল ঘুরে তারপর হত ঠাকুরের ভাসান। আমি বোধহয় তখন ফাইন্যাল ইয়ার, বা পাশই করে গিয়েছি। ঐ দাদার সাথে ভালো করে আলাপ হল। উনিই বলেছিলেন, তোকে সরস্বতী পূজার ভাসান এর সময় কোট গায়ে দিতে দেখেছিলাম। অর্থাৎ একটি ছাত্র কোট গায়ে দিয়েছে, এটা বেশ চোখে পড়ার মত ব্যাপার ছিল। ঐ কোট নিয়ে আর যে কথাটা আজ প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরও মনে আছে; আমি আমাদের গ্রামের এক সান্ধ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে গেছলাম। আমার স্কুলের বন্ধু দুই তিন জনের সাথে পিছনে দাঁড়িয়ে গান শুনেছিলাম। আমাদের মাধ্যমিক ব্যাচের একমাত্র ছাত্রী সুনন্দা গান গাইছিল। পরে বন্ধুদের কাছে বলেছে, আমাকে স্টেজ থেকেই লক্ষ করেছে। বোধহয় আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও, সামনে এগিয়ে আসতে দ্বিধা করে আসতে পারেনি। সেটা শুধু ঐ “কোট গায়ে দেওয়া বাবু হয়ে গেছে” বলেই। তারপর আর কোনদিন সুনন্দাকে আমি দেখিনি। 

ডাক্তারী পড়া শেষই করতে পারতাম না, মেজ বৌদি তাঁর গয়না বন্ধক রেখে শেষ বছরের টাকা জোগাড় করে না দিলে। ছয়শ টাকার হাউস স্টাফ, তারও দেড়শ টাকা করে মাসে ঐ বন্ধক রাখা গোল্ড লোন পরিশোধ করতে ব্যাংকে জমা দিতে হয়। সেই দুর্দশার দিনেও ঐ ময়ূরকণ্ঠী কোট গায়ে একটা চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে মেদিনীপুরে এসেছিলাম। মাত্র সাত মাস করেই সেই অতি সাধারণ, দাতব্য প্রতিষ্ঠান এর চাকরী ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলাম। কিন্তু সেই দুর্দিনে ঐ চাকরীটাও বেশ দরকার ছিল। কিন্তু ঐ কোটের ব্যপারটা যে আজও মনে আছে, তার দুটি বিশেষ কারণ আছে। কলকাতার তখনকার দিনের দাপুটে এক বয়স্ক ডাক্তারবাবু আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। পরে ওনার সাথে কাজ করার সময় উনি আমাকে জানিয়েছিলেন, কোট টাই পরে আসা ছেলেটাকে দেখেই ওনার খুব ভালো লেগেছিল। পরবর্তী কালে কলকাতার শেরিফ হওয়া সেই ডাক্তারবাবু বহু বছর আগেই গত হয়েছেন। কিন্তু আমার প্রথম “ বস” , আমার পরবর্তী অনেক সত্যি বসের থেকে অনেক বেশী স্মার্ট ছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

আমার প্রথম বস

 ঐ কোট গায়ে ইন্টারভিউ দিতে আসার ব্যপারটা আরও একজনের চোখে পড়েছিল। আমি হোষ্টেল ছেড়ে চলে আসার কথা বলতে গেছলাম, আমাদের খুব প্রিয় জয়ন্ত বসু স্যারকে। স্যার বললেন, আপনাকে কোট টাই পরে রিক্স করে স্টেশনের দিকে যেতে দেখেই বুঝেছিলাম, কোথাও ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছেন। ঐ প্রথম কোট নিয়ে অনেক গল্প জমে ছিল। এখন আমি,  “কোটের কুট কচালী “ কেন শিরোনাম দিয়েছি, সেটাই বলি। ঐ যে সত্যি বসের উল্লেখ করেছি, তাঁদের নিয়ে কিছু বলি। আমার প্রথম সরকারী চাকরীর বস, মানে সেই জেলার CMOH সাহেব এখন আর ইহ জগতে নেই। উনি বেশ কবি কবি স্বভাবের মানুষ ছিলেন; আমি যতোদিন ওনার জেলায় কাজ করেছি, কোনোদিন ওনাকে রাগতে দেখিনি। আর যা দেখিনি, সেটা হল, ওনাকে কোনোদিন কোট গায়ে দিতে দেখিনি। আর সেই জন্যই CMOH অফিসে কোনোদিন কোট গায়ে দিয়ে যাইনি। অবশ্য তার অনেক আগেই আর এক CMOH কে দেখেছি। আমি তখন সিংহের মত কেশর ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াই। চোখ অপারেশনের শিবিরে রুগী দেখা বা সার্জেন হয়ে যাওয়া, সব সময় কোট টাই পরে “ Lion” হয়ে যাই। কোটের কলারে Lions pin লাগালেই বেশ নিজেকে সিংহ সিংহ মনে হয়। শহর থেকে মাইল পনের কুড়ি দূরের এক স্কুলে চোখ অপারেশন এর শিবির করা হয়েছে। সেই শিবিরে আমিই প্রধান সার্জেন। শিবির উদ্বোধন করতে গিয়ে, স্টেজে আমার পাশেই বসেছেন, জেলার CMOH. পুরো সময় যেভাবে আমার নতুন ব্লেজারটি পর্যবেক্ষণ করলেন, ( ওনার সুনাম অনুযায়ী) আমাকে যে সন্ধ্যায় একবার 

ওনার বাংলোয় দেখা করতে বলেননি, সে শুধুই আমি তখন সরকারী চাকরী করতাম না বলেই। কিন্তু চাকরী না করেও যে, চাকরী করা সরকারী ডাক্তারদের ঈর্ষার কারণ হয়েছিলাম, শুধু ঐ কোট টাই পরে চেম্বারে যাওয়ার কারনে। মেদিনীপুর থেকে বালিচকে যেতাম , সপ্তাহে একদিন করে। খুব ভালো কিছু প্র্যাকটিস ছিল না। একই নার্সিং হোম এ যেতেন একজন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ আর একজন ডেন্টিস্ট। ওরা দুজনেই আমার থেকে বয়সে বড়। একদিনই কি একটা যোগাযোগ হয়েছিল, আমরা তিনজনই এক সময়ে ওখানে হাজির। ঐ দুইজন, আমার কোট টাই বাঁধার ব্যাপারটাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে বেশ ট্যারা বাঁকা আলোচনা শুরু করে দিল। আর সেটা আমাকে পরোক্ষে শোনানোর জনই। 

জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলন এর সময় “ শিরদাঁড়া” কথাটাই একটা বিরাট রাজনৈতিক অভিঘাত নিয়ে এল। অন্তত পঁচিশ বছর আগেই আমি আমার জুনিয়রদের বলতাম,’ সরকারী চাকরী করতে এসেছো, শিরদাঁড়াটি বাড়ীতে বাবার কাছে রেখে আসতে হবে!’ অনেক বড় বড় “হনু” দেখেছি , ঐ চাকরী করতে গিয়ে। মুখে স্বীকার করতো না, কিন্তু বেশ বোঝা যেত, শিরদাঁড়াটি বাড়িতে রেখেই এসেছেন। আমিও আমার ঐ অঙ্গটি এবছরই একত্রিশে মার্চ বিকেলে আবার শরীরে জুড়ে নিয়েছি। যে কথা থেকে অনেকটা সরে আসতে হল; সেই প্রথম সরকারী চাকরীর বসকে দেখার পর থেকেই, সরকারী আপিসে কোট গায়ে দিয়ে যেতে কুন্ঠা হতে শুরু করে। অবশ্য নিজে একটা “ নিধিরাম সর্দার” আমলা থাকার সময় মাঝে মাঝে আপিসে কোট গায়ে দিয়ে যেতাম। (আমার “ নিধিরাম সর্দারের আমলাগিরি” লেখাটা আজই সকালে চোখে পড়ল। নতুন কিছু খবর দিয়ে ওটা আবার আপনাদের পাঠার্থে দেব। ) পরেও বেশ কয়েকটি জেলার বস আর হাসপাতালের বসের কাছে কাজ করার সৌ অথবা দুর্ভাগ্য হয়েছে। সব সময়ই মনে হয়েছে, বসই তো কোট গায়ে আসেন না, আমি কোট গায়ে দিয়ে গেলে সেটা ভালো দেখায় না। অবশ্য শীত কালে বনের মোষ তাড়ানোর জন্য গ্রামে গঞ্জে গেলে, কোট গায়ে দিয়েই যেতাম। সেখানে তো আমিই বস। আসলে কোট টাই পরে সাহেব সেজে না গেলে, শ্রোতারা অনেক সময় সাপুড়ে আর সাপ কামড়ের  ডাক্তার আলাদা করতে পারে না। অবশ্য গ্রামের আধা শিক্ষিত মানুষ বলে নয়, অনেক ডাক্তারকেও দেখেছি, অন্যদের কাছে বলে , “ মজুমদার তো বন জঙ্গলে সাপ ধরে বেড়াচ্ছে!” আমার এই বিষয়টাকে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বহু বছর আগেই “ Neglected Tropical Disease” বলে চিহ্নিত করেছে। 

আমরা যারা এর সাথে যুক্ত, তারাও যে “ অবহেলিত” সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আমার এই মোষ তাড়ানোর কাজের জন্যই, বার দশেক দূরদর্শনে অনুষ্ঠান করেছি। ওদের ওখানে বসে বলার সময় কোট গায়ে দিয়ে বসলে কিছু কাজের সুবিধা হয়। ওদের কলার মাইক্রোফোনটি কোটের ভেতর দিয়ে নিয়ে, টাই এর সাথে আটকানো যায়। এ ছাড়াও, ঐ যে বললাম, নিজেকে সাপুড়েদের থেকে আলাদা বোঝাতেও কোট টাই পরে অনুষ্ঠান করতে ইচ্ছা করে। সব শেষ যেদিন দূরদর্শনে অনুষ্ঠান করতে গেছলাম, আমরা সাথে আরও দুজন বেশ বড় ডাক্তারবাবু ছিলেন। আমি আমার দশ বারো বছর অনুষ্ঠান করার অভ্যাস মত, কোট টাই পরেই গিয়েছি। আসলে, একেবারে শীতকাল না হলে, ব্যাগে ভরে নিয়ে যাই; ওখানে পোশাক পাল্টে নেওয়ার সুযোগ আছে। ঐ দুই বড় ডাক্তারবাবুর একজন একটি মেডিক্যাল কলেজের বিভাগীয় প্রধান। আর অন্যজন, রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের সর্বোচ্চ পদাধিকারী। বিভাগীয় প্রধান তো আমাকে ব্যাগ থেকে কোট টাই বের করে পরতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়েই বললেন, আমি এখানে বলতে এলে এই কালো, হাতকাটা জ্যকেটটাই পরি। কিন্তু রাজ্যের সর্বোচ্চ পদাধিকারী একটি হাফ হাতা জামা গায়েই হাজির হয়েছিলেন। অত্যন্ত সম্মানীয় পদে আসীন মানুষ, তাই কিছু বলতেও পারলাম না। বলা দরকার ছিল, স্যার, আপনি একটু কোট টাই পরেই এসব অনুষ্ঠানে আসবেন। 

সব শেষে আমার আর এক বসের মানসিকতা বলেই কোটের কুট কচালী বন্ধ করতে চাই। আমার এই বস, মূলত দূরদর্শনে অনুষ্ঠান করেই বেশ বিখ্যাত হয়েছিলেন। ওনার সাথে দেখা হওয়ার অন্তত পনের বছর আগে থেকেই ওনার নাম চিনি। আমারও ধারণা ছিল, উনি একজন বিশাল জ্ঞানী মানুষ। একসাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আমরা যা বুঝতে না পেরে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি সেটা আমাদের থেকেও কম জানেন। সেসব কথা প্রকাশ্যে বলাও নিম্ন রুচির পরিচয় হবে। উনি নিজে কিন্তু কোট টাই পরে, বেশ ফিটফাট হয়ে আসতে পছন্দ করতেন। আমি কোনদিন ওনার দপ্তরে কোট গায়ে যাইনি। সেই প্রথম CMOH থেকেই ঐ অভ্যাসটি রপ্ত করেছিলাম। একবার ওনাকে নিয়ে হাবরায় একটি শিবিরে যাবো। উনি বাইরে চেম্বার করে , এদিক থেকেই গাড়ীতে উঠবেন। আমি সকাল সকাল কোট টাই পরে, ওনাকে নিতে একটি নার্সিং হোমে হাজীর হয়েছি। গাড়ী আসতে মিনিট দশেক দেরী। তার মধ্যে উনি আমার কোটটি খুঁটিয়ে দেখেছেন। বললেন, তোমার কোটটা বেশ সুন্দর। আমি জানালাম, ওটা পঁচিশ বছরের পুরনো। ভালো কথা। এটা কিন্তু মেজদার সেই ময়ূরকণ্ঠী কোট নয়। এটা আমি ১৯৯২ সালে , কলকাতার একটি নামি দোকান থেকে কিনেছিলাম; আজও বেশ ভালো আছে। এই বসের পরবর্তী একটি ব্যাপারে একটি মন্তব্য আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, সেদিন উনি আমার কোটের প্রশংসা করলেও, আসলে উনি আমার ঐ স্মার্ট ড্রেস পছন্দ করেননি। এই ব্যাপারটি আমার ভ্রাতৃপ্রতীম পাঠকদের ভবিষ্যতে মাথায় রাখতে বলছি। উচ্চ পদের বেশ কিছু মানুষ, কতোটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হতে পারেন, এই একটি মন্তব্যেই পরিষ্কার। বাম আমলের থেকেই বি এস সি, এম এস সি করা অপ্টোমেট্রিস্ট দের দাবী ছিল, তাঁদের সরকারী চাকরী দিতে হবে। এখনও কিছু অপ্টোমেট্রিস্ট সরকারি হাসপাতালের চাকরীতে অছেন; এনারা সবই ডিপ্লোমা করে চাকরীতে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারি ভাবেই অনেক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অপটোমেট্রির ডিগ্রী, মাষ্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। কিন্তু আজও ওদের জন্য কোন সরকারী চাকরীর ব্যবস্থা হয় নি। ওদের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনা করার জন্য একটি কমিটি করে, দায়িত্ব দেওয়া হয় আমার ঐ বসকে। উনি পরদিন আমাকে বলেছিলেন, “ বাপরে , সব একেবারে কোট টাই পরে সাহেব সেজে এসেছে। এদের দিয়ে কি কাজ হবে! আমি একেবারেই না করে রিপোর্ট দিয়ে এলাম।” এত বছর পর বেশ বুঝতে পারছি, সরকার আদৌ এদের জন্য কিছু করতে চায় না। কিন্তু ঐ ‘ কমিটির রিপোর্ট ‘ দেখিয়ে সব সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিয়েছে। অর্থাৎ ওদের শিক্ষা, ওদের যুক্তি যুক্ত দাবী, সরকারি হাসপাতালের কাজের জন্য ওদের বাস্তব প্রায়োজন, এসবের থেকেও ওদের পোশাক আসাক বেশী বিবেচ্য ছিল। তাই স্মার্ট আর ওভার স্মার্ট এর সুক্ষ্ম তফাৎ বুঝে পোশাক পরাটা খুব জরুরী। অন্তত একটি ভালো খবর দিয়ে এই প্রসঙ্গ শেষ করি। বছর পাঁচেক আগে আমার নিজের কন্যা, বিদ্যুৎ ভবনে ইঞ্জিনিয়ার এর চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে গেছল। আমি নিজে ওকে, শাড়ির উপর আমার সেই ১৯৯২ সালের কেনা, নেভী ব্লু ব্লেজার পরে যেতে বলেছিলাম। ও সেই চাকরী বছর দুই করে ছেড়ে দিয়ে, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি নিয়েছে। আমার পরের দুটি কোটের একটি, কলকাতার নামকরা দোকানে তৈরী। কিন্তু আর একটি করেছেন, আমার প্রিয়, মুস্তাফা দর্জি। ১২.১২.২৪.

 

 



পান্ডা এবং ফান্ডা 

পান্ডা মানে আমরা কি জানি? প্রথমেই মনে আসবে, মন্দিরের পান্ডা। পুরীর মন্দিরের পান্ডা তো বিখ্যাত। বিশেষ করে এই পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে যারা একবার ঘুরে এসেছেন, তাঁরা তো পান্ডা ব্যাপারটি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। কয়েক ডজন পান্ডার দাপটে স্বয়ং জগন্নাথ দেবের চোখও কপালে উঠে এসেছে। কোলকাতার বিখ্যাত কালী মন্দিরের পান্ডাদের অত্যাচারের কথা খুব শুনতাম। বোধহয় সেই ভয়েই, প্রায় পঞ্চাশ বছর কলকাতায় যাতায়াতের মধ্যেও, একবারও সেই মন্দিরের দিকে যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি। আজকাল অবশ্য কলকাতার ঐ এলাকার নাম মাহাত্ম অন্য কারণে বিপুল পরিমাণ বেড়ে গেছে। যে কেউই ঐ জায়গার নাম করলেই লোকে সন্দেহের চোখে দেখে। ভাবে, এই লোকটা আবার কোন ধান্দায় ওদিকে যাতায়াত করছে! সেই সব কাণ্ড কারখানা দেখেই বোধহয়, স্বয়ং মা কালী লজ্জায় জিভ কেটেছেন।

 গয়া গিয়েছেন কখনও? হিন্দু বাঙালির এক পবিত্র কর্তব্য পালন এর জন্য একবার যেতেই হয়। আমিও গিয়েছি। বংশ পরম্পরায় কি অদ্ভুত কায়দায়, এক শ্রেণীর বামুন ( ব্রাহ্মণ বলে শ্রদ্ধেয় সম্প্রদায়ের অপমান করার ইচ্ছা নেই আমার) তীর্থ যাত্রীদের কাছে টাকা আদায় করে চলেছে , না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমরা আমাদের ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাময়িক আশ্রয় থেকে বাইরে পা ফেলার সাথে সাথেই একদল যুবক আমাদের ঘিরে ধরল। তাদের সবার একটিই জিজ্ঞাসা, পাণ্ডার নাম কি? আমাদের বড়দা আগে একবার গয়া তীর্থে ঘুরে এসেছেন; ওখানকার ব্যাপার স্যপার একটু জানা ছিল, তাই আগেই বলে রেখেছিলেন যে, আমাদের পাণ্ডার নাম, “ গনেশ।” সেই জন্যই আমাদের সেজদা বা মেজদা, ঐ যুবকদের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “ গনেশ।” সাথে সাথেই ওদের একজন মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “গনেশ ঠাকুর বোলো!” ভিড়ও সাথে সাথে পাতলা হয়ে গেল। ওদের মধ্যে যে ছেলেটি গনেশ পাণ্ডার লোক ; সম্ভবত নাতি, পুতি, বা পুতির পুতি কেউ হবে,” ঠিক আছে, চলো মন্দিরের দিকে”, বলেই সিনেমার হিরোর মত মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে, ভোটভটিয়ে চলে গেল। আমরা সেবাশ্রমের গেটের বাইরে থেকে একটি বড় আটো ভাড়া নিয়ে চললাম, মন্দিরের দিকে। গয়া শহরের রাস্তা বা বাড়ী ঘরের যে করুন অবস্থা সেই বছর কুড়ি বাইশ আগে দেখেছি, সে কথা আর এখানে লিখলাম না। বোধহয় ঐ রকম একটা প্রতিবেশ এর জন্যই, আমার ভক্তি শ্রদ্ধা আগেই অর্ধেক চলে গিয়েছিল। 

আমরা অটো রিক্সা থেকে নামার সাথে সাথেই সেই নব্য যুবক, পাণ্ডার পুতি,  আমাদের সামনেই একটি দোকান দেখিয়ে, সেখান থেকে জিনিস পত্র কিনে নিতে বলল। সেই দোকানের হতশ্রী অবস্থাও আমার ভক্তির ভান্ডারে টান দিয়েছিল। আমরা পূজার বা পিণ্ড দানের সামগ্রী নিয়ে কয়েক পা হেঁটে একটি পাথর বাঁধানো চত্বরের মধ্যে গিয়ে থামলাম। সেই যুবক বা অন্য কেউ আমাদের ঐ চাথালের এক জায়গায় বসে যেতে বলল। আমাদের মত আরও কয়েকটি দল ঐ ভাবে, এদিক ওদিক বসে গিয়েছে। এবার এসে হাজির হলেন, আমাদের আসল পান্ডা। সম্ভবত ঐ পুতি পাণ্ডার বাবাই হবেন। বছর ষাট   মত বয়স হবে। কাচা ধুতি আর ফতুয়া পরিহিত মানুষটি, বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ভদ্র ভাবেই আমাদের সাথে কথা বার্তা বলতে থাকলেন। কিন্তু মুখের থেকে সেই সকাল আটটা - সাড়ে আটটাতেই ভুর ভুর করে ধেনো মদিরার গন্ধ ছড়াচ্ছিল। বড়দা একটি পিতলের ঘটি কিনেছিলেন, ফল্গু নদী থেকে পূজা পাঠের জন্য জল নিতে। পান্ডা মশাই জেনে নিলেন, আমরা স্নান সেরে এসেছি কি না; না হলে ফল্গু নদী থেকে স্নান সেরে আসতে বললেন। দাদা তখন ঐ ঘটিতে জল তোলার কথা বললেন। পান্ডা মশাই বললেন, যাও, নদীতে নেমে জল নিয়ে এসো। 

ফল্গু নদীর সন্বন্ধে যে বিখ্যাত প্রবাদ চালু আছে, আমাদের সামনে তা দেখলাম না। বর্ষার ঠিক শুরুতে বলেই, নদীতে হাঁটু পর্যন্ত জল ছিল। বেশ ঘোলা, লাল মাটি গোলা জল। সেই জল হেঁটে পেরিয়ে কেউ কেউ অন্য পারে চলে যাচ্ছিল। সেই জলই এক ঘটি তুলে আনা হল। বছরের অধিকাংশ সময় বোধহয় নদীর বালী খুঁড়ে জল বের করতে হয়। এই রকম আর একটি জায়গায় গিয়ে আমাকে হতাশ হতে হয়েছিল। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে, চেরাপুঞ্জি গিয়ে দেখি, ঝাঁ ঝাঁ রোদ। রোদের জন্য ছাতা মাথায় দিতে হল। মাসখানেক বোধহয় এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েনি। 

সেই পাথরের চাথালে বসে তো আমাদের শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ করালেন, পান্ডা মশাই। আমাদের পান্ডা যে, গনেশ ঠাকুর মশাই, সে কথা কি করে জেনেছি, এই রকম কোন কথায় উনি জানলেন যে, বহু বছর আগে, আমাদের প্রয়াত পিতৃদেব একবার গয়ায় এসেছিলেন। কোন জেলায় বাড়ী? কত বছর আগে নাগাদ বাবা গয়ায় গেছলেন, এইরকম কয়েকটি তথ্য জেনেই, সেই পাণ্ডার পুতি , চট করে কোথাও গিয়ে, একটি পুরনো জাব্দা খাতা নিয়ে এল। আর আমাদের চমকে দিয়ে, সেই খাতার একটি পাতায়, আমাদের বাবার সই দেখিয়ে দিল। আমার রাঙা দাদা খুবই আবেগ প্রবন মানুষ। বাবার হস্তাক্ষর দেখেই, আবেগে কেঁদে উঠলো। এবার, পাণ্ডার কাজ শেষ করতে হবে; “তীর্থ গুরুকে” কত হাজার টাকা দক্ষিণা দেব, জানতে চাইলেন। নিজেই বললেন, পাঁচ হাজার টাকা দেবে, না কি দশ হাজার? সেজদা ব্যবসায়ী মানুষ। মেদিনীপুরের বড় ডোম পাড়ায়, মাসিক পাঁচ টাকা ভাড়ায় খড়ের চালের ঘরে ভাড়া থেকে, কলেজে পড়েছে। সে পঞ্চাশ টাকা থেকে দরাদরি শুরু করে, শেষ পর্যন্ত বোধহয় এক হাজার টাকায় রফা করল। এখন নিশ্চয়ই সেই যুবক পাণ্ডার পুতি নিজেই “ তীর্থ গুরুর” স্থান নিয়েছে। জাবদা খাতার সব তথ্য কম্পিউটারে ওঠানো হয়েছে কি না জানিনা। সেদিন আমরা বাবার সই এর নিচে, সকলে সই করে এসেছি। আমাদের পরের প্রজন্মের কেউ হয়তো একদিন মেদিনীপুরের গ্রামের মানুষ এর খোঁজ করে, সেই খাতার পৃষ্ঠাটি আবিষ্কার করবে। 

পান্ডাকে তাঁর দক্ষিণা মিটিয়ে , আমরা আসে পাশের আরও কিছু জিনিস দেখে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাময়িক আস্তানায় ফিরে এসেছিলাম। বিকেলে একটি বড় আটো ভাড়া নিয়ে ঘুরে এলাম, বুদ্ধ গয়া। কি সুন্দর এক প্রশান্তির জায়গা। না গেলে, গয়া শহরের একটা ঘিনঘিনে স্মৃতি সারা জীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হত।

গয়া তীর্থের পাণ্ডার গল্প শোনাতে কি আপনাদের এতটা সময় নষ্ট করলাম? না। মিশনের মহারাজের পাঠ আলোচনা শুনছিলাম, প্রতিদিন সকাল এর মত। উনিই “ পান্ডা” কথাটি বলে, এর উৎপত্তি ইত্যাদি বুঝিয়ে দিলেন। স্বয়ং আদি শঙ্করাচার্য বলেছেন, পন্ডিত কথাটির মূল হল, এই পান্ডা শব্দটি। কোন একটি বা একাধিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন যিনি, তিনিই পান্ডা বা পণ্ডিত! অথচ আজ দেখুন, পণ্ডিত আর পান্ডা দুটি জিনিসে কয়েক হাজার মাইল দূরত্ব। পান্ডা মানে ঐ রকম অর্ধ শিক্ষিত, গলায় একটি পৈতা ঝুলিয়ে, লোকের আবেগ আর ভক্তিকে কাজে লাগিয়ে, পয়সা উপার্জন করা একটি শ্রেণীর মানুষকেই বুঝি আমরা। পণ্ডিত মানুষ কখনোই ঐ ভাবে লোক ঠকিয়ে পয়সা রোজগারের কথা ভাববেন না। 

এই যে পান্ডা মানে আসলে পণ্ডিত মানুষ; এই খবরটি জানার পর, আমার বেশ মজার একটি কথা মনে এল। সেই আশির দশকে আমি যখন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে পড়তাম, তখন “ ফান্ডা” কথাটা আমাদের মধ্যে খুব চালু ছিল। আর আশ্চর্যের কথা, সেই সময় আমরা “ ফান্ডা” বলতে কিন্তু ঐ পাণ্ডিত্যের কথাই বোঝাতাম। আমাদের ক্লাশের বন্ধু বিদ্যুৎ ছিল, আক্ষরিক অর্থেই পণ্ডিত। প্রতিটা বিষয়েই আমাদের সবার থেকে বেশী পড়াশোনা করে, অনেক বেশি জানত। আমাদের সার্জারীর বিখ্যাত শিক্ষক, পূজ্যপাদ ডি কে রায় স্যার,  এক একদিন টানা তিন - চার ঘণ্টা ক্লাশ নিতেন। সে একে অপূর্ব সুন্দর, আনন্দের সঙ্গে শেখার অভিজ্ঞতা। মাঝে মাঝেই স্যার অদ্ভুত কৌশলে আমাদের সকলকে মাতিয়ে তুলতেন। কিছু একটা পড়া জিজ্ঞেশ করে, কেউ না বলতে পারলে, বলতেন, “ পণ্ডিত, বল এবার!” আসলে প্রথম দিনেই স্যার বুঝে গেছেন, এই বিদ্যুৎ ছেলেটি গোটা ক্লাসের থেকে পড়াশোনায় অনেক বেশি এগিয়ে আছে। কয়েক মাস আগে, স্যারের কলকাতার বাড়ীতে গেছলাম একবার। প্রায় নব্বই বছর বয়সী স্যারের শরীরের সাথে স্মৃতিও জব্দ হয়ে গেছে, এটাই স্বাভাবিক। কথা বলতে বলতে, আমাদের ক্লাশের কে কি করছে, এইসব কথা জানতে চাইলেন। বিদ্যুৎকে নিশ্চয়ই মনে আছে স্যার? না রে, নাম মনে রাখতে পারি না আজকাল, বললেন স্যার। কিন্তু আমাদের ক্লাশের “ বড় পণ্ডিত?” সেই চল্লিশ বছর আগের মত হৈ হৈ করে উঠলেন স্যার। মোবাইলে ভিডিও কল করে পণ্ডিতকে ধরলাম। আহা, গুরু শিষ্যের সেই কথপোকথন আমি চুপ করে বসে শুনলাম। এ যেন কোন উপনিষদের যুগে ঘুরে এলাম আমি। 

বিদ্যুতের ছিল ডাক্তারি পড়াশোনায় “ ব্যাপক ফান্ডা।” আর , আড়া পাগলা জ্ঞান দাদার ছিল, পূর্ব ইউরোপের জিয়ো পলিটিক্সের উপর ফান্ডা। কারো কারো ছিল, খেলাধুলার খবরের ফান্ডা। এই সেদিনও আমাদের সহকর্মী এক ভাইয়ের ছিল, “ শেয়ার মার্কেটের ফান্ডা!” আমাদের নন্দ দাদার কাছে হাত জোড় করে বসে নিতাম, “ মিউচুয়াল ফান্ডের ফান্ডা।” আমার ছেলের কলেজের দাদা,  পবিত্র দাদার আছে, “ মোটর সাইকেল এর উপর ফান্ডা!” সেই আদি শঙ্করাচার্য এর যুগের “ পান্ডা” আজ কি করে “ ফান্ডা” হয়ে গেল, সেই ফান্ডা আপনাদের কারো থাকলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন। আজ ২৪.৬.২৫. গতকাল সন্ধ্যা থেকে শুরু করে আজ সকাল এগারোটার পর এই লেখাটা শেষ করলাম।

 

 




    

                 আঙ্গুর

       আঙ্গুর এর দিন এসে গেল। এখন বাজারে গেলে ফলের দোকানে দু রকমের আঙ্গুর দেখা যায়। কালো আর সাদা। অন্যান্য ফলের দাম ক্রমশ বাড়ছে; কিন্তু মাত্র দিন দশকে আঙ্গুরের দাম প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। আমাদের আমের সময়ের মত যেখানে আঙ্গুর হয়, সেখানে নিশ্চয়ই এক সাথে অনেক বেশী ফসল বাজারে এসে যায়। যে কোন কারনেই হোক , আঙ্গুর এখন সাধারণ মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে এসেছে। আমরা আমাদের ছোট বেলায়, মেদিনীপুরের গ্রামে আঙ্গুর, আপেল বা ন্যাস্পাতি কে বেশ বিদেশী ফল বলেই জানতাম। আর এটাও জানতাম ওসব ফল অন্তত স্কুল মাষ্টার জাতীয় সাধারণ চাকুরেদের নাগালের বাইরে। আমাদের গ্রামের ওদিকে আম, কলা, পেয়ারা, কাঁঠাল , বেল , দেশী খেজুর আর তালই ছিল ফল। সরস্বতী বা লক্ষ্মী পূজায় শশা, শাকালু আর আখও ফল হিসেবে দেওয়া হত। কখনো কখনো শহর থেকে দু’ একটা আপেল এলে, সেটা বেশ একটা খবরের মত হত। বেদানা তো প্রায় ভিন গ্রহের ফল ছিল। 

         আঙ্গুরের প্রথম যে স্মৃতি আমার কাছে এখনও উজ্জ্বল সেটা আমি যখম এগারো ক্লাসে পড়ি তখনকার। তখনও আমি নিজে কোনদিন কলকাতায় আঙ্গুর কিনেছি বলে মনে পড়ে না। একদিন মির্জাপুর স্ট্রীট দিয়ে হেঁটে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের দিকে যাচ্ছিলাম। দুজন শাড়ি পরে মহিলা, সম্ভবত কলেজ বা ইউনিভার্সিটি র ছাত্রী; বড় বড় আঙ্গুর কিনে , রাস্তার পাশের কলে ধুয়ে নিচ্ছিলেন। ওদের সেই কলের জলে আঙ্গুর ধোয়ার দৃশ্য কেন যেন আমার কাছে, কোন সিনেমার দৃশ্য বলে মনে হয়েছিল। 

  বহুদিন পর্যন্ত আমার ধারনা ছিল , আঙ্গুর মানেই তার ভেতরে বীজ থাকবে। বীজ ছাড়া যে কোন ফল হতে পারে আমার ধারনায় ছিল না। অনেক পরে জেনেছি, বড় আঙ্গুরের বীজ থাকলেও , ছোট আঙ্গুরের বীজ হয় না। এখন কলকাতার রাস্তার পাশের ফলের দোকানে বীজ ওলা বড় আঙ্গুর প্রায় দেখাই যায় না। অসময়ে এক রকম বড় লালচে আঙ্গুর আসে, তাতে বীজ থাকে। দাম প্রায় চারগুণ , অথচ ছোট আঙ্গুরের মত খেতে ভালো নয়। আঙ্গুর আগে গোল গোলই দেখতাম ; এখন গোল আঙ্গুর আর দেখাই যায় না। সাদা অর্থাৎ সবুজ আঙ্গুর এখন প্রায় সবই লম্বাটে ক্যাপসুলের মত। কালো আঙ্গু্র ক্যাপসুলের মত কম দেখা যায়। বেশিরভাগ কালো আঙ্গুর বেশ পেট মোটা চেহারার হয়। ফাল্গুন বা চৈত্র মাসে , একদিন আমার টিফিন কৌটায় মোটা আঙ্গুর দেখে আমাদের এক অধ্যাপিকা ভাবলেন , কালো জাম , বললেন , এ সময় তুমি জাম পেলে কোথায় ? ওটা যে জাম নয় , আঙ্গুর সেটা তাঁকে একটা খাইয়েই বোঝাতে হয়েছিল সেদিন।  কালো আঙ্গুরের থোকা এক একটা পাঁচশ থেকে সাতশো গ্রাম ওজনের হয়। এই আঙ্গুরের গায়ে এক রকম সাদা পাউডার মত মাখান থাকে, তাই না ধুয়ে খাওয়া যায় না। কালো আঙ্গুরের দাম সবুজ আঙ্গুরের থেকে একটু বেশী থাকে সবসময়। 

  বছর তিরিশ আগে মেদিনীপুর শহরে থাকার সময় প্রথম আঙ্গুর গাছ দেখি ডা মনোরঞ্জন দত্ত স্যর -এর বাড়িতে। লতানে গাছ, খাঁজ কাটা পাতা, বাড়ীর পাশের জমি থেকে দোতলা ছাড়িয়ে উঠেছে। কিন্তু ঐ গাছে কোনদিন আঙ্গুর হতে দেখিনি। কয়েক বছর আগে প্রথমে ছবিতে দেখলাম, বাঁকুড়ায় ফুলবাড়িয়া গ্রামে, শ্রদ্ধেয় পি কে সরকার স্যর -এর ,” আমাদের হাসপাতাল” চত্তরে। কেউ একজন বলেছিলেন, মে- জুন মাসে গেলে আঙ্গুর দেখা যায়। তাই এক মে মাসের শেষের দিকে বাঁকুড়া শহর থেকে গেলাম, স্যর -এর নতুন শান্তিনিকেতন দেখতে। আমাদের সাথে ছিলেন, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ মহাশয়; উনি স্যর -এর কাছে পড়েছেন। আমাদের হাসপতাল নিয়ে আগে লিখেছি। প্রত্যন্ত গ্রামে হাসপাতালের চার দিক ঘিরে কয়েক একর জমিতে বাগান।

           বাঁকুড়ায় ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে দক্ষিণবঙ্গ  রাষ্ট্রীয় পরিবহনের পিছন দিকে একটি বিশাল লোহার গেট দেওয়া আপিস চত্ত্বর দেখলাম। গেটের কাছে গিয়ে দেখলাম ভেতরে বড় বোর্ডে লেখা আঙ্গুর গবেষণা কেন্দ্র। ওদের ভেতরে ঢুকে কি আছে দেখা হয়নি।  ফুলবেড়িয়া আমাদের হাসপাতালের বিরাট বাগানে  একদিকে পেয়ারা বাগান , ডালিম বাগান , তারপর আঙ্গুরের বাগান।  আগের রাত্রে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গাছের পাতা সব রোদে চকচক করছিল। এই বাগানের আঙ্গুর পাতা কিন্তু সব ঘন সবুজ। ডাক্তার দত্তর বাড়িতে আর বাঁকুড়ায় ডাক্তার পালের বাড়িতে যে আঙ্গুর লতা দেখেছি, তাদের পাতা লালচে। আমাদের হাসপাতালে আঙ্গুরের বাগান প্রায় এক বিঘা জমিতে। মাসিমার সাথে সাথে আমরা আঙ্গুর বাগানে ঢুকলাম। সারি সারি মাচায় তোলা আঙ্গুর লতা। কিছু লতা থেকে আঙ্গুরের থোকা ঝুলছে। থোকায় কিছু আঙ্গুর পেকে কালো আর কিছু সবুজ। আঙ্গুর একেবারে গোলগোল, ছোট ছোট। এক দুটি পাকা আঙ্গুর তুলে খেয়ে দেখলাম মিষ্টি। পরে জানলাম, যেটুকু আঙ্গুর হয়, ওখানে আশপাশের লোকজন আর রুগীর বাড়ীর লোকেরাই কিনে নিয়ে যায়। 

       এই রুগীর বাড়ীর লোকের আঙ্গুর কেনার কথায় একটা কথা মনে পড়ল। আমরা যখণ মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়ার ডাক্তার, তখন দেখতাম , প্রায় সব রুগীর বাড়ীর লোকেরা হাসপাতালে ভর্তি রুগীকে আঙ্গুর খাওয়াতে ব্যস্ত। আমাদের এক দু’জন স্যার এই আঙ্গুর খাওয়ানোর ব্যাপারটা পছন্দ করতেন না। তাঁরা বলতেন, আপনার বাড়িতে কি আঙ্গুরের চাষ হয়, তাহলে আনতে পারেন। বাঁকুড়ায় কোন সময়ই খুব ভালো আঙ্গুর বিক্রি হতে দেখিনি। এখন আমরা কলকাতার বাজারে কোন টক আঙ্গুর দেখি না। তবে বর্ষার সময় সম্ভবত কিছু আঙ্গুর আসে, যেগুলোকে টক বলা যায়।

     গোটা পৃথিবীতে যত আঙ্গুর চাষ হয় তার বোধহয় নব্বই শতাংশই মদ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আসলে মদ তৈরিতে ব্যবহার করে যেটুকু বাড়তি থাকে, সেটুকুই আমাদের মত বেরসিক লোকের রসনা তৃপ্তির জন্য কাঁচা আঙ্গুর হিসেবে বাজারে আসে। আঙ্গুরের আর একটা অংশ কিসমিস তৈরির জন্য যায়। আঙ্গুর শুকিয়ে কিসমিস করে খেলে তাতে নাকি খাদ্য গুন বেশি থাকে। আজকাল বাজারে সবুজ আঙ্গুর আর কিসমিস একই দামে কি করে পাওয়া যায়, এ একটা রহস্য।

          আঙ্গুর খাওয়ার আগেই আমাদের পড়া হয়ে গেছে , আঙ্গুর ক্ষেতে শেয়ালের গল্প। মনুষ্যেতর প্রাণীর বলা সেই কথাটাই বোধহয় সাহিত্যে সবথেকে বেশী ব্যবহার হয়েছে, " আঙ্গুর ফল টক"! শেয়াল বেচারা তো না খেয়েই বলেছিল; এখন তো দেখছি এক শ্রেণীর লোক কুড়ি বছর নিয়মিত খাওয়ার পরও বলছে, আঙ্গুর ফল টক। জানিনা ওনাদের মত প্রতিদিন কুইন্টাল দরে খেলে হয়তো এক সময় ভিম নাগের সন্দেশ বা মধুও টক লাগে। আমরা ছা পোষা প্রাণী, এক কেজি আঙ্গুর কিনে তিনজনে তিনদিন ধরে খাই। আমাদের সব অঙ্গুরই মিষ্টি লাগে।   

পুনশ্চঃ ২০২৫ সালের মে মাসের শেষের দিকে একটি ভ্রমণ কোম্পানীর সাথে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে এলাম। গোটা ৮-৯ দেশের ভেতর দিয়ে বাসে করে চার হাজার কিমির বেশি চলেছি। বিস্তির্ণ চাষের মাঠ দেখেছি। শেষের আগের দিন, ইটালিতে ঢুকে , শত শত মাইল , রস্তার দুই পাশে শুধুই   আঙ্গুরের চাষ দেখে অবাক হয়েছি।   এখনও গাছে আঙ্গুর ধরেনি। ডা সরকার স্যারের বাগানে কিন্তু এই সময় আঙ্গুর পাক্তে শুরু করে দেয়।    

           

পুনশ্চঃ ২০২৫ সালের মে মাসের শেষের দিকে একটি ভ্রমণ কোম্পানীর সাথে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে এলাম। গোটা ৮-৯ দেশের ভেতর দিয়ে বাসে করে চার হাজার কিমির বেশি চলেছি। বিস্তির্ণ চাষের মাঠ দেখেছি। শেষের আগের দিন, ইটালিতে ঢুকে , শত শত মাইল , রস্তার দুই পাশে শুধুই   আঙ্গুরের চাষ দেখে অবাক হয়েছি।   এখনও গাছে আঙ্গুর ধরেনি। ডা সরকার স্যারের বাগানে কিন্তু এই সময় আঙ্গুর পাকতে শুরু করে দেয়।



       

 

   আলা

 বহুদিন শুধুই চোখের ডাক্তারী করে নলের ব্যবহার প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। এমন  সময় নতুন করে একদিন উপরওয়ালার নির্দেশে গলায় নল ঝুলিয়ে ইমার্জেন্সির দিকে রওনা দিলাম। প্রথমদিনই কিনা ঠিক মনে নেই, উত্তর ভারতে মানুষ হওয়া, দিল্লিতে ডাক্তারী পড়া , মোহনা আমাকে ঐ মুর্তিতে বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে উচ্ছাস চেপে রাখতে পারল না। বলেই ফেলল, স্যার ইউ আর লুকিং স্মার্ট! এমনিতে আমার কন্যাসমা এই লেডি ডাক্তার কি বলল তাতে আমার অন্তত বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া হল না।

   পরের দিন আবার ঐ প্রসঙ্গ উঠল। এবার মোহনা জানাল যে উত্তর ভারতে এই স্টেথোস্কোপকে বলে আলা। ওখানে ডাক্তারী পড়ুয়াদের মধ্যে এই আলা নিয়ে দারুন একটা ভাবালুতা আছে। আমাদেরও ছিল। ঐ অল্প বয়সে এই যন্তরটিকে এক রকম মর্যাদার প্রতীক মনে হত। ক্রমশ জীবনটাকে বুঝতে বুঝতে এখন এমন একটা অদ্ভুত জায়গায় এসে পৌছেছি যেখানে কোন কিছুতেই আর উচ্ছাস আসে না।

   এই আলা বা এর ওজন সারা জীবন বয়ে বেড়ানোও যে কত কঠিন হয়ে যায় এক সময়, সেই গল্পই শোনাই আজ।

      কলেজে গিয়ে আলাপ হল পাঠকের সাথে। আমার বাড়ীর সবথেকে কাছে ওর গ্রাম। ওর দিদির বাড়ী আমাদের গ্রামে; অথচ ওকে কোনদিন দেখিনি। ওর দিদির বাড়ীটা আমাদের শৈশবের খেলাঘর ছিল। আমরা বৌদি বলতাম। আমার বড়দির বিয়ের আগের, সিনেমা দেখার সঙ্গিনীদের একজন ছিলেন এই বৌদি। আমাদের সাত আট বছর বয়স পর্যন্ত এই বৌদির বাড়ী ছিল গ্রামের আট দশটা বাড়ীর গোটা বারো বাচ্চার অবাধ বিচরন ক্ষেত্র। বিশেষ করে বিরাট পেয়ারা গাছটায় যখন পেয়ারা পাকত,একেবারে হনুমানের পালের মত আমরা দাপাদাপি করতাম।

      পরে এই পাঠকের বাড়ী গিয়ে দেখেছি,ওদের বাড়ীটাও অনেক ফল পাকুড়ের গাছে ঘেরা। ও ছিল ভাইদের মধ্যে সবথেকে ছোট। আমরা কলেজে পড়ার সময়ই সম্ভবত ওর বড়দা স্কুলের মাষ্টারী থেকে অবসর নেন। 

      এখন যেমন প্রায় সবকটা গ্রামেই একজন করে হাতুড়ে ডাক্তার আছে, পয়ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে তাও ছিল না। আমাদের দুজনের বাড়ীর দুরত্ব মাইল চারেক; তার প্রায় মাঝামাঝি একজন, টি টি এম পি হাতুড়ে ছিলেন। এই ডিগ্রিটা সবাই বুঝলেন না তো? ওটা হল টেনে টুনে ম্যাট্রিক পাশ।

   এই টি টি এম পি দের যে সমাজে কী ব্যাপক প্রভাব,আমরা তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই টের পেয়েছি। এখনতো এটাই একটা বিরাট আলোড়ন তুলেছে রাজ্য জুড়ে। যে সমাজে এইট ফেল পঞ্চায়েত সদস্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারকে স্যালাইন চালানোর নির্দেশ দিতে পারে,সে সমাজকে এমন টিটি এম পিরা চালনা করবে  সে আর আশ্চর্য কি! আমরা সবে একটা করে আলা কিনেছি। পাঠক হস্টেলে আসার আগে বাড়ীতে একদিন বোধহয় মোড়ক খুলে নাড়াচাড়া করছিল। হতেপারে অমন একটা যন্তর ভাইপোদের দেখিয়ে একটু সমীহ আদায় করছিল। ওর মাষ্টার মশাই বড়দা ওকে বলেছিলেন,এটা নিয়ে অধীরের কাছে চলে যা, কেমন করে চালাতে হয় শিখে আয়। ও তো একেবারে হতভম্ব। দাদার মুখের ওপর কথা বলার সংস্কৃতি তখনও সমাজে জল ভাত হয়ে যায়নি। একজন হাতুড়ের কাছে ট্রেনিং নেওয়ার বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতেই সম্ভবত ও ছুটি শেষ হওয়ার দুদিন আগেই হস্টেলে ফিরে এসেছিল।

     একজন মাষ্টার মশাইয়ের যদি এক হাতুড়ের ওপর এমন ভরসা থাকে, তাহলে সাধারন চাষাভুষার কি অবস্থা অনুমান করা যায়। তাছাড়া আমাদের মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধেও লোকজনের ধারনা কি! 

    ঐ অধীর ডাক্তরের মত বেশ কয়েকজন হাতুড়ের সাম্রাজ্যে আমার বন্ধু দাপিয়ে বেড়াচ্ছে,এমন খবর মাঝে মাঝেই পেতাম। উত্তরবঙ্গে চলে যাওয়ার পর তো যোগাযোগ আরও ক্ষীণ হয়ে গেল। একবার বোধহয় শুনেছিলাম ওর মোটরবাইক দুর্ঘটনা হয়েছিল। আবার একদিন শুনলাম ও সরকারী চাকরীতে যোগ দিয়েছে। একেবারে মোবাইল ফোনের যুগে এসে আবার যোগাযোগ হল। বাড়ীর কাছে কোথাও একটা চুক্তির ডাক্তার হিসেবে কাজ করে আর বাড়ীতে প্রাকটিশ, এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু উনপঞ্চাশ বছর বয়সে চাকরী পাকা করতে গিয়ে, তাঁতীর এঁড়ে গরু কেনা হয়েগেল।

     এই পাকা চাকরীর গুতোয় ওকে ঘরবাড়ী ছেড়ে বাঁকুড়া জেলায় চলে যেতে হল। মাঝে কয়েকবার মোবাইলে কথা হল ওর সাথে। ঘাড়ের স্পন্ডাইলোসিসের অপারেশন করতে হবে। অপারেশন হয়েছে, এ খবরও পেলাম। আমার মোষ তাড়ানোর কাজে ওদিকে যাচ্ছি, ওর সাথে দেখা হতে পারে, জানালাম ওকে। রাত্রে ওর বাসায় থাকতে বলল।

      বাঁকুড়ার কাজ সেরে বিষ্ণুপুরে এসে নামলাম সন্ধ্যের মুখে। সৌম্য মোটরবাইক নিয়ে ষ্টেশনে এসেছিল; হাসপাতালে যাওয়ার আগে বন্ধুর বাসায় বড় ব্যাগটা রেখেই চলে গেলাম। রাত্রে কি খাবো জানতে চাওয়ায় বললাম,দুটো রুটি। রাত নটা নাগাত ফিরে এলাম। পরদিন সকালে মেদিনীপুরের ট্রেন ধরবার আগে পর্যন্ত যে ঘন্টা দশেক থাকলাম,তার মধ্যে ঘুমের জন্য ঘন্টা পাঁচেক বাদে অফুরন্ত গল্প হল দুজনে। প্রায় পঁচিশ বছরের জমে থাকা গল্প। তাও ওর জীবনের কথাই শুনলাম প্রায় পুরো সময় ধরে। 

    নিজের জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরী প্রাসাদে থাকে সপ্তাহে দেড় দিন। এখানে একটা ছোট্ট লজের একটা রুম ভাড়া নেওয়া আছে, ওখানেই চলছে বছরের পর বছর। একটা বাসা বাড়ী তো ভাড়া নেওয়াই যায়; তখন আবার দুবেলা খাওয়ার সমস্যা। এখানে লজের খাওয়ারে বেশ অভ্যস্ত হয়েছে দেখলাম। 

  ডাক্তার গ্রামের মধ্যে একটা বিরাট বাড়ী বানিয়েছে, ও তো গরীবের রক্ত চোষা পয়সায়! সে আবার অক্লান্ত পরিশ্রমের কি আছে? সেই গল্পই হল গভীর রাত পর্যন্ত।

   আমি তিনদিন চেম্বার নষ্টকরে চারটে শহরে সাপের কামড় নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বাড়ী ফিরব,এটা কোন খবরই নয়। ওকে একবার চোখে দেখেই বুঝলাম, একেবারে জব্দ হয়ে গেছে। অপারেশনের পর ঘাড় একেবারে শক্ত হয়ে গেছে। বেশ ধীরে সুস্থে হাটাচলা করে।  ওকে বললাম হেড অফিসে গিয়ে তুই সাহেবদের কাছে দাঁড়ালেই তো তোকে বাড়ীর কাছে ট্রান্সফার করবে। ও উত্তরে যা জানাল, কুড়ি বছর চাকরী করেও আমার যে ঐ বোধটা হয়নি তাই ভেবে নিজেকে একটি আস্ত গাধা ভাবছি, আজও। আমি ভাবছি মানবিকতার কথা, রোবটের যে মন থাকে না তাতো ভাবিনি। ওকে বলা হয়েছে, আপনি তো উত্তরবঙ্গ করেননি, এরপর তো আপনাকে উত্তরবঙ্গে পাঠাতে হয়। 

    এবার ওকে মোক্ষম প্রশ্নটা করতেই হল। বেশ তো ছিলি, করে কম্মে খাচ্ছিলি, এই এঁড়ে গরু কেনার বদ বুদ্ধি মাথায় এল কি করে? ও যা জানাল তার মোদ্দা কথাটা হল, পালিয়ে বাঁচার জন্য। বছর কুড়ি একটা মানুষ সকাল  পাঁচটা ছটা থেকে রাত এগারোটা বারোটা পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে; পৃথিবীর আর কোন পেশায় আছে? ও বলছিল, যে কয়েক ঘন্টা বাড়ীর বাইরে, হাসপাতালে থাকে সে সময়টাই " আরাম"। একদিনের কাজ শোন, সকাল পাঁচটা থেকে একটা লোক এসে বসে আছে, মাইল পাঁচেক দক্ষিনে,তার বাড়ীতে যেতে হবে। প্রাতকৃত্য সেরে চা খাওয়ারও সময় দিতে চায় না লোকে। ডাক্তার আবার চা খাবে কেন? চলল মোটর বাইক নিয়ে। ফিরে দেখে জনা দশেক রুগী এসে গেছে। তারাতো ঘন্টা দুই বসে আছে কেউ কেউ। ডাক্তার আগে এদের না দেখে মুড়ি খাবে কেন?  ওর মধ্যে একজনের বাড়ী যেতেই হবে; পশ্চিম দিকে মাইল সাতেক দূরে তার বাড়ী। এখানের রুগী শেষ করে ঐ কল সেরে বাড়ী ফিরতে আড়াই তিনটা। ততক্ষণে আবার জনা পাঁচ সাত এসে গেছে। তাদের না দেখে ডাক্তার স্নান খাওয়া সারবে! এজন্যই তো শালারা মার খায়। বিকেল পাঁচটার দিকে দশ মাইল দূরে আর একটা কল। সন্ধ্যেয় গোটা দশেক রুগী বাড়ীতে বসে দেখা। শেষ কলটা উত্তরদিকে মাইল সাতেক দূরে দেখে ফিরতে মধ্য রাত। এমনি করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলছে। 

    একজন উকিল বা ইঞ্জিনিয়ার ছেড়েই দিলাম; একটা রাজ মিস্ত্রীও এমন পরিশ্রম করলে একটা তিনতলা বাড়ী বানাতে কত বছর লাগে? এবার মনে পড়ছে প্রনম্য শিক্ষক ডা কোলের বলা সেই বেদ বাক্য কটি। প্রথমে ডাক্তার টাকার পিছনে ছুটবে। একদিন টাকা আর ডাক্তার পাশাপাশি চলবে, এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু যখন টাকা ডাক্তারকে তাড়া করে বেড়াবে, সে বড় ভয়ংকর। আমার বন্ধু টাকার তাড়ায় বাড়ী ঘর ছেড়ে, বিষ্ণুপুরের একটা লজে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। ঐ সময় গলায় ঝোলানো আলাটাকে ফাঁসির দড়ির মত বয়ে বেড়াতে হয় না। 10.6.2017.          আলা

 বহুদিন শুধুই চোখের ডাক্তারী করে নলের ব্যবহার প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। এমন  সময় নতুন করে একদিন উপরওয়ালার নির্দেশে গলায় নল ঝুলিয়ে ইমার্জেন্সির দিকে রওনা দিলাম। প্রথমদিনই কিনা ঠিক মনে নেই, উত্তর ভারতে মানুষ হওয়া, দিল্লিতে ডাক্তারী পড়া , মোহনা আমাকে ঐ মুর্তিতে বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে উচ্ছাস চেপে রাখতে পারল না। বলেই ফেলল, স্যার ইউ আর লুকিং স্মার্ট! এমনিতে আমার কন্যাসমা এই লেডি ডাক্তার কি বলল তাতে আমার অন্তত বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া হল না।

   পরের দিন আবার ঐ প্রসঙ্গ উঠল। এবার মোহনা জানাল যে উত্তর ভারতে এই স্টেথোস্কোপকে বলে আলা। ওখানে ডাক্তারী পড়ুয়াদের মধ্যে এই আলা নিয়ে দারুন একটা ভাবালুতা আছে। আমাদেরও ছিল। ঐ অল্প বয়সে এই যন্তরটিকে এক রকম মর্যাদার প্রতীক মনে হত। ক্রমশ জীবনটাকে বুঝতে বুঝতে এখন এমন একটা অদ্ভুত জায়গায় এসে পৌছেছি যেখানে কোন কিছুতেই আর উচ্ছাস আসে না।

   এই আলা বা এর ওজন সারা জীবন বয়ে বেড়ানোও যে কত কঠিন হয়ে যায় এক সময়, সেই গল্পই শোনাই আজ।

      কলেজে গিয়ে আলাপ হল পাঠকের সাথে। আমার বাড়ীর সবথেকে কাছে ওর গ্রাম। ওর দিদির বাড়ী আমাদের গ্রামে; অথচ ওকে কোনদিন দেখিনি। ওর দিদির বাড়ীটা আমাদের শৈশবের খেলাঘর ছিল। আমরা বৌদি বলতাম। আমার বড়দির বিয়ের আগের, সিনেমা দেখার সঙ্গিনীদের একজন ছিলেন এই বৌদি। আমাদের সাত আট বছর বয়স পর্যন্ত এই বৌদির বাড়ী ছিল গ্রামের আট দশটা বাড়ীর গোটা বারো বাচ্চার অবাধ বিচরন ক্ষেত্র। বিশেষ করে বিরাট পেয়ারা গাছটায় যখন পেয়ারা পাকত,একেবারে হনুমানের পালের মত আমরা দাপাদাপি করতাম।

      পরে এই পাঠকের বাড়ী গিয়ে দেখেছি,ওদের বাড়ীটাও অনেক ফল পাকুড়ের গাছে ঘেরা। ও ছিল ভাইদের মধ্যে সবথেকে ছোট। আমরা কলেজে পড়ার সময়ই সম্ভবত ওর বড়দা স্কুলের মাষ্টারী থেকে অবসর নেন। 

      এখন যেমন প্রায় সবকটা গ্রামেই একজন করে হাতুড়ে ডাক্তার আছে, পয়ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে তাও ছিল না। আমাদের দুজনের বাড়ীর দুরত্ব মাইল চারেক; তার প্রায় মাঝামাঝি একজন, টি টি এম পি হাতুড়ে ছিলেন। এই ডিগ্রিটা সবাই বুঝলেন না তো? ওটা হল টেনে টুনে ম্যাট্রিক পাশ।

   এই টি টি এম পি দের যে সমাজে কী ব্যাপক প্রভাব,আমরা তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই টের পেয়েছি। এখনতো এটাই একটা বিরাট আলোড়ন তুলেছে রাজ্য জুড়ে। যে সমাজে এইট ফেল পঞ্চায়েত সদস্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারকে স্যালাইন চালানোর নির্দেশ দিতে পারে,সে সমাজকে এমন টিটি এম পিরা চালনা করবে  সে আর আশ্চর্য কি! আমরা সবে একটা করে আলা কিনেছি। পাঠক হস্টেলে আসার আগে বাড়ীতে একদিন বোধহয় মোড়ক খুলে নাড়াচাড়া করছিল। হতেপারে অমন একটা যন্তর ভাইপোদের দেখিয়ে একটু সমীহ আদায় করছিল। ওর মাষ্টার মশাই বড়দা ওকে বলেছিলেন,এটা নিয়ে অধীরের কাছে চলে যা, কেমন করে চালাতে হয় শিখে আয়। ও তো একেবারে হতভম্ব। দাদার মুখের ওপর কথা বলার সংস্কৃতি তখনও সমাজে জল ভাত হয়ে যায়নি। একজন হাতুড়ের কাছে ট্রেনিং নেওয়ার বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতেই সম্ভবত ও ছুটি শেষ হওয়ার দুদিন আগেই হস্টেলে ফিরে এসেছিল।

     একজন মাষ্টার মশাইয়ের যদি এক হাতুড়ের ওপর এমন ভরসা থাকে, তাহলে সাধারন চাষাভুষার কি অবস্থা অনুমান করা যায়। তাছাড়া আমাদের মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধেও লোকজনের ধারনা কি! 

    ঐ অধীর ডাক্তরের মত বেশ কয়েকজন হাতুড়ের সাম্রাজ্যে আমার বন্ধু দাপিয়ে বেড়াচ্ছে,এমন খবর মাঝে মাঝেই পেতাম। উত্তরবঙ্গে চলে যাওয়ার পর তো যোগাযোগ আরও ক্ষীণ হয়ে গেল। একবার বোধহয় শুনেছিলাম ওর মোটরবাইক দুর্ঘটনা হয়েছিল। আবার একদিন শুনলাম ও সরকারী চাকরীতে যোগ দিয়েছে। একেবারে মোবাইল ফোনের যুগে এসে আবার যোগাযোগ হল। বাড়ীর কাছে কোথাও একটা চুক্তির ডাক্তার হিসেবে কাজ করে আর বাড়ীতে প্রাকটিশ, এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু উনপঞ্চাশ বছর বয়সে চাকরী পাকা করতে গিয়ে, তাঁতীর এঁড়ে গরু কেনা হয়েগেল।

     এই পাকা চাকরীর গুতোয় ওকে ঘরবাড়ী ছেড়ে বাঁকুড়া জেলায় চলে যেতে হল। মাঝে কয়েকবার মোবাইলে কথা হল ওর সাথে। ঘাড়ের স্পন্ডাইলোসিসের অপারেশন করতে হবে। অপারেশন হয়েছে, এ খবরও পেলাম। আমার মোষ তাড়ানোর কাজে ওদিকে যাচ্ছি, ওর সাথে দেখা হতে পারে, জানালাম ওকে। রাত্রে ওর বাসায় থাকতে বলল।

      বাঁকুড়ার কাজ সেরে বিষ্ণুপুরে এসে নামলাম সন্ধ্যের মুখে। সৌম্য মোটরবাইক নিয়ে ষ্টেশনে এসেছিল; হাসপাতালে যাওয়ার আগে বন্ধুর বাসায় বড় ব্যাগটা রেখেই চলে গেলাম। রাত্রে কি খাবো জানতে চাওয়ায় বললাম,দুটো রুটি। রাত নটা নাগাত ফিরে এলাম। পরদিন সকালে মেদিনীপুরের ট্রেন ধরবার আগে পর্যন্ত যে ঘন্টা দশেক থাকলাম,তার মধ্যে ঘুমের জন্য ঘন্টা পাঁচেক বাদে অফুরন্ত গল্প হল দুজনে। প্রায় পঁচিশ বছরের জমে থাকা গল্প। তাও ওর জীবনের কথাই শুনলাম প্রায় পুরো সময় ধরে। 

    নিজের জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরী প্রাসাদে থাকে সপ্তাহে দেড় দিন। এখানে একটা ছোট্ট লজের একটা রুম ভাড়া নেওয়া আছে, ওখানেই চলছে বছরের পর বছর। একটা বাসা বাড়ী তো ভাড়া নেওয়াই যায়; তখন আবার দুবেলা খাওয়ার সমস্যা। এখানে লজের খাওয়ারে বেশ অভ্যস্ত হয়েছে দেখলাম। 

  ডাক্তার গ্রামের মধ্যে একটা বিরাট বাড়ী বানিয়েছে, ও তো গরীবের রক্ত চোষা পয়সায়! সে আবার অক্লান্ত পরিশ্রমের কি আছে? সেই গল্পই হল গভীর রাত পর্যন্ত।

   আমি তিনদিন চেম্বার নষ্টকরে চারটে শহরে সাপের কামড় নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বাড়ী ফিরব,এটা কোন খবরই নয়। ওকে একবার চোখে দেখেই বুঝলাম, একেবারে জব্দ হয়ে গেছে। অপারেশনের পর ঘাড় একেবারে শক্ত হয়ে গেছে। বেশ ধীরে সুস্থে হাটাচলা করে।  ওকে বললাম হেড অফিসে গিয়ে তুই সাহেবদের কাছে দাঁড়ালেই তো তোকে বাড়ীর কাছে ট্রান্সফার করবে। ও উত্তরে যা জানাল, কুড়ি বছর চাকরী করেও আমার যে ঐ বোধটা হয়নি তাই ভেবে নিজেকে একটি আস্ত গাধা ভাবছি, আজও। আমি ভাবছি মানবিকতার কথা, রোবটের যে মন থাকে না তাতো ভাবিনি। ওকে বলা হয়েছে, আপনি তো উত্তরবঙ্গ করেননি, এরপর তো আপনাকে উত্তরবঙ্গে পাঠাতে হয়। 

    এবার ওকে মোক্ষম প্রশ্নটা করতেই হল। বেশ তো ছিলি, করে কম্মে খাচ্ছিলি, এই এঁড়ে গরু কেনার বদ বুদ্ধি মাথায় এল কি করে? ও যা জানাল তার মোদ্দা কথাটা হল, পালিয়ে বাঁচার জন্য। বছর কুড়ি একটা মানুষ সকাল  পাঁচটা ছটা থেকে রাত এগারোটা বারোটা পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে; পৃথিবীর আর কোন পেশায় আছে? ও বলছিল, যে কয়েক ঘন্টা বাড়ীর বাইরে, হাসপাতালে থাকে সে সময়টাই " আরাম"। একদিনের কাজ শোন, সকাল পাঁচটা থেকে একটা লোক এসে বসে আছে, মাইল পাঁচেক দক্ষিনে,তার বাড়ীতে যেতে হবে। প্রাতকৃত্য সেরে চা খাওয়ারও সময় দিতে চায় না লোকে। ডাক্তার আবার চা খাবে কেন? চলল মোটর বাইক নিয়ে। ফিরে দেখে জনা দশেক রুগী এসে গেছে। তারাতো ঘন্টা দুই বসে আছে কেউ কেউ। ডাক্তার আগে এদের না দেখে মুড়ি খাবে কেন?  ওর মধ্যে একজনের বাড়ী যেতেই হবে; পশ্চিম দিকে মাইল সাতেক দূরে তার বাড়ী। এখানের রুগী শেষ করে ঐ কল সেরে বাড়ী ফিরতে আড়াই তিনটা। ততক্ষণে আবার জনা পাঁচ সাত এসে গেছে। তাদের না দেখে ডাক্তার স্নান খাওয়া সারবে! এজন্যই তো শালারা মার খায়। বিকেল পাঁচটার দিকে দশ মাইল দূরে আর একটা কল। সন্ধ্যেয় গোটা দশেক রুগী বাড়ীতে বসে দেখা। শেষ কলটা উত্তরদিকে মাইল সাতেক দূরে দেখে ফিরতে মধ্য রাত। এমনি করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলছে। 

    একজন উকিল বা ইঞ্জিনিয়ার ছেড়েই দিলাম; একটা রাজ মিস্ত্রীও এমন পরিশ্রম করলে একটা তিনতলা বাড়ী বানাতে কত বছর লাগে? এবার মনে পড়ছে প্রনম্য শিক্ষক ডা কোলের বলা সেই বেদ বাক্য কটি। প্রথমে ডাক্তার টাকার পিছনে ছুটবে। একদিন টাকা আর ডাক্তার পাশাপাশি চলবে, এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু যখন টাকা ডাক্তারকে তাড়া করে বেড়াবে, সে বড় ভয়ংকর। আমার বন্ধু টাকার তাড়ায় বাড়ী ঘর ছেড়ে, বিষ্ণুপুরের একটা লজে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। ঐ সময় গলায় ঝোলানো আলাটাকে ফাঁসির দড়ির মত বয়ে বেড়াতে হয় না। 10.6.2017.



বিদেশে চলে গেল     

 আমার এক ভাইপো বছর আটেক আগে, একেবারে মরিয়া হয়ে বিদেশে চলে গেল। বাবা মা,জন্মভূমি সব ছেড়ে মানুষগুলি একেবারে দেশান্তরী হয়ে যায় কেন? আর,  একবার গেলে, কেউ কোনদিন ফিরেছে বলেও শুনিনি।      আমার এই ভাইপো ইঞ্জিনিয়ার। ওদেশে কিন্তু অন্য কাজ নিয়ে গিয়েছে। কয়েক মাসের বাচ্চাকে নিয়ে ওর স্ত্রী এখানেই থেকে যায়, আরও তিন বছরের উপর। ওদেশের আইনে, এদের নিয়ে যাওয়াটাও খুব সহজ ছিল না।    শেষবার ওরা সবাই চলেগেল, তাও বছর দেড়েক হবে। ভাইপো সম্ভবত কাজের চাপে থাকে, তাই বিশেষ একটা বার্তা বিনিময় হয় না। বৌমা ওখানে গিয়ে নানারকম ছবিটবি পাঠিয়েছে। ছেলের স্কুলে যাওয়ার পোশাক পরা ছবি, অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলার ছবি, যেমন সব বাবা মায়েরা করে। এ তো আমরাও করেছি সিকি শতাব্দী আগে। অবশ্য গত সহস্রাব্দের শেষ দশকেও এমন করে ডিজিটাল ক্যামেরা, মোবাইল ক্যামেরা, ইন্টারনেট,একেবারে মুড়ি মুড়কির মত পাওয়া যেত না।    এ প্রসঙ্গেই জানাই,১৯৯৯ সালে আমি রায়গঞ্জে থাকতে, একটা রিসার্চের কাজে, একটা গোদা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনেছিলাম। আমার তখনকার মাসিক বেতনের চারগুন দাম পড়েছিল। আমার এখনকার বেতনের চারগুন দামের কোন কম্পিউটার সম্ভবত এদেশে নেই। এখন আমার বেতন দিয়ে মাসে গোটা তিনেক যন্ত্র কেনা সম্ভব।  তো ঐ সময়, আমার সহকর্মিরা সব দেখতে এসেছিল, সত্যি কম্পিউটার না, খেলনা। আর ঐ যন্ত্রটির ধারন ক্ষমতা, আমার হাতের এই মোবাইলটির এক দশমাংশ। ছেলে তখন তৃতীয় শ্রেণী। আমি বন্ধুদের বলতাম, বছর পাঁচেক পর, কম্পিউটার না জানলে আর পড়াশুনা করতে পারবে না। তা, পাঁচ না হলেও, আট নয় বছর পরই  ও বস্তু একেবারে অপরিহার্য্য হয়ে গেল।        এই যে আজ আমার মনের কথা আপনাদের লিখে জানাচ্ছি, এও কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উন্নতির জন্যই। তা না হলে, বাড়ী বসে, কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসতে হত। আর আমার যা হাতের লেখা, আপনাদের বাড়ী গিয়ে পড়ে দিয়ে আসতে হত।     ঐ যে তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবের  কথা বললাম, ওর জন্যই আজ লাখ লাখ ছেলে দেশে বিদেশে কাজ কাম করে বেঁচে আছে। আমারই একেবারে চেনা জানা কতো ছেলে মেয়ে এখন বিদেশে চাকরী করছে। দেশের চাকরী বলতে তো ঐ একটাই। আমার সেই রায়গঞ্জের রিসার্চ সেন্টারের জন্য একটা সফ্‌ট ওয়ার তৈরী করেছিল, হিমাদ্রী আর ওর বন্ধু মান্না। সেই ১৯৯৯ সালেই টের পেয়েছিলাম এই কাজটি কেমন সময় নিয়ে, ধৈর্য ধরে করতে হয়।   ওরা প্রায় গোটারাত জেগে, আমার বাসা বাড়ীর বসার ঘরটায় বসে বসে কাজ করছিল। ঐ সময়, ওরা আমাকেও একটু আধটু কাজ শিখিয়েছিল। কিন্তু আমি ঐ যন্ত্রটি চালু করা আর বন্ধ করা শিখেছিলাম একজন ম্যাডামের কাছে। উনি কয়েকদিনের জন্য আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের বাড়ীতে বেড়াতে এসেছিলেন; সম্ভবত জামশেদপুর থেকে। ওনার কাছে দিন দশেকে একেবারে গোড়ার কিছু কাজ শিখলাম।   আর একজন একটু কাজ জানা লোক দিন তিনেক সন্ধ্যের দিকে চলে আসতো আমার বাড়ী, আমার নতুন যন্ত্রটি কেমন, একটু চালিয়ে দেখে নিতে।ও ছিল একজন কম বয়েসি দাঁতের ডাক্তার। ও ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিল; তাই, কমপিউটার শিখেছিল। আমার ছেলে ঐ কাকুর কাছে দু একটা কাজ শিখেছিল, আর ম্যাডাম যখন আমাকে শেখাতেন, ও, পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছে কয়েকদিন। কাজের সময় দেখলাম, আমার তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র, ছেলেই আমার থেকে বেশী কাজ শিখেছে। ওদের স্কুলে বোধ হয়, ক্লাশ নাইন থেকে কম্পিউটার শেখানো শুরু হয়। তার আগেই ও আমার প্রথম সি ডি তৈরীর কৌশল আমাকে শিখিয়েছে। এই যে আমার ছেলের দেখে দেখে কম্পিউটার শিখেফেলা, আমি এ জায়গাটাতেই আসার জন্য আপনাদের উত্তরবঙ্গ,জামশেদপুর সব ঘুরিয়ে আনলাম। ২৭.৭.২০১৭.        আমি আমাদের এখানকার শিক্ষাব্যবস্থার একটা ঘাটতির কথা প্রায়ই আমার সাপের ক্লাশে বলি। আমাদের স্কুলের ছাত্রদের, " ইব্রাহীম লোধীর বংশ তালিকা" যতোটা গুরুত্ত্ব দিয়ে পড়ানো হয়, তার এক শতাংশ সময়ও দেওয়া হয়না সাপে কামড়ালে কি করতে হবে, এ বিষয়ে।  আমি যখন  খবরের কাগজে পড়ি, স্কুলের ছাত্রি বা ছাত্র সাপের কামড়ে মারা গেল, নিজের অক্ষমতার জন্য মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা হয়। যখনই কোন অনুষ্ঠানে সাপের কামড় নিয়ে বলবার সুযোগ আসে,বিশেষ করে শিক্ষকরা থাকলে, ঐ বংশ তালিকা মুখস্ত করানোর হাস্যকর শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলি।   আমাকে বছর খানেক আগে, শিক্ষারত্ন প্রধান শিক্ষক, সুব্রত বুড়াইবাবু বলেছিলেন, অষ্টম শ্রেণীর কোন একটা সহ শিক্ষার বইতে, এ বিষয়ে কয়েকটা বাক্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই এক বছরে বহু শিক্ষকের সাথে কথা বলেছি; ঐ ব্যাপারটির কথা কেউ বলেন নি। আজ, ২৭ শে জুলাই, জাতীয় সর্পাঘাত সচেতনতা দিবসে, একজন শিক্ষক বললেন, হ্যা  একটা বইতে লিখেছে বটে। এবার আস্তে আস্তে সমে ফিরে আসা যাক। ঐ যে শুরুতে বলেছিলাম, বৌমা ছেলের ছবিটবি পাঠায়; অনেকদিন হল পাঠাচ্ছে না। শেষ যে খবরটা আমাকে চমৎকৃত করেছিল, সেটা বলি এবার। ছেলে ওদেশের স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমাদের এখানকার কে জি স্কুলের মতো হবে নিশ্চয়ই। ঐ বাচ্চা দ্বিতীয় কি তৃতীয় দিন,  স্কুল থেকে ফিরে, মা কে নানান রকম প্রশ্ন করে একেবারে নাজেহাল করে ছেড়েছে। প্রশ্নগুলি কি?  মা, বলতো আগুন লাগলে কি করবে? ভূমিকম্প হলে কি করবে? ইলেক্ট্রিক লাইনে স্পার্ক দেখলে কি করবে?    এবার আমার প্রশ্ন, আপনি নিজে এ প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর জানেন কি? জানলেও বাচ্চাদের বলেছেন কখনও? আপনার বাড়ীতে দশম কিংবা একাদশের কেউ থাকলে তাকে প্রশ্নগুলি একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন তো, উত্তর ঠিকঠাক দিল কি? আসলে আমাদের কাছে এসব একেবারে ফালতু ব্যাপার। স্কুলে বা অফিসে কোনদিন আগুন লেগে দু চারজন মরলে তখন তো দমকল দপ্তর ফায়ার ড্রিল করাবেই। এর থেকে গোটা কয়েক নার্শারী রাইম মুখস্ত করানো অনেক বেশী জরুরী।    আমার সাপের ক্লাশে পরশুদিন একটি দশম শ্রেণীর ছাত্রী এসেছিল। তিরিশজন ডাক্তারবাবুর পিছনে বসে,দেড় ঘন্টা শুনল মেয়েটি। ওকে এমন একটা ক্লাশে বসতে দেওয়া যায় কিনা, অনুমতির জন্য  ডিরেক্টর স্যারের ঘরে নিয়ে গেলাম, ওকে আর ওর বাবাকে। এমন কম বয়সে,ওর এমন একটা বিষয়ে  আগ্রহ হল কি করে জানতে চাইলেন স্যার। উত্তরটা ওর বাবা বললেন, কারন মেয়েটি বাংলা বুঝলেও, বলতে প্রায় পারছিলই না। আর ইংরেজী? আজ আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় টের পেলাম, কাকে বলে "ম্যারিক্যান ইংলিশ"! আমি স্যারের সাথে ওর পরিচয় করানোর সময় বললাম, স্যার, একটি প্রবাসী মেয়ে এসেছে, আমার ক্লাশ শুনতে। নাতনির মত মেয়েটি সাপের ক্লাশ শুনতে চায়, এই কথাটার ধাক্কা সামলাতে সামলাতে স্যার যখন জানতে  চাইলেন, প্রবাস মানে কোথায়? উত্তরটা শুনলাম, "এমে ঠেন্‌থ ক্লশ স্ঠুড্‌ন্ট আফ ক্যলাপোর্নীয়া"। স্যার তো একেবারে হৈ হৈ করে উঠলেন। মেয়েটির বাবা,মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে, খড়্গপুর আই আই টি থেকে এম টেক করেছেন। তার পর চাকরী করতে ওদেশে গিয়ে আর ফিরতে পারেন নি। আমরা ভেতো বাঙালী দুটি ডাক্তার, ওনার মেয়ের কথা যে আশি ভাগই বুঝবো না,ভালোই জানেন। তাই মেয়ের, সাপের কামড়ে আগ্রহের কারনটা নিজেই জানালেন। মেয়ে পর পর কয়েক বছর মায়ের সাথে বর্ধমানের  গ্রামে, মামা বাড়ী এসেছে। প্রতিবারই এসে শুনেছে, দু চারটে লোক সাপের কামড়ে মরেছে। ওর মাথায় এর থেকেই প্রশ্ন ঘুর ঘুর করছে; এদেশে এতো লোক সাপের কামড়ে মরে কেন? এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে ও তাই এদেশে চলে এসেছে, এর ওপর একটা তথ্য চিত্র করার জন্য।   যারা নার্শারী থেকে ভূমিকম্পে বাঁচার উপায় শিক্ষা পায় তাদের কাছে এটাই বোধহয় স্বাভাবিক। স্যার ওর বাবাকে বলছিলেন,আপনারা দেশে না থেকে, সব বিদেশে চলে যান কেন? ভদ্রলোক, স্যারের মর্যাদা রেখে,যতোটুকু ভদ্রতা দেখানো সম্ভব দেখিয়ে, নিজের মত উত্তর দিয়েছেন।  আমি কিন্তু ঐ এক নার্শারীর বাচ্চার, মাকে করা প্রশ্ন, আর এই দশম মানের ছাত্রির, এবারের এদেশে দৌড়ে আসার কারন, এ দুটি জিনিস থেকেই বুঝে গেছি, শিক্ষিত মানুষগুলি একবার গেলে, আর ফেরে না কেন।   আমার গত দশ বছরের কাজে দেখেছি; এ দেশের ডাক্তারীর ছাত্র, ডাক্তার, শিক্ষক ডাক্তার, শিক্ষক, প্রশাসক, কারুরই কোন বিকার হয়না; যখন আমি বলি, এদেশে বছরে পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারা যায় সাপের কামড়ে। কেনই বা হবে। কলকাতার রাস্তায়, প্রকাশ্য দিবালোকে, জনা পনের মানুষকে পুড়িয়ে মারা হলে, আমাদের মাননীয় মূখ্যমন্ত্রী, "ও রকম তো কতোই হয়", বলে, ডুয়ার্সের জঙ্গলে বেড়াতে চলে গেলেন। আর এই যে পঞ্চাশ হাজার লোক সাপের কামড়ে মারা যায়, এরা তো চাষা ভুষা প্রান্তিক মানুষ।আট বছর আগে এটা লিখেছিলাম। আপনারা কেউ কেউ হয়তো পড়েছিলেন। এবংভূলেও গেছেন।আজ আমার পুরনো স্কুলের বন্ধু কয়েকজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষের আলোচনায়, এই ধরনের, দেশে শিক্ষিত ছেলেদের বিদেশে চলে যাওয়া নিয়েই কথা হচ্ছিল। ছাব্বিশ হাজারবার ভেবেও কি আমরা উচ্চ শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের বিদেশে চলে যাওয়া আটকাতে পারব!!!

 

 




       নাগকেশর  

 নাগরাজু নামটা দেখেই ভাষাবিদ, ডা পাত্র আমাকে একটি নাগকেশর গাছের ছবি পাঠিয়েছেন। উনি নাগ শব্দের নানান অর্থ ইত্যাদি লিখেছেন। কিন্তু ঐ নাগকেশর গাছের সাথেই যে আমার একটা সুন্দর স্মৃতি যুক্ত হয়ে আছে, সে খবর ওনার জানার কথা নয়। ডা পাত্র যে নাগ পদবির কথা জানিয়েছেন, সেটা কিন্তু আমার কাছে অন্তত নতুন কিছু নয়। 

      আমার জ্ঞান হওয়া থেকেই জানি, জামাইবাবুর নাম শ্যাম নাগ। তখন অবশ্য মেদিনীপুরের উচ্চারনে ওটাকে লাগ জানতাম। পরে যখন আমার সমবয়সি ভাগ্নে আমাদের গ্রামের স্কুলে পড়তে এল, তখন থেকেই ওটা যে নাগ, সেটা জেনে গেছি। কেশব নাগের অংকের বই পড়েনি, এমন বাঙালী পাওয়া মুশকিল। কলেজে গিয়ে পেলাম, আমাদের ক্লাশেই এক নাগরাজ পদবি। অবশ্য ওটা আমার নাগরাজুর মতই দক্ষিনভারতীয় পদবি। 

     এই সেদিন জানলাম, রামকুষ্ণ ভক্ত, সাধু নাগ মহাশয়ের কথা। এটা অবশ্যই আমার অজ্ঞতা। বাংলার সাধক মহলে এ নামে যে একটা বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন, এটা জানলে বেচারা ভাগ্নেটা ছোটবেলায় অনেক হেনস্তা থেকে বেঁচে যেত। বাবা লোকনাথ প্রসঙ্গে কথা উঠতেই ভ্রাতৃপ্রতীম ডা কমলেন্দু,সাধু নাগ মহশয়ের কথা বলল। “জানিনা” বলাতে বিরক্তই হল। পরে পড়ে জানলাম, সত্যিই তো কত কিই আমরা জানিনা। এই সত্যটা আজকাল বেশ বুঝতে পারছি। আমরা পড়াশুনা করি, কতো কম জানি, সেটা বোঝার জন্যই। এই জন্যই জ্ঞান মানুষকে ক্রমশ মৌন করে দেয়।

    আমরা অল্পবিদ্যা মানুষ, তাই একটু জেনেই নিজের পান্ডিত্য জাহির করতে শুরু করি। এই যেমন, শ্রদ্ধেয় নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয়ের লেখা পড়ে জেনেছি; মহাভারতের কালীয় বা তক্ষক, কেউই সাপ ছিলেন না। সবই নাগ উপজাতীর নেতা বা রাজা। অনার্য উপজাতীয়দের এভাবেই প্রতিষ্ঠিত ক্ষত্রিয় রাজারা নাগ, ভল্লুক, হনুমান এসব বলে অবজ্ঞা প্রকাশ করতেন। 

     সাপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বহু লোক তক্ষক বললে ভয়ংকর বিষধর সাপ বলেই জানে। এগুলি কিন্তু একেবারেই বিষহীণ গিরগিটি জাতীয় প্রাণী। আমাদের পুরনো উপকথাগুলি সাহিত্য হিসেবে খুবই উৎকৃষ্ট। কিন্তু অর্ধশিক্ষিত কথক ঠাকুরদের হাতে পড়ে ওসব মঙ্গলকাব্য, মাতলার জলে মান্দাসে ভেসে গেল।

     না, ডা পাত্রর নাগকেশর গাছের কাছেই ফিরে আসা যাক। আমাদের পাশের গ্রামে একজন আচার্যি মশাই ছিলেন। নানান কাজে পারদর্শি ছিলেন। উনি একদিন রাস্তায় কাউকে ধমকে সতীর একান্ন পীঠের একটা স্তোত্র শোনাচ্ছিলেন। ওরে বাবা, ভদ্র মশাইয়ের চন্ডী পাঠের মত উদাত্ত কন্ঠে একনাগাড়ে বলে গেলেন। আমরা অবাক হয়ে শুনলাম।  ওনার বাড়ীতে নানা রকম গাছ ছিল। হিং গাছ ওনার বাড়ীতেই দেখেছি। ওনার একটা মাঝারি মাপের নাগকেশর গাছ ছিল। ডা পাত্র লিখেছেন, নাগলিঙ্গও বলা হয়। 

    মুম্বইতে একবার একটা মেডিক্যাল কলেজের চত্তরে বেশ কটা নাগকেশর গাছ দেখেছিলাম। সে সব একেবারে আকাশ ছোওয়া মহিরুহ। বড়বড় মেটে রঙের গোল বলের মত ফল পড়ে ছড়িয়ে ছিল। ঝাড়ুদার ঝাঁট দিচ্ছিল। ওসব ফল কি কাজে লাগে জানতে চাইলে বলল, কোন কাজেই লাগেনা, ক্যাচড়ার মধ্যে ফেলে দিই।

     মুম্বই থেকে ফিরে চিকু একবছর একটা কে জি স্কুলে পড়ল। আমার হাসপাতালের সুপার, ডা বিশ্বাস একদিন বললেন, সরকারী স্কুলে তোর ছেলের মত ট্রান্সফার হওয়ার ক্ষেত্রে, ছেলের ভর্তির কিছু একটা সুবিধা আছে। চল, হেডমাষ্টারের সাথে কথা বলে আসি। হেড স্যার তো সুপার স্যারকে বসিয়ে চা ও খাওয়ালেন। ছেলের ভর্তির ব্যাপারে বললেন, ঠিক আছে, সুস্থ হয়ে আসুক। পরে যখন গেলাম, আর চিনতে পারলেন না। বিচিত্র সব বাহানা দেখালেন। অত্যন্ত অপমানিত হয়ে ফিরে এলাম। ভাগ্যিস ঐ সময় সুপার অসুস্থ হয়ে ছুটিতে ছিলেন। পরে শুনে উনিও অবাক হয়েছিলেন।

      এরপর কিন্তু ছেলের জন্য আর কোনদিন কারুর কাছে সুবিধা চাইতে হয়নি। ব্যারাকপুর মিশনও খুব  নামকরা স্কুল। পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য হাজার খানেক ছাত্র পরীক্ষা দিল। আমার আগের রাত্রে নাইট ডিউটি ছিল। ছেলেকে নিয়ে যখন সাত নম্বরে পৌছলাম, দুর্গাপূজার মত ভীড় পিলপিল করছে। এই সাত নম্বর ওদের প্রধান কার্যালয়। ওদের একত্রিশ, কুড়ি আর বোধহয় বিয়াল্লিশ নম্বরেও স্কুল ছিল। তাছাড়া তৃতীয় শ্রেণীরও ভর্তির পরীক্ষা একসাথে হওয়ায় ওদের স্কুল চত্তরে তিল ধারনের জায়গা ছিল না। 

   সামিয়ানা টাঙানো হলেও এত লোকের বসার জায়গা পাওয়াও সমস্যা। আমি ব্যাগে ভরে পুরনো খবরের কাগজ নিয়ে গেছলাম। একটু পিছন দিকে, গঙ্গার পাড়ে একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় কাগজ পেতে বসে গেলাম। ঐ ঝাঁকড়া গাছটা ছিল একটা নাগকেশর গাছ। 

     সারা রাত হাসপাতালে জেগে পরদিন শরীর আর টানছিল না। এক সময় কাগজ পেতে শুয়েই পড়লাম। ঘন্টাদুই বোধহয় নাগকেশরের ছায়ায় শুয়ে ছিলাম। মনে আছে, পরীক্ষা শেষে বাচ্চাদের বেরনোর সময়টা। একটা করে বাচ্চা বেরচ্ছে আর শিক্ষকরা তুলে তুলে দেখাচ্ছেন। অভিভাবকরা, আমার বাচ্চা বললে তবেই বাচ্চাকে বেরতে দিচ্ছেন। আমি ডেকে বললাম, ঐ যে ন্যাড়া মাথা আমার ছেলে। কদিন পর রেজাল্ট বেরল; ওর পার্থকাকু রেজাল্ট দেখে জানাল,সেই ন্যাড়া মাথাই পঁয়ত্রিশ নম্বরে আছে। 

 এরপর যখনই ঐ সাতনম্বরে গিয়েছি, গঙ্গার পাড়ের নাগ কেশর গাছের কাছে গিয়ে ওনাকে দেখে এসেছি। মহারাজকে প্রনাম করার কথা কখনই মনে হয়নি। 

    বৃক্ষই তো সত্যিকারের পূজনীয় দেবতা। ওনার কাছে ভক্ত অভক্ত, আস্তিক নাস্তিক সব সমান। সবার মাথায় ছায়া, আর পরম আশ্রয় প্রাণবায়ু দান করে যাচ্ছেন অকাতরে। কে ওনাকে রোপন করেছেন, কে শৈশবে প্রতিপালন করেছেন, সকলেই চলেগেছেন সাধনোচিত ধামে। উনি দাঁড়িয়ে আছেন সাক্ষী চৈতন্যের মত। আমাদের সকল অত্যাচার অনাচারের উর্দ্ধে, আমাদের কাছে ওনার কোন আকাঙ্খাও নেই।  ২.৭.২০১৭.

 

 

 



                আদালতে  নিধিরাম সর্দার

      স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবু যে নিধিরাম সর্দার তার একটা গল্প কদিন আগেই বলেছি। আজ ঐ নিধিরাম সর্দারদের আর একটা দিক নিয়ে কিছু বলি। গ্রামের ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তারবাবু দের যে কতো বিচিত্র কাজ করতে হয়, সাধারন মানুষ কেন, অসাধারণ কিছু কিছু মানুষও তার খবর রাখেন না। জেলা শহর এর হাসপাতাল ,এমনকি মহকুমা হাসপাতালে ও বেশ কিছু বিশেষজ্ঞের থাকার কথা। কিন্তু দু’একটা ব্যতিক্রমী জায়গা ছাড়া ব্লকের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশেষজ্ঞ থাকেন না। বিশেষ রুগীর চিকিৎসার প্রয়োজন হলে জেলা বা অন্য বড় হাসপাতালে পাঠানো হয়। রুগীর বাড়ীর লোকেরা সেটা বুঝতেও পারেন। কিন্তু কয়েকটি আইনি জটিলতার ডাক্তারী পরীক্ষা ঐ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবুকেই করতে হয়। আর যেহেতু এই ব্লকের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থানার কাছেই থাকে, পুলিশও ওসব কেশ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই আনে। বিশেষ করে ধর্ষনের ক্ষেত্রে বোধহয় সর্বোচ্চ আদালতের রায় আছে, সবথেকে কাছের হাসপাতালে যে ডাক্তারবাবুই থাকুন, তাকে পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিতেই হবে।

         এমন এক দুটি কেশ দু চার মাসে এসেই পড়ে। সত্যি কথা বলতে কি, ডাক্তারী পড়ার সময় ধর্ষণ নিয়ে কয়েকটা ক্লাশে পড়ানোও হয়। এ এমন একটা বিষয় যেখানে রুগী দেখে শেখার সুযোগ প্রায় নেই। আর ডাক্তারী বইতে ধর্ষনের যে সংজ্ঞা লেখা আছে, তার মূল কথাটাই হল, " অনিচ্ছা সত্বেও জোর করে যৌন সংসর্গ"। এবার মুশকিল হল , পরীক্ষা করে যৌ্ন মিলন হয়েছে কিনা বলা যায়, কিন্তু সেটা ইচ্ছাকৃত না জো্রকরে , সেটা বলাটা প্রায় অসম্ভব।

          সে গেল একটা দিক। এবার ধর্ষনের শিকার মহিলার বয়স কত ছিল, ঐ দিন , সেটা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো দিয়ে বলা যায় না। তার জন্য উচ্চতর হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারপর আছে , দুজনের সম্মতিতে যৌনমিলনের পর, মহিলা যদি বলেন, ভুল বুঝিয়ে কাজটা করা হয়েছে ; সেটা ডাক্তারী পরীক্ষা বা বুদ্ধিতে কি করে প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা যায়, আমার অন্তত জানা নেই।

  আজকাল একটা মেডিক্যাল কলেজে কাজ করার সুবাদে এই সব সমস্যায় আর পড়তে হয় না। পুলিশ প্রায়ই এসব কেশ নিয়ে আসে। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজে সব রকমের বিশেষজ্ঞ থাকেন , তাই তাঁদের কাজটা তাঁরাই করেন। তাছাড়া রিপোর্ট লেখার জন্য নির্দিষ্ট ছাপানো ফর্ম আছে। জানিনা এখনও ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওসব ছাপানো ফর্ম এসেছে কি না। একই বিচারকের কাছে আজ একটা সুন্দর ছাপানো ফর্মে , একজন মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক বা বিশেষজ্ঞ-এর লেখা রিপোর্ট নিয়ে বিচার হল। কালই যদি একটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাদা কাগজে লেখা একটা রিপোর্ট নিয়ে একজন মেডিক্যাল অফিসার হাজির হন, বিচারক বিরক্ত হতেই পারেন।

      এবার এক নিধিরাম সর্দার-এর অভিজ্ঞতার কথা বলি। রাত দশটার পর পুলিশ একটি ছেলের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে এল। একই গাড়িতে ধর্ষনের শিকার মেয়েটিকেও। আমাদের সেই স্পেশাল এক্সামিনেশন রুম, মানে ডেলিভারীর ঘরে মেয়েটিকে নিয়ে গেলেন সিস্টার। সিস্টার-এর কাছে , আমি যাওয়ার আগেই মেয়েটি বলেছে যে, যৌনমিলন হয়েছে। পুলিশের অনুরোধে, আমাদের একটা জীবানুমুক্ত ইনজেকশনের ভায়ালে, ভেজাইনাল সোয়াব নিয়ে, লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে বন্ধ করে, পুলিশকেই দিলাম। ঐ মহার্ঘ বস্তুটি ওনারা কোথায় পাঠাবেন, বা কি করলেন সে সব নিয়ে কোন চিন্তা মাথায়ই আসেনি। আজকাল ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে একটা করে ল্যাবরেটরি হয়েছে, তখন ওসব আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। অবশ্য এখনও ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ল্যাবরেটরিতে ঐ বিশেষ সোয়াবটি পরীক্ষা করা সম্ভব কিনা আমি জানিনা।

    মেয়েটির রিপোর্টে তো লেখা হল, যৌনমিলন হয়েছে। কিন্তু ছেলেটিকে নিয়ে কি করতে হবে , আমার অন্তত জানা ছিল না তখন। যতোদূর মনে পড়ছে, ছেলেটি যৌনমিলনে সক্ষম কিনা সেটাই পুলিশ জানতে চেয়েছিল। 

  এখানেই শুরু হল , ডাক্তারী ছেড়ে গোয়েন্দাগিরি। না, ঠিক বললাম না। কাজটা করতে হয়েছিল, সমাজবিজ্ঞানীর।

       ছেলেটির বয়স বাইশ-তেইশ বছর হবে। ওর সামনেই পুলিশের সাথে কথা বলছিলাম। আমরা কি জানতে চাই, ছেলেটি ভালই বুঝেছে। আমার বসার ঘরে ওকে রেখে পুলিশকে একটু বাইরে দাঁড়াতে বললাম। এবার ছেলেটি বলল, “আমাদের মধ্যে এমন যৌনমিলন মাঝে মাঝেই হয়। মেয়েটি নিজেই আমাকে দরজা খুলে গোপনে ঘরে ঢুকিয়ে নেয়। আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা কিছুদিন থেকেই চলছে। আমার শ্বশুর লোকটা ভালো নয়। আমার বাবাকে বলেছে, মেয়ের নামে দু’বিঘা জমি লিখে দিতে হবে। আমার বাবা রাজী না হওয়ায় , আজ আমাকে এভাবে ফাসালো।“ এ তো খুবই সহজ অংক। আমার লেখার কথা , ছেলেটি যৌনমিলনে সক্ষম কি না। লিখে দিলাম। আমার কাজ শেষ।

      না, এসব কাজ এত সহজে শেষ হয়ে যায় না। কথায় বলে, পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা। আমি তো একদিন পূর্বজন্মের পূণ্য ফলে, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের থেকে জেলা হাসপাতালে উঠে এলাম। তারপর আরও কত নিধিরাম সর্দার এসব ঝক্কি সামলে চলেছে। 

  আমার “ডাক্তারবাবু কোর্টে গিয়েছেন” আর “আদালতে ডাক্তারবাবু” নিবন্ধ দুটিতে একটু আভাস দিয়েছি। ঐ ঘটনার বছর ছয়-সাত পরে , আমার ডাক পড়ল, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার। আমার চোখের আউটডোর একদিন বন্ধ রেখে ( শ’খানেক লোকের শাপ শাপান্ত তো ডাক্তার পাবেই), একদিন জনা পাঁচেক রুগীর চোখের অপারেশন বাতিল করে, চললাম চারশো কিলোমিটার দূরের আদালতে সাক্ষী দিতে। নিজের কাজ, নিজের রাত জেগে ট্রেনের স্লিপার ক্লাশে যাওয়া , এসব বলতে নেই। সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় তোমার ওসব প্যানপ্যানানি বাবার ডোবা পুকুরে ছুঁড়ে দিয়ে আসতে হবে।

    নিমন্ত্রন পত্রে যেমন লেখা থাকে, ঠিক সকাল দশটায় আদালতে হাজির হয়ে, সরকারী উকিল বাবুকে খুঁজে বের করে , এক তাড়া কাগজের ভেতর, ছয় বছর আগে নিজের হাতে লেখা মহার্ঘ কাগজ চোখে দেখে, এটুকু অন্তত বুঝলাম; আমার প্রারব্ধ ফল ভোগ করার জন্য এসেছি। চারশ কি মি রাত জেগে গিয়ে অন্তত শুনে আসতে হবে না, " সেকি , আপনি এ রুগী দেখেন নি?"  মারামারি,হাতাহাতি রুগীর মামলায় সাক্ষী দিতে আগে কয়েকবার গেলেও, এরকম , যাকে বলে " রেপ কেসে" সাক্ষী দিতে কোনদিন যাইনি। আমার কি কাজ করা উচিত ছিল , কি করতে পারিনি, এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি আমাদের পুরাতন সুপার স্যারও কোর্টে এসেছেন। বস্তুত জেলা হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত ঐ সুপার স্যার বিগত বছর কুড়ি ধরে এত অসংখ্য শব ব্যবচ্ছেদ করেছেন যে , আমৃত্যু প্রতিদিনই আদালতে আসতে হত ওনাকে। স্যারকে দেখেই কুশল বিনিময় করার পরই জানতে চাইলাম, ঐ “রেপ কেসে” ছেলেটির ক্ষেত্রে আমার কি কি করনীয় ছিল, এবং ইত্যাদি। 

  ঐদিন তো আমি “ লাষ্ট মিনিট সাজেশান” দেওয়ার লোক পেয়ে গেলাম । কিন্তু আজও , এ রাজ্যের কোন না কোন আদালতে , এরকম কোন না কোন নিধিরাম সর্দার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বিব্রত হচ্ছেন। আমার ঐ প্রত্যন্ত জেলা হাসপাতালেও মাসে তিন –চারটি “ বিরিয়ানী সেমিনার “ হত। কত বড় বড় অসুখ নিয়ে কত বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা হত। একদিনও কারও মাথায় আসেনি , সুপার স্যারকে বক্তা করে , ওনার বিপুল অভিজ্ঞতার কথা শোনা হোক। বিরিয়ানী সেমিনারটা কি জিনিস? এই  “ বিরিয়ানী সেমিনার “ নামটি আমি শুনেছিলাম , ভেলোরের একটা কর্মশালা থেকে ফেরার পথে , বাংলা দেশের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, মোহাম্মদ আবুল ফৈজ স্যারের কাছে। আসলে সুপার স্যারের মত বিপুল অভিজ্ঞ মানুষদের সেমিনারে বলতে না বলার কারনটাও কিন্তু ঐ “ বিরিয়ানী” নামকরনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। অলমতি বিস্তারেন! আমরা সাপের কামড় নিয়ে আয়োজিত বেশ কয়েকটা কর্মশালায় , ডাক্তারী শিক্ষার এই বিশেষ বিষয়ের প্রখ্যাত শিক্ষকদের বক্তা হিসেবে নিমন্ত্রন করেছি। তাতেকরে ঐসব কর্মশালায় যোগ দেওয়া লোকজন একটা জিনিস পরিস্কার বুঝেছি; “ সাপের বিষে মৃত্যু আর সাপের কামড়ে মৃত্যু” কথা দুটি এক নয়। 

  এসব নিয়ে এখানে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই। আজ শুধু ঐ একটি দিনের কথাই বলি। আদালতের দর্শকাসনের বেঞ্চে আমি আর সুপার স্যার পাশাপাশি বসে নিচু গলয় কথা বলছিলাম। চোখ ছিল বিচারক আর সাক্ষীর কাঠগড়ার দিকে। বিচারক বেশ বয়স্ক, রাশভারী চেহারার মানুষ। হঠাৎ খেয়াল করলাম, সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একটি লুঙ্গিপরা লোক দাঁত বেরকরে ফাজিলের মত কি যেন বলছে। ওখানে দাঁড়িয়ে কেউ ওভাবে দাঁত বেরকরে কথা বলতে পারে , আমার কল্পনায়ও ছিলনা। তাই এবার ওদিকে কান খাড়া করলাম। লোকটি বলল, “ কি যে আপনারা বিচার কইরছেন, আর আমাদেরকেই বা শুধুমুধু ডেইকে আইনছেন। ওদের বিয়া হইয়ে গ্যাছে, দুটা বাচ্চা হইছে। আর কি কইরবেন?” ওর পরেই আমাকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হল। 

  আমার ঠিক আগেই ওরকম একটা সাক্ষীকে দেখার পর জজ সাহেবের মেজাজ যে বিগড়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। ডাক্তারের সাক্ষী ব্যাপারটা নিয়ম মেনে , নাম কি? বাবার নাম কি? এখন কোথায় আছেন? ঘটনার তারিখ বলে, ঐ দিন কোথায় কি পদে ছিলেন? এসব দিয়েই শুরু হল। তারপর, কি দেখেছিলেন? একেবারেই মাছিমারা কেরানীর মত, নিজের লেখা রিপোর্ট পড়ে যাওয়া ; এই তো কাজ। সেই যে কাঁচের ভায়ালে সোয়াব নেওয়া; সেই কথাটি শুনেই জজ সাহেব জানতে চাইলেন , তারপর ওটা কি করলেন? পুলিশকে দিয়েছি বলতেই , ধমকে উঠলেন! কিন্তু ওটা নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিধিরাম সর্দার মশাইয়ের কি করা উচিত , বা ওটার গন্তব্য কি , এসব নিয়ে কিছু বললেন না। সেই বছর বাইশ -তেইশ আগে একবারই ঐ দায়িত্বটি পালন করতে হয়েছিল। আর জজ সাহেবের ধমক খাওয়ার পরও  ষোল আঠার বছর কেটে গেছে। সেদিন , সাক্ষ্য শেষ হওয়ার পর আর সুপার স্যারের সাথে দেখাও হয় নি। ঐ মহার্ঘ কাঁচের শিশিটি নিয়ে কি করা উচিত ,আর জানা হয় নি। আজকের নিধিরাম সর্দারদের কেউ জানেন কি না আমি জানিনা। 

   আমি এই বিষয়ে লিখছি জেনে আমার এক বন্ধু বলেছে, রায় কি হল সেটা জানতে পারলে অবশ্যই জানাবেন। না, রায় কি হল আর জানা হয়নি। কিন্তু আমার মত যে কজন লোক ঐ মামলার সাথে যুক্ত হয়েছি , সকলেই ঐ দিনই জেনে গেলাম, " মিয়া বিবি রাজী"! কিন্তু কাজী কেয়া করেগা? তাতো দেশের আইন মেনেই হবে। ওরকম ডজন ডজন নিধিরাম সর্দার রোজ রোজ  আদালতের ধমক খেয়ে আসছে। এদিকে ওদের হাসপাতালে এসে যে শত শত রুগী , গ্রাম গঞ্জের থেকে এসে ডাক্তার নেই শুনে , শাপ শাপান্ত করে ফিরে গেল, তাদের কথাও কেউ কোনদিন ভাবেন নি। টেকনোলজির এত ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। করোনা অতিমারীর সময় এত জরুরী কাজ " ওয়ার্ক ফ্রম হোম" করে করা যাচ্ছে। জাতীয় স্তরের, আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে , কত বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে; চারশ পাঁচশ মাইল দূরের হাসপাতালের ডাক্তারদের সাক্ষ্য গ্রহণ কি ভিডিও কনফারেন্সিং করে নেওয়া যায় না? সব বড় হাসপাতালে আর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের আপিসে এখন অনলাইন মিটিং এর ব্যবস্থা আছে। নীতি নির্ধরকরা এবার একটু ভাবুন।.

 

 



                   তরমুজ এক রসাল ফল   

         বেশ মাস দুই ধরে চলা ভোটের আঁচ এবার একটু একটু করে কমবে আশা করছি। দিল্লির গণ সৎকারের চিতার আগুন আরও কতোদিন চলবে জানিনা। আমার মত যারা একটু আধটু লিখে সময় কাটাই, তাদের হয়েছে বিপদ। এই যেমন দুদিন আগেই, আমাদের ডাক্তারদের সংগঠনের একটা বড় গ্রুপে, সামান্য একটা খবর বা তথ্য লিখতে গিয়ে, বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে , লিখতে বাধ্য হলাম, " এখন তো জোরে বাতকর্ম করলেও তাই নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে যায়!" ভোট শেষ হওয়ার পরও একটা সামান্য ফল নিয়ে লিখতে গিয়ে, এতটা গৌর চন্দ্রিকা করতে হল ; এর কারন, এই ফলটার দুর্ভাগ্য যে, এর নামটাই এক সময়ে একটা রাজনৈতিক গালাগালিতে পরিণত হয়েছিল। এখন অবশ্য সেই গালাগালির কৌলীন্য গিয়েছে। তার জায়গা দখল করেছে একটা সবজি। এই তরমুজ নিয়ে বেশ কিছু কথা আছে , প্রয়াত সাহিত্যিক অতিন বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের কালজয়ী উপন্যাস, " নীল কণ্ঠ পাখির খোঁজে" তে। নদীর চরে ঈশম দাদা তরমুজ চাষ করতো। এক একটা তরমুজ এক মন পর্যন্ত ওজন হতো, লিখেছেন , অতীন বাবু। অত বড় তরমুজ আমি কোনোদিন দেখিনি।

       কলকাতার পার্ক সার্কাস অঞ্চলে প্রচুর তরমুজ বিক্রী হয়। গত দশ বারো বছর ধরে দেখছি, গ্রীষ্ম কালে বড় বড় ট্রাকে করে তরমুজ আসে। আগে গোল তরমুজ ই বেশী দেখা যেত। এখন দেখছি গোল তরমুজ আর দেখাই যায় না; প্রায় সবই শিব লিঙ্গের মত লম্বাটে। প্রথম দিকে ওরা বলত, লম্বা গুলি তামিনাড়ুতে হয়। কয়েক বছর থেকেই দেখছি এই শিব লিঙ্গের আকার এর কালচে সবুজ তরমুজের সাথে সাথে, সবুজ হলুদ ডোরা কাটা তরমুজও অনেক পাওয়া যাচ্ছে। এই ডোরা কাটা তরমুজগুলি সাধারণত বেশ বড় হয়। পাঁচ কেজির কম ওজনের দেখাই যায় না। এক একটা তো দশ কেজিও হতে পারে। কিন্তু, অতীনবাবুর সেই একমনি তরমুজ আমি আজও দেখিনি।

        মেদিনীপুরের গ্রামের বাড়িতে থাকতে কোনদিন তরমুজ দেখিনি। ওদিকে কোথাও তরমুজের চাষ হয় বলে আজও শুনিনি। এবার ফাল্গুনের শেষে বা চৈত্রের প্রথমে , পার্ক সার্কাস এর এক ফল বিক্রেতা বলেছিল, উড়িষ্যা থেকে আসে এই তরমুজ। উড়িষ্যা থেকে এলে তো মেদিনীপুর আরও কাছে হচ্ছে। জানিনা এখন মেদিনীপুরেও প্রচুর তরমুজ বিক্রী হয় কি না। কয়েক বছর আগেও আমার ধারণা ছিল, শিব লিঙ্গের মত লম্বাটে তরমুজের ভেতরটা লাল হবেই। গোল তরমুজের ভেতরটা কাটলে কেমন হবে, সেটা ভাগ্যের ব্যাপার। ফলওয়ালারা দু -একটা কায়দার কথা বলত, যাতে করে নাকি বোঝা যায়, ভেতরটা পাকা অর্থাৎ টকটকে লাল রঙের হবে কি না। প্রায়ই দেখেছি ওদের বলা মত হয়নি ভেতরটা । কাটলে বেশীর ভাগই ভেতরে সাদা বেরিয়েছে। এই গতকালই যেমন হল আরকি! বড় বড় পণ্ডিতকে বোকা বানিয়ে, ভোট বাক্সো খুলে দেখা গেল, একেবারে অন্য রং। ভোট বাক্সে " সাইন্টিফিক রিগিং" , কথাটা প্রয়াত সাংবাদিক বরুনবাবু বহুবার বলেছেন বটে; কিন্তু কেউ তো প্রমাণ করতে পারেননি। কিন্তু তরমুজের ভেতরটা কেমন করে ঐ রকম রিগিং করে টকটকে লাল করা যায়, একদিন আমি দেখেছি। সম্ভবত স্যাকারিন মেশানো লাল রং, ইঞ্জেকশন -এর বড় সিরিঞ্জ- এ ভরে, তরমুজের ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে। তারপর থেকে , ভেতরটা টকটকে লাল তরমুজ দেখলেই আমার কেন যেন ঐ " সাইন্টিফিক" কথাটা মনে পড়ে।

  গত বছর আমার কন্যা কোথা থেকে একটা নতুন রান্নার কায়দা , মানে যেটাকে ইংরেজীতে রেসিপি বলে, শিখেছে। বাস্তবে তরমুজের ভেতরের লাল অংশটা বাদ দিলে প্রায় অর্ধেকই ফেলে দিতে হয়। গরুতে খায় কি না জানিনা। ঐ ফেলে দেওয়া অংশের সাদা জিনিস টি দিয়ে সুস্বাদু বড়া ভাজা যায়। না, এটা কিন্তু আমার সেই ' পেরেকের চাটনি' নয়। সাধারণ ঘরোয়া জিনিস , মশলাপাতি দিয়েই রান্না করা যায়। এই তরমুজের বড়া ভাজা ব্যাপারটা আমাকে অনেকটা চিন্তা মুক্ত করেছে। এখন আর তরমুজ কেনার সময়, ভেতরটা বেশ লাল রঙের হবে কি না, তাই নিয়ে ভাবি না। পুরোটা লাল না হলেও বাকিটা তো রান্না করা যাবে। আচ্ছা, ভোটের বাক্স খোলার আগেও যদি আমরা এরকম চিন্তা মুক্ত থাকতে পারতাম। আমার পছন্দের দল বেশী আসন না পেলেও, ভোট মিটে যাওয়ার পর, জয়ী পরাজিত সব দলই যদি জনগণের ভালোর জন্যই ভাবতো! 

    বাইরের বেশ কিছু শহরে নানান রকম হোটেলে থাকার সময় দেখেছি, সকালের কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট মানে, হোটেল ভাড়ার সাথেই যে প্রাতরাশের দাম ধরা আছে, এই আরকি। ঐ প্রাতরাশের জন্য বেশ কিছু ফল কেটে রাখা হয়। আমি পেটরোগা লোক; সব কিছু খেয়ে হজম করে উঠতে পারি না। আমি আগেই দেখি, কি কি ফল কেটে রেখেছে। প্রায় সব হোটেলেই কাটা ফলের সাথে তরমুজের টুকরো থাকেই। সব হোটেলেই খুব সুস্বাদু তরমুজ কি করে জোগাড় করে জানি না।

         দিনাজপুরের ইটাহারে থাকার সময় কিছুদিন আশাপুরে মহানন্দা নদী পেরিয়ে চাঁচল যেতাম। এপাড়ে চুড়ামন গ্রামে বাস বা অন্য কোন গাড়ীতে পৌঁছে , প্রায় এক কিলোমিটার মাঠের আলপথ ধরে হেঁটে, মূল নদীর খাতে পৌঁছানো যেত। ওপাড়েও পাড়ার ভেতর দিয়ে আধ কিলোমিটার হেঁটে আশাপুর বাজারে গিয়ে বাস পাওয়া যেত। চুড়ামনের দিকে নদীর পাড়ের বালি ভর্তি, মাঠে তরমুজ চাষ হতে দেখেছি। আমি যে সময় দেখেছি তখন খুব ছোট ছোট কচি ফল ধরেছে দেখেছি। তরমুজ লতার পাতা অনেকটা ঝিঙে পাতার মত। ফুল কেমন দেখিনি।

      তরমুজ নিয়ে এক মহা পণ্ডিতের রসিকতা, তরমুজ দেখলেই মনে পড়ে। বছর নয়-দশ আগে , ভেলোরের বিখ্যাত হাসপতালে একটা কর্মশালায় অংশ নিতে গেছলাম। পৃথিবী বিখ্যাত সব পন্ডিত ডাক্তার-বিজ্ঞানীরা এক জায়গায়, এমন সহসা দেখা যায় না। আমাদের সকলের শিক্ষক, মহারাষ্ট্রের কিংবদন্তি ডাক্তারবাবু, প্রণম্য ডা বাভাস্কারের পায়ের ধুলো নেওয়ার সুযোগ পেলাম, সেবারই প্রথম। কর্মশালার শেষ দিন, আমরা পাঁচ জন একটা গাড়ি নিয়ে বেরোলাম; মূলত ওদের হাসপাতালের ভেতরটা ঘুরে দেখতে। বাভাসকার স্যারের পরিচিত একজন আই আই টি ভেলোরের শিক্ষক। ফেরার পথে স্যারের ঐ পরিচিতের সাথে দেখা করে ফিরব, এমনই ঠিক হল। আই আই টির সামনের রাস্তাটা বেশ চওড়া, হাই ওয়ের মত। গাড়ীর ড্রাইভার মূল গেটটা ছাড়িয়ে চলে গেল। সামনের ঘোরার জায়গাটা দিয়ে গাড়ী ঘুরিয়ে আনার সময়, চোখে পড়ল, ঠেলা গাড়ীতে বিরাট বিরাট তরমুজ বিক্রী হচ্ছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিখ্যাত প্রফেসর আর আমার উৎসাহে গাড়ী দাঁড়াল। অন্যরা বলল, তোমরা কেন, আমরা দ্রুত ঘুরে আসছি। রাস্তার পাশের ফল, তাই ভালো করে ধোওয়ার জল আছে কিনা দেখে, একটা কিলো পাঁচের তরমুজ ধুয়ে কেটে নিয়ে , আমরা দুজন আই আই টি গেটের কাছে আসতে আসতেই বাকীরা বেরিয়ে এলেন। বাভাসকার স্যার এমনিতেই দারুন রসিক মানুষ। ওনার কাছে যতটুকু সময় থাকা যায়, মাতিয়ে রাখেন সকলকে। ইংরেজী, হিন্দি এমনকি মারাঠিতেও বলতে থাকেন। আমরা তরমুজ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতে না বসতেই , স্যর বললেন, " ওয়াটার মেলন ইজ এ ন্যাচারাল ভায়াগ্রা"! এই রসিকতাটা যেহেতু সব ডাক্তার-এর মধ্যে হল; আর বিশুদ্ধ ইংরেজীতে হল; এটাকে ভাষান্তর ঘটিয়ে, পণ্ডিতের রসিকতাকে ঘেঁটে না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অতএব, প্রমানিত হইল যে, তরমুজ এক রসাল ফল।

 



বেচারাম ডিম বেচে , কেনারাম কেনে       

 " বেচারাম ডিম বেচে , কেনারাম কেনে। সেই ডিম রাখে কেনা , হাঁড়ি ভরে এনে। "       ছোটবেলায় " হাসি খুশি" বইতে পড়েছিলাম। প্রায় পঞ্চান্ন বছর পরেও সুন্দর মনে আছে। আমার এক বৃদ্ধ বন্ধু, অধুনা প্রয়াত, চন্দবাবুর কথা আর এক জায়গায় লিখেছি। বছর তিরিশ আগে, মেদিনীপুর শহরে থাকার সময়, এই চন্দবাবুর সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। আমার থেকে বয়সে বছর তিরিশ -এর বড় , স্পষ্ট বক্তা মানুষটি আমার খুব প্রিয়জন ছিলেন। মাঝে মাঝেই বেশ অপ্রিয় হলেও সত্য কথা বলতেন। আমি বছর বত্রিশ -তেত্রিশ বয়সে , মেদিনীপুর শহরে একটা পুরনো বাড়ী কেনা যায় কিনা ভাবছিলাম। ওখানকার রবীন্দ্র নগর ছিল ডাক্তার পাড়া। শহরের অন্য যে কোন পাড়ার থেকে এই রবীন্দ্র নগরে জায়গা জমির দাম অনেকটাই বেশি ছিল। তার থেকে বড় কথা, ফাঁকা জমি প্রায় ছিলই না। পুরনো বাড়ী এক দুটি যা বিক্রী হত , দাম ছিল অন্য কোনো পড়ার প্রায় দ্বিগুণ। আমি একটা পুরনো বাড়ীর খবর পেয়ে দেখতে গেলাম। বাড়ীর কোন ছিরি ছাদ নেই, দামও আমার ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ। এসব কথা শুনে , চন্দবাবু বলেছিলেন,” আপনার বয়স কত? এখনই কেন বাড়ী কেনার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন?” বললাম, এ পাড়ার যা অবস্থা, দু’ তিন বছর পর আর কেনার মত বাড়ী বা জায়গা থাকবে না। উনি সাথে সাথেই বললেন, " আরে না, কেনারাম বেচারাম চলতেই থাকবে"! আমার জীবনে এমন বাস্তব সত্য কথা আর খুব একটা শুনিনি। একেবারে সত্য দ্রষ্টা মুনি ঋষিদের মত কথা। সেদিন আরও কিছু কথা উনি আমাকে বলেছিলেন। চন্বাবু বলেছিলেন, “অপনার এমন কিছু বয়স হয়নি যে এখনই একটা বাড়ী কিনে নিয়ে বসে যেতে হবে। শেষে সেই বাড়ীই বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।  বয়স হোক, তখন যেখানে ইচ্ছা করবে, বাড়ী করে থাকবেন।“     চন্দবাবু বেঁচে থাকতে জেনে গেছলেন, আমি ব্যারাকপুরে ফ্ল্যাট কিনেছি। আমার বর্তমান ঠিকানা, দমদম জংশন স্টেশন -এর পাশে; এটা চন্দবাবুর জেনে যাওয়া হয় নি। তার আগেই উনি মরে শান্তি পেয়েছেন। আমার আগের লেখায় লিখেছি; একজন প্রিয় মানুষের মৃত্যু সংবাদ আমাকে গভীর প্রশান্তি দিয়েছিল। আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। চন্দবাবু সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকতে দেখে গেছেন, সেই রবীন্দ্র নগরেই, আমাকে সেই প্রায় বেদ বাক্য বলার দশ বছর পর, আমার এক বন্ধু বাড়ী কিনেছে। চন্দ বাবুর বাড়ীর কাছেই। আমি জানি, বোধহয় আজ আমার বয়সটা চন্দবাবুর সেদিনের বয়সের মত হয়েছে বলেই, আমি আজই খুঁজলে, রবীন্দ্রনগরেই দু- একটা বাড়ী পেয়েও যাব।       মেদিনীপুর জেলা আমার জন্ম স্থান; বেশ গর্বের সাথেই কথাটা সব সময় বলি। কিন্তু মেদিনীপুর শহরে বছর সাতেক থাকার পর , আরও কয়েকটা জেলায় কয়েক বছর করে থেকেছি। মূলত সরকারী চাকরী করার জন্য জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছি। এখন এটুকু বলতে পারি, পেশার কারনে থেকে যেতে না হলে, মেদিনীপুর শহরে আজীবন আটকে থাকার মত কোন আহামরি জায়গা ওটা নয়। ঐ যে চন্দবাবু বলেছিলেন, সেই বাড়ীই একসময় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, কথাটা কী সাংঘাতিক ভাবে সত্যি , আমার চোখের সামনে প্রতিদিন দেখছি।     এক,দুই্‌ ,চার, ছয় করে গোটা দশেক উদাহরণ আছে, আমার আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মীদের মধ্যেই। অবশ্য শুধু স্থাবর সম্পত্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে , একজন মানুষ চারটি শহরে চারটি বাড়ী বা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে, এমন উদাহরণও কম নেই। আমি আমার নিজের কথাই বলি। মেদিনীপুর শহরে পুরনো বাড়ী আর জায়গার খোঁজ খবর করতে করতেই চলে গেলাম, উত্তরবঙ্গের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চাকরী করতে। বছর চারেক ওদিকে থাকার পর , আবার একটা বাড়ী কেনার চেষ্টা করতে লাগলাম। মাত্র মাস খানেকের মধ্যেই এমন একটি পারিবারিক সংকট দেখা দিল যে, উত্তর বঙ্গের থেকে একেবারে উত্তর ২৪ পরগনায় চলে আসতে হল।   আজও মেদিনীপুর শহরে গিয়ে চারজন লোকের সাথে কথা বলে দেখুন; তিনজনই বলবে, মেদিনীপুরে ‘ডাক্তারী ব্যবসা’ এত ভালো চলে যে, এখানে এলে ডাক্তাররা আর যায় না। আমি এ রাজ্যের সবকটা জেলা শহর ঘুরেছি। প্রতিটা জেলা শহরে ডজন ডজন ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখেছি; সব জেলা শহরেই অন্য জেলা থেকে আসা অনেক ডাক্তার ঘর বাড়ি করে থেকে গেছেন। কলকাতায় বাড়ী,উত্তরবঙ্গের জেলা শহরে বাড়ী কিনে থেকে গিয়েছেন, এমন ডাক্তারের অভাব নেই। আমাদের মেদিনীপুরের ছেলে, রায়গঞ্জ শহরেই থেকে গেল।     ব্যারাকপুরে চাকরী করতে এলাম একটা ব্যতিক্রমী জরুরী পরিস্থিতিতে। জানতাম , খুব বেশীদিন ওখানে কাজ করতে হবে না। কিন্তু ছেলে মেয়ে দুজনকেই ব্যারাকপুরের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করা হল। যখন প্রায় ব্যারাকপুর ছেড়ে অন্য হাসপাতালে যাওয়া ঠিক হয়ে গেল, আমার কলেজের এক দাদা আমাকে পেড়ে ফেলল। ওরা ব্যারাকপুরে একটা ফ্ল্যাট কিনছে, ঐ বাড়িতেই দু’ একটা ফ্ল্যাট এখনও বিক্রী হয়নি; আমি একটা কিনি, এমনটা ঐ দাদার ইচ্ছা। ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা’ , এই প্রবাদ বাক্যটা নিজের ক্ষেত্রে ফলতে কজন দেখেছে? আমার অবস্থা তখন তার থেকেও খারাপ। আমার পরিবারের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ের খবর, ঐ দাদা সব জানেন। তবুও একটা লাখ পাঁচেক টাকার ফ্ল্যাট কেনার জন্য ব্যাঙ্কের লোন পাওয়া যায়, এবং ইত্যাদি হিসেব করে দেখালেন। ওনার চাপাচাপিতে গেলাম প্রোমোটার -এর বাড়ী। সবথেকে ছোট যে ফ্ল্যাটটি তখনও খালি ছিল , সেটাই কেনা যেতে পারে , বুঝলাম। আজও ভাবলে অবাক লাগে, কি করে তখন ঐ দুঃসাহস দেখিয়েছিলাম। মনে আছে, ঐ সময় এক দালাল, ঐ পাড়ার আরও ভেতরে একটা পুরনো ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে যায়। সে যা দর বলেছিল তাতে পরের পাঁচ বছরেও একটা ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবতে পারিনি। সে দালাল বলেছিল, “ব্যারাকপুর গাঁজা গলিতে ফ্ল্যাটের দাম বালিগঞ্জের মত।“ পরে বুঝেছিলাম, দালালরা ওভাবেই বলে।   সেই গোয়েন্দা গল্পের মত , "কোথা হইতে কি হইয়া গেল, আক্রমণকারির হাত হইতে আগ্নেয়াস্ত্র গোয়েন্দার হাতে আসিয়া গেল!" হাতে একটি টাকা না থাকলেও , ঐ ছোট ফ্ল্যাটটি কেনা হল। এক্ষেত্রে কেনারামের জয় হইল। কিন্তু বেচারাম যদি প্রোমোটার হয়, একটি টাকাও ছাড় পাওয়ার আশায় না থাকাই ভালো। ব্যাংকের  মূল্য নির্ধারক ভদ্র লোকের একটি কথাও ,আজ বছর কুড়ি পরেও ,ভীষন আধুনিক মনে হচ্ছে। উনি বলেছিলেন, " প্রোমোটারের সাথে পাঁচ লাখে কথা হয়েছে? তাহলে ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে আরও এক লাখ অপনার খরচ হবেই"! বাস্তবে আমি ঐ ছোট ফ্ল্যাটে ঢোকার সময় পর্যন্ত ,রেজিস্ট্রির খরচ নিয়ে সাত লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। এই সাত লাখ টাকা কিন্তু দু হাজার তিন সালের খবর। দশ বছরে ঐ সাত লাখের বাজার দর হয়ে গেল বাইশ লাখ। এবার আমি বেচারাম।      এই দশ বছরে আমার ছেলে মেয়ে দুজনেই কলেজে পড়তে শুরু করেছে, কলকাতায়। আমি তো এই এই ফ্ল্যাটে ঢোকার আগেই হাবড়া হাসপাতালে চলে গিয়েছি। সব থেকে বড় কথা, আগেই বলেছি,সবথেকে ছোট ফ্ল্যাটটি কিনতে পেরেছিলাম। এদিকে ব্যাংকের লোনও শেষ করতে পেরেছি। ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাটে সুখে শান্তিতে দিন কেটে যাচ্ছিল। একটাই সমস্যা; গ্রীষ্মের মাস দুই- তিন গরমে বেশ কষ্ট। আশপাশের প্রায় সব বাড়িতেই ‘এ সি’ লেগে গেল; এবার আমার ফ্ল্যাটেও ‘এ সি’ না লাগালেই নয়। এক সকালে ছেলেকে নিয়ে খবরের কাগজে কেনারাম বেচারাম -এর পাতাটা দেখতে বসলাম। উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পাড়ায় কয়েক ডজন ফ্ল্যাট বিক্রী আছে। গোটা চারেক -এর ঠিকানা দেখে ফোন করে আরও কিছু তথ্য জেনে নেওয়া গেল। ওগুলি দেখতে গিয়ে, বিশেষ করে দালালদের বদান্যতায় আরও তিনগুণ ফ্ল্যাট এমনকি নতুন তৈরী বাড়ীরও সন্ধান পেলাম। সপ্তাহে তিন- চারটি ফ্ল্যাট ইত্যাদি দেখতে যেতাম। দশ বছর আগে , চার লাখ টাকা লোন পাওয়া যাবে কি না তাই নিয়ে সন্দেহ ছিল; এবার ব্যাংকের ম্যানেজার তিরিশ- চল্লিশ লাখ টাকা দিতে পারেন জানালেন।  ধার নিলেই তো হবে না, শোধ করতে হবে। আমার ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাট বিক্রি করে লাখ পনের পেতে পারি,এমন ভেবেই নিজের ক্রয় ক্ষমতা ঠিক করে নিলাম। ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাটের এক প্রতিবেশীও তার একটা ফ্ল্যাট বিক্রি করতে চেষ্টা করছেন, খোঁজ পেয়ে তার সাথে একদিন দেখা করলাম। উনি ঝানু বেচারাম। বললেন, অপনার ফ্ল্যাট পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে দাম পাবেন। আমার হিসেবের পনেরলাখটা কুড়িতে পৌঁছতে পারে , এটা বুঝলাম। সেই মত একটা বাজেট করে এগোতে শুরু করলাম। অন্তত দুটি পুরনো ফ্ল্যাটের কাগজ পত্র নিয়ে উকিল বাবুকে দেখতেও দিলাম। এক বৃদ্ধের ফ্ল্যাট কেনার জন্য কয়েক লাখ টাকা দিয়ে চুক্তি পত্র তৈরী করার জন্য টাকা জোগাড় করলাম। আগের দিন রাতে তার কন্যা ফোন করে জানালেন, “এখন দিতে পারছি না। বাবা ঐ ফ্ল্যাট বিক্রি করে আমার পাশে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে চলে আসার কথা ছিল; কিন্তু এর মধ্যে এটা বিক্রী হয়ে গেল। “ আবার অন্য কোনোটা নেওয়া যায় ভাবতে শুরু করলাম। এক মার্কামারা দালাল প্রতিষ্ঠান মারফত আর একটা বেশ পছন্দের পুরনো ফ্ল্যাট কেনার জন্য এগোলাম। এটাতে কেণারাম বেচারাম এর খেলা বেশ উপভোগ্য ছিল।      কেষ্ট পুরের এই দোতলার তিন রুমের ফ্ল্যাটটি আমাদের খুব পছন্দ হল। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে লোকজন ভদ্র মনে হল। কিন্তু দালালের এক কর্মচারী নিচের যে গ্যারেজ দেখিয়েছিল, সেটি আদৌ ঐ ফ্ল্যাটের সাথে বিক্রী হচ্ছে না জানলাম। দালালকে ফোন করলে বলল, ওটা কয়েক মাস পর বিক্রী হবে। প্রথমেই কথার খেলাপ হল, কেনারাম বিগড়ে গেল। জানলাম ফ্ল্যাটের মালিকের ওষুধের ব্যবসা ঐ নিচের গ্যারেজে। ব্যবসার জন্য অনেক টাকা দরকার তাই ব্যবসায়ী ভাইপোকে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ভাইপো ভিন রাজ্যে থাকে, পাকা বেচারাম। দালালের কাছ থেকে আমার ফোন নম্বর নিয়ে , আমাকে খুব বোঝানোর চেষ্টা করে, তার চালিয়াতি যুক্তি চালিয়ে গেল। আমার সহৃদয় পাঠক পাঠিকা, একটি কথা আমি প্রায়ই বলি; "একজন এম বি বি এস পাশ ডাক্তারকে যে বোকা ভাবে, সেই হদ্দ বোকা"! আমরা ভদ্রতার খাতিরে অনেক সময়ই মুখের উপর কথাটা বলিনা। কিন্তু সামনের গাধাটা আমাকে বোকা ভাবছে, এটা বোঝার মত বুদ্ধি না থাকলে, কেউ জয়েন্টে রাঙ্ক করে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পাবে না।  গেল ঐ কেষ্টপুরের ফ্ল্যাট। এমনকি ঐ বাড়ীর সেক্রেটারী ভদ্রলোক পরে আমাকে ফোন করে জানালেন যে, ঐ বাড়িতেই আর একজনের গ্যারাজ বিক্রী আছে, আমি ওটা আলাদা করে কিনে নিতে পারি। কিন্তু ঐ যে বেচারামকে চালিয়াত মনে হল, আর ওদিকে গেলাম না। এর পর দমদমের বর্তমান ফ্ল্যাটের একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। গিয়ে দেখি, আমি যেটা নিতে পারি ,মানে একেবারে প্রথম পছন্দের না হলেও , দ্বিতীয় বা তৃতীয় পছন্দের অবস্থান, দক্ষিণ খোলা, কিছুটা ওপরে, সেই ফ্ল্যাটের ছাদ সবে ঢালাই হয়েছে। প্রোমোটার জানালেন, ঠিক এক বছরের মধ্যে ঢুকে পড়ার মত করে দেবেন। আমারও ব্যাংকের লোন, ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাট বিক্রি এসব করতে এক বছরের বেশিই লাগবে, ওদের জানলাম। এটা বুক করেই,ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাট বিক্রি করতে চাই, লোকজনকে বলতে শুরু করলাম।  সে সময় একটা কথা বন্ধুরা খুব বলত। "মানুষ কিনতে পাগল, বিকতে ছাগল"! ঠিকই ,আগেও গোটা দুই তিন পুরনো ফ্ল্যাট কিনতে পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিলাম। ভাগ্য ভাল, ওসব ক্ষেত্রে বেচারামরাই বিগড়ে যায়। এবার এই নতুন ফ্ল্যাট কেনার জন্য পাগলের মত ব্যস্ত না হলেও, আমার ক্রয় ক্ষমতার অনেক বেশি দামেই কিনব ঠিক করে নিলাম। জানতাম,ব্যাঙ্ক এবার অনেক বেশি লোন দেবে।     ওদিকে মুখে মুখে শুনেই , ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাট কেনার লোক আসতে শুরু করেছে। একজন ভদ্রলোক তো পারলে এক সপ্তাহের মধ্যেই কেনেন। ইছাপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ভদ্রলোক ;পঁচিশ লাখ টাকা দাম দিতে তৈরী। কিন্তু আমার পুরনো প্রতিবেশীদের কেউ কেউ এমন অশ্লীল ভাবে আপত্তি জানালেন যে, উনি আমার সাথে এসে দেখা করতেই পারলেন না। আমি জানি বেচারাম কেনারমের গল্পে , এই " আপত্তি" ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ন। কিন্তু ব্যাপারটা এতোই, "পলিটিক্যালি ইনক্যারেক্ট" যে, আমি লিখতে পারছি না। কারো জানার আগ্রহ থাকলে আমার কাছে ব্যক্তিগভাবে জেনে নিতে পারেন।এবার আমি হলাম বেচারাম। চন্দবাবুর সেই অমোঘ বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। বেচারাম থাকলে কেনারামও থাকে। দিন সাতের মধ্যে আমার এক ভ্রাতৃপ্রতীম ডাক্তার এসে বলল, অপনার ফ্ল্যাট আমাকে দিতেই হবে। আমি পঁচিশ লাখ দাম পেয়েছি জানালাম। ও বলল,ওর একটা ফ্ল্যাট অন্য জায়গায় আছে, সেটা বিক্রী করে আমারটা কিনবে, একটু দাম কমাতে হবে। ঠিক আছে, আমি তো কুড়ি লাখ পাবো ধরে এগোচ্ছিলাম; ওকে চব্বিশ বললাম। ও দু’ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে বায়না করল। আমিও বেচারাম হয়ে যা পাচ্ছি, বাকিটা হিসে্ করে ব্যাংকে লোনের জন্য দরখাস্ত জমা দিলাম। আমার প্রোমোটার বেশ ভালো ভাবেই কাজ এগোচ্ছে দেখলাম। নিজের জমা আর অন্যান্য দিক থেকে টাকা তুলে প্রোমোটারের কিস্তি দিতে থাকলাম। কিন্তু সমস্যা দু’ দিকেই দেখা গেল।      একদিকে প্রোমোটার একটা জরুরী কাগজ দিতে না পারায় , ব্যাংকের লোন আটকে আছে। প্রোমোটার বলছেন, সরকারী আপিসে সব টাকা পয়সা জমা করা হয়েছে, কিন্তু অপিসের ঢিলেমিতে কাগজটা পেতে দেরী হচ্ছে। ওদিকে আমার ভাইটিও যে কোন কারনে হোক তার ফ্ল্যাটটি বিক্রী করতে পারছে না। অর্থাৎ কেনারম আর বেচারাম দু’জনেই ঝুলে আছে। এভাবে একবছর প্রায় পেরিয়ে গেছে। আমার ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাট কেনার জন্য আরও কেনারামের খবর পাচ্ছি। কেউ কেউ বলছে, ওটা এখন তিরিশ লাখ পাবেন। ভাইটিকে বলতেই হল যে আর সময় দেওয়া যাবে না। ভাইটি প্রায় কেঁদে জানাল, পারিবারিক সমস্যার কারণে বিক্রী করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের লোন নিয়ে আমার নতুন ফ্ল্যাটটি কেনা হল। এক বছরের জায়গায় চোদ্দ মাসেই , প্রোমোটার আমাকে ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে দিলেন। ওদিকে ভাইটি যে সত্যিই বেকায়দায় পড়েছে জানতে পারলাম। শেষ পর্যন্ত বাইশ লাখেই ওকে ফ্ল্যাটটি দিয়ে দিলাম। সাত লাখের কেনারাম,  দশ বছরে, বাইশ লাখের বেচারাম হয়ে গেল।       বছর খানেকের মধ্যেই জানলাম, আমাদের ব্যারাকপুরের সেই বাড়ীর চব্বিশটি ফ্ল্যাটের মধ্যে আরও গোটা তিনেক বিক্রী করে, পুরনো বাসিন্দারা চলে গেছে। তারা কে কি কারণে বিক্রী করেছে আমার জানা নেই। আমি তো কলকাতার আরও কাছে আসতে চেয়েছিলাম। তার থেকে বড় কথা, ছেলে মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ায় একটু বড় ফ্ল্যাটের দরকার হয়েছিল। আমার সেই ভাই আবার, বছর চার- পাঁচ থেকে সেই ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছে।  ওদিকে আমার সেই দাদাও, আমি আসার পর পরই অন্য জেলায় বদলী হয়ে গেছেন। মেয়ে কোলকাতার একটা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ায় ওনারা ওর কলেজের কাছে একটি ফ্ল্যাট কিনে নেন। মায়ের চাকরী ব্যারাকপুরে থাকলেও, মেয়ের জন্যই মা মেয়ে কলকাতায় থাকতে শুরু করে। ওদের ছেলেও উচ্চ শিক্ষার জন্য ভিন রাজ্যে চলে গেল। মেয়েও উচ্চ শিক্ষার জন্য অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ায় পর, ওদের মাও ট্রান্সফার নিয়ে স্বামীর কাছে চলে গেছে। অর্থাৎ , আপাতত দুটি ফ্ল্যাট তালা বন্ধ হয়ে থাকে। ওনারা অবশ্য , চন্দবাবুর কথা মত, এই ফ্ল্যাট বা বাড়ী গুলিকে, "বোঝা" ভাবেন কি না আমি জানিনা। আমার পরিচিত ডজন খানেক মানুষ আছেন, যারা বিদেশে বা ভিন রাজ্যে চাকরী করার জন্য গিয়ে স্থায়ী ভাবে থেকে গেছেন। তাদের কারো বৃদ্ধা মা একা একা একটা বাড়ী আগলে পড়ে আছেন। কারো বা তাও নেই। আমি ব্যারাকপুরে এসে প্রথম যে বাড়িতে ভাড়া ছিলাম, সেই বাড়ীর আসল মালিক মহিলাকে আমরা এসে দেখনি। আমরা আসার আগেই তিনি গত হয়েছেন। তাঁর মেয়ে জামাই দু’জনেই দূরের জেলায় ভালো চাকরী করেন। আমার আগে যে ভদ্রলোক ভাড়ায় ছিলেন, তিনিই বছর দশেক বাড়িটি দেখভাল করেছেন। পরে আমি যে বছর তিনেক ছিলাম, সেই বাড়িওলা জামাইবাবু বোধহয় তিনবার এসেছিলেন। আর আসল বর্তমান মালিক, দিদি এসেছিলেন মাত্র এক বারই। আমি চলে আসার পর কে এসেছে, আর জানা হয়নি।   আমার ভাগ্য ভাল, যে দুটি নতুন ফ্ল্যাট কিনেছি, প্রোমোটার দাম একটু বেশি নিলেও ঠিক সময়েই ফ্ল্যাট তৈরী করে দিয়েছে। আমার নিকট আত্মীয় ফ্ল্যাট কিনে ঢোকার দু’দিন পরে হাতে উকিলের চিঠি পেয়ে জানতে পারে, ঐটি ছাড়াও আরো কয়েকটি ফ্ল্যাট, প্রোমোটার একজনের কাছে বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে রেখেছে। পলতা রেল স্টেশন-এর পাশে, কয়েকশ ফ্ল্যাটের একটা প্রায় নতুন শহর তৈরী হচ্ছিল, বছর দশ বার আগে। বিরাট কোম্পানির প্রকল্প। এই বেচারাম এর কাছে লাখ লাখ টাকা বায়না দিয়ে যারা ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টা করেছিলেন, তাদের দুর্ভাগ্য দেখলে আমার কষ্ট হয়। তিন চার তলা পর্যন্ত খাঁচা তৈরী হয়েছে। তারপরই কাজ বন্ধ। দশ বছরে সেই সব সিমেন্টের খাঁচায় কত মোটা ধুলোর আস্তরণ জমেছে জানিনা। কেনারাম বেচারাম-এর ছড়াটা আজও মনে আছে বলেছিলাম। শেষ লাইন দুটি হল; "একদিন ডিম ফুটে, বের হল বিদঘুটে, কালো কালো কদাকার দাঁড়কাক গুলো। কেনা বলে বেচারাম চোখে দিল ধুলো।"




বুড়ো হয়ে

সুকুমার রায়ের হযবরল মনে আছে? সেই যে, " শেষে বুড়ো হয়ে মরি আরকি!"  তাই তো, শেষে কি বুড়ো হয়ে মরাই আছে নাকি কপালে?  সে তো বড্ড বাজে ব্যাপার।

আসলে আমি আজ এমন একটা ব্যাপারে লিখতে শুরু করেছি, যা সম্বন্ধে নিজের কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। বুড়ো হওয়া কপালে আছে কি না জানিনা। তবে হ্যাঁ, অনেক অনেক বুড়ো দেখেছি, আজও দেখছি। খুব কাছের থেকে নিজের বাবাকে দেখেছি। নিকটজন অনেককেই বুড়ো বুড়ি হতে দেখেছি। প্রতিবেশি বয়স্ক লোকজনও কম পাইনি জীবনে।

এছাড়া আমার চোখের ডাক্তারীর পেশায় অনেক বয়স্ক আর অতিবৃদ্ধ রোগীর সান্নিধ্যে এসেছি। একটু চোখকান খোলা রাখলেই এই বয়স্ক মানুষগুলির সামাজিক অবস্থান টের পাওয়া যায়। এক বছরের বেশী হল, " বৃদ্ধাশ্রম" নিবন্ধটি লিখেছিলাম। পরিচিত অপরিচিত অনেকেই পড়েছেন। সকলকেই আমার মতামত বা মূল্যায়ন মেনে নিতে হবে, এমন কোন নরচন্দ্রমা আমি নই।

  এই নরচন্দ্রমা কথাটি এসেছে ত্রেতা যুগের শ্রীরামচন্দ্র প্রসঙ্গে। অমন যে দেবপ্রতীম, পতিত পাবন রামচন্দ্র, তাঁকেও সরজুর জলে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। কেন? কখনও কি ভেবে দেখেছেন? আর দ্বাপর যুগের ত্রিকালজ্ঞ ঋষি, ব্যাসদেব, একদিন তাঁর মাতা, রাজেন্দ্রানী সত্যবতীকে বনে নিয়ে গেলেন। পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের যুক্তি কি ছিল?

  ব্যাসদেব বলেছিলেন," মা, এরপর তোমার বংশধরগণ এমন অনাচার শুরু করবে,তুমি সহ্য করতে পারবে না"। এই একটি বাক্যই  যুগ যুগ ধরে বার্ধক্যের মূল মানসিক সমস্যাকে প্রকাশ করছে।

  বৈদিক যুগে প্রৌঢ়ত্বে বানপ্রস্থ আর বার্ধক্যে সন্যাসের যে বিধান দেওয়া হয়েছিল, তার মূলেও ঐ এক মানসিক সমস্যা। নতুন প্রজন্মের সাথে মতের মিল না হওয়া। জেনারেশন গ্যাপ।

  আচ্ছা, দুর্যোধন ইত্যাদির নানান অনাচার, যা পিতামহ ভীষ্মকে দাঁত কামড়ে সহ্য করতে হয়েছে, প্রায় শেষদিন পর্যন্তই ; পান্ডবদের তো সেরকম কোন প্রকাশ্য সমস্যা ছিল না। তবুও সদ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডব মহাপ্রস্থানের পথ ধরেছিল কেন? ধর্মপুত্র যুধীষ্ঠিরের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে পৌত্র পরিক্ষিতের সাথে ব্যক্তিত্বের সংঘাত হবেই।

    এই পরবর্তী প্রজন্মের সাথে ব্যক্তিত্বের সংঘাতটিই আমার মতে বার্ধক্যের মূল সমস্যা। শারীরীক সমস্যা বয়স বাড়বার সাথে সাথে বাড়বেই। এটার জন্য আমাদের একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকে। বিশেষকরে মধ্যবিত্তের সমাজে এই শারীরীক সমস্যাকে মোকাবিলা করার জন্য একটা আর্থিক প্রস্তুতি বেশ আগে থেকেই শুরু করা যায়। কিন্তু মানসিক সমস্যাকে ততোটা আগে থেকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সমস্যা যে হতে পারে সেটা বুঝে সময় মত ব্যবস্থা আজকাল অনেকে নিচ্ছেন। এই সমস্যাটি ছেলের সাথে বাবা মায়ের যতোটা না প্রকট হয়ে যায়, তার শতগুন দেখা যায় বৌমার সাথে শাশুড়ি মায়ের। এই বাস্তবকে সময় মত মেনে নিয়ে ব্যবস্থা না নিতে পারলে, জটিলতা বাড়তেই থাকে। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই মানসিক সমস্যাগুলিই বার্ধক্যের দিনগুলিকে নরক যন্ত্রনার সামিল করে তোলে।

    শুধু কি পরিবারের ভেতরই এই মানসিক সমস্যা?  সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষজনের সাথেই বয়স্ক মানুষদের এই সমস্যাটি তৈরী হয়।

 

 


আমার বন্ধু হরেন

আমার ছোট বেলার বন্ধু হরেন এখন খুব যাত্রা করে বেড়ায় শুনলাম। আজতো শুনলাম হাওড়া জেলার কোথাও চলে গেছে যাত্রা করতে। ওর খবর মাঝে মাঝে পাই, কিন্তু ওকে চোখে দেখিনি বোধ হয় বছর পনের হবে। ওর প্রসঙ্গেই আমাদের ছোট বেলার কথা মনে পড়ল। ওরা আমাদের গ্রামের প্রতিবেশী। ওর মা, আমাদের লক্ষী দিদি। তাঁর কথা কয়েকবার লিখেছি। এই হরেন আমার কতো ছোট বেলা থেকে বন্ধু ছিল সেটা একটা মজার খেলার কথা বললেই সকলে বুঝবে। হরেন আর আমি একটু উঁচু মাঠের আল বা রাস্তায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দমকল খেলতাম। আর যেদিন যেদিন এই খেলাটা আমরা খেলতাম সেই দিন সকালে দেখা যেত আমার বিছানা ভিজে সপসপ করছে। আসলে এই খেলাটা আমরা খেলতাম স্বপ্নের মধ্যে। হরেনের স্বাস্থ্য ছোটবেলা থেকেই বেশ শক্ত পোক্ত ছিল। আমি তো ওর ঐ পেটাই চেহারার দিকে চেয়ে থাকতাম। আমাদের গ্রাম ছিল মেদিনীপুর জেলা শহর থেকে পঞ্চাশ কিমি দূরের একটা গণ্ড গ্রাম। গ্রামের খেলা ছিল বেশীটাই হাসপতালের মাঠে। এক একদিন বিকেলে পনের কুড়ি জন ছেলে মেয়ে জুটে যেতাম। ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম বা একটা ফুটবল কেনার মত টাকা আমাদের ছিল না। কিন্তু বিকেল বেলা ঘণ্টা দুই আমরা হাসপতালের মাঠে প্রচুর ছোটাছুটি খেলতাম। কোন সরঞ্জাম, কোন দাগ কেটে করা কোর্ট কিছুই লাগত না, বৌ বসন্ত খেলায়। গোটা মাঠ জুড়ে সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি। মাঠে দাগ কেটে গিজা বলে একটা খেলা হত; অনেকটা দাড়িয়া বান্ধা খেলার মত। এতেও বেশ ছোটাছুটি দরকার হত। আজকাল আর এসব খেলা কাউকে খেলতে দেখিনা। এই খুব ছোটাছুটির খেলাতে হরেন কোনদিন আমাদের সাথে খেলেনি। ওর পরের দুই ভাই আমাদের সাথে প্রায় সবদিনই খেলত। হরেন আমাদের সাথে প্রাইমারী স্কুলে যেত এটা মনে আছে। কিন্তু ও বোধহয় কোনদিন হাই স্কুলে পড়েনি। সম্ভবত একটু কম বয়স থেকেই ও চাষের কাজ শুরু করে। আমি মাধ্যমিক পাশ করার পর থেকেই গ্রামের বাইরে। হরেনের মেজদা সেই সময় থেকেই গ্রামের শ্যালো টিউবয়েলের মিস্ত্রী হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল। আমি গ্রাম ছাড়ার বছর দুই আগে থেকেই গ্রামের বড় চাষিদের প্রায় সবার একটা করে শ্যালো ছিল। গ্রাম ছাড়ার বছর পনের পরে একবার গ্রামে গিয়ে দেখি, গ্রামের কোন টিউব ওয়েলে জল ওঠে না। শ্যালো সবই সাবম্যারসেবিল হয়ে গেছে। মাটির প্রায় সাড়ে চার শ ফুট নিচে থেকে জল তুলে প্রবল গ্রীষ্মে ধান চাষ হচ্ছে। পানীয় জলও ঐ মাঠের সেমি ডিপ টিউবওয়েল থেকেই আনতে হয়। হরেন ততদিনে বেশ বড় মিস্ত্রী হিসেবে নাম করেছে। আর একটা খবর জানলাম, ও পঞ্চায়েত ভোটে বিজয়ী হয়ে মেম্বার হয়েছে। সেই সময়ই শুনতাম হরেন যাত্রা করে। দলে কারা কারা আছে, আর জানা হয়নি। আমিও বহু বছর আর যাত্রা দেখতে যাই না। শেষ যা মনে পড়ে, বছর চল্লিশ আগে একটা যাত্রা দেখতে গিয়ে খুব হতাশ হয়েছিলাম। বিখ্যাত অভিনেতা শন্তিগোপাল এর যাত্রা ছিল। কিন্তু এত বাজে হয়েছিল যে লোক ঢিল ছুড়তে শুরু করে। মাঝ পথে যাত্রা বন্ধ করতে হয়েছিল। হরেন বড় মিস্ত্রী, হরেন যাত্রা দলে রাজার অভিনয় করে, হরেন পঞ্চায়েত এর মেম্বার; এসবের থেকেও আমার কাছে বেশি করে মনে পড়ল সেই ছোট বেলায় “বিকোপ” খেলার স্মৃতি। আমাদের প্রাইমারী স্কুলের কাছে ম্যাজিক এর আসর বসেছিল। আমি কোনোদিন দেখতে যাইনি। হরেন দেখেছিল কি না জানিনা। ঐ ম্যাজিকে একটি নররাক্ষসের খেলা ছিল। রাক্ষস ম্যাজিকের আসর থেকে উধাও হয়ে, একটু দূরে মাঠের ভেতর একটা জাম গাছে উঠে বসেছিল। চার পাঁচ জন জোয়ান লোক, ম্যাজিসিয়ানের সাথে গিয়ে সেই নররাক্ষসকে ধরে বেঁধে এনেছিল। এই বর্ননা আমরা বড়দের কাছে শুনেছিলাম। একদিন বিকেলে আমরা পাঁচ সাতজন বাচ্চা ঐ খেলাটা শুরু করলাম। ম্যাজিশিয়ান ঐ রক্ষসকে বোধহয় “ বিকোপ” বলে ডেকেছিল। হরেন বিকোপ সেজে আমাদের বাড়ীর কাছের একটা জাম গাছে লুকিয়ে ছিল। বেশ কিছু জামের ডাল ভেঙ্গে কোমরে হাফ প্যান্ট এর সাথে আটকে নিয়েছিল। হরেন বেশ লম্ফ ঝম্ফ করে রাক্ষসের অভিনয় করছিল। আমরা সবাই মিলে ওকে চ্যাংদোলা করে এনে আমাদের উঠানে ফেলেছিলাম। ও যতই লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আমরা ওকে চেপে ধরে থাকি। আমরা অভিনয় বুঝলেও আমাদের পোষা কুকুরটি ব্যাপারটা বোঝেনি। সে এসে ঘ্যক করে হরেনের একটা পা কামড়ে ধরে। ব্যাস খেলা ভন্ডুল। তখন বোধহয় গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জলাতঙ্কের টিকা পাওয়া যেত না। ওকে কোন টিকাই দেওয়া হয়নি। ভাগ্য ভালো, কুকুরটি সুস্থ্য ছিল, তাই হরেনের কিছু হয়নি। আজ থেকে কম করে পঞ্চান্ন বছর আগের সেই খেলার কথা আজও পরিষ্কার মনে আছে। নর রাক্ষসের অভিনয় করা হরেন এখন রাজার অভিনয় করে। আমার দেখার সুযোগ হয়নি। ভালো থাকুক হরেন। অমলিন থাক আমাদের সেই শৈশবের মধুর স্মৃতি।১০.৪.২০২৫.


 

 

পুরাণ আর উপকথায় সাপ

ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্য, পুরান ইত্যাদিতে অনেক সাপের কাহিনী আছে। বিখ্যাত ভাগবত পুরাণ শুরুই হয়েছে এক সাপের ব্যাপার দিয়ে। মহাভারতের অর্জুনের নাতি রাজা পরীক্ষিত,  এক ব্রাহ্মণ বালকের অভিশাপে সাত দিনের মধ্যে সাপের কামড়ে মারা যাবেন। এটা জেনেই উনি শান্তভাবে মৃত্যুর জন্য তৈরী হলেন। কিন্তু নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা ভেদ করে, একটি ক্ষুদ্র পোকার চেহারা নিয়ে, তক্ষক সাপ রাজা পরীক্ষিতকে মেরে ফেললেন। ঘটনাচক্রে এখন আমরা সবাই জানি, তক্ষক নামে পরিচিত প্রাণীটি আদৌ কোন সাপ নয়, এটি একটি গিরগিটি জাতীয় প্রাণী। এদের বিষ নেই। 

এই তক্ষক এর কাহিনীর পিছনে বেশ পুরোনো গল্প আছে। মহাভারতের অর্জুনের খান্ডব বন দহন করার সময় তক্ষকের বংশের অনেকেই মারা যায়। বিনা দোষে অর্জুন তাঁর এতবড় ক্ষতি করায় তক্ষক রাগ পুষে রাখে। তার ফলশ্রুতিতে রাজা পরিক্ষিতকে হত্যা। আবার মহাভারতের কথা শুরু হয়েছে, জনমেজয়ের সর্প যজ্ঞ থেকে । এই জনমেজয় হলেন রাজা পরীক্ষিতের পুত্র। বাবাকে সাপে মেরেছে, তাই পৃথিবীর সব সাপ মেরে ফেলার জন্য জনমেজয় এই সাপ মারার ব্যবস্থা করেন। এই যজ্ঞে এসে হাজীর হলেন সুত লোমহর্ষন। উনি এখানে অন্যান্য মুনী ঋষিদের মহাভারতের কাহিনী বলতে শুরু করেন। 

মহাভারতের মহা নায়ক ভগবান শ্রী কৃষ্ণ। শ্রী কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলায় আছে , কালীয় নাগ দমনের কাহিনী। পণ্ডিতেরা বলেন, এই কালিয় নাগ আসলে কোন সাপ নয়। উনিও অনার্য নাগ বংশের নেতা ছিলেন। যমুনার কিছুটা এলাকা উনি দখল করে রাখায় বৃন্দাবনের লোকেদের সমস্যা হয়েছিল, তাই শ্রী কৃষ্ণ কালীয়কে সেই এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেন।

শ্রী কৃষ্ণ যখন মথুরায়, সেই সময় জরাসন্ধের মত কাল যবন নামের আর এক রাজার সাথে মথুরার যুদ্ধ শুরু হয়। কাল যবন একটি বিষধর কাল সর্প মাটির হাঁড়িতে ভরে শ্রী কৃষ্ণের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এটা কিন্তু সত্যিকারের সাপই ছিল। কিন্তু মহাভারতে আর এক জায়গায় আর এক মহা সর্পের কাহিনী আছে। 

বনবাসের সময় অর্জুন হিমালয় পর্বত পেরিয়ে স্বর্গে গেছলেন , দেবতাদের কাছ থেকে দিব্যস্ত্র সংগ্রহ করতে। অর্জুনের ফেরার সময় হলে বাকি চার ভাই আর দ্রৌপদী হিমালয়ের দিকে এগিয়ে যান। এই সময় একদিন ভীম, হিমালয়ের এক গুহায় বসে থাকা মহা স্বর্প নহুষের কাছে বন্দি হয়ে যান। এই মহা সর্প ভীম কে এমন ভাবে পেঁচিয়ে ধরে রাখেন যে ভীমের নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকে না। ওদিকে অনেকক্ষণ ভীমের দেখা না পেয়ে দাদা যুধিষ্ঠির ভিমকে খুঁজতে খুঁজতে ঐ গুহার কাছে আসেন। সাপ মানুষের ভাষায় জানান যে উনি মুনীদের অভিশাপে ঐ গুহায় পড়ে আছেন, হাজার বছর ধরে। ওনার নাগালের মধ্যে যে প্রাণী আসে, তাকেই উনি ধরে খেয়ে নেন। যুধিষ্ঠিরের কাতর অনুরোধ শুনে মহাসর্প নহুস বলেন যে, আমার প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে পারলে একে আমি ছেড়ে দেব। এখানে অপনাদের নিশ্চয়ই সেই যক্ষের প্রশ্নের কথা মনে পড়ছে। সেখানে বাকি চার ভাই অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। যুধিষ্ঠির যক্ষের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ভাইদের প্রাণ বাঁচান। এখানেও সাপ রূপী নহুশের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ভীমকে মুক্ত করেন। ঠিক উত্তর পেয়ে সাপ নহুষ নিজেও অগস্ত্য মুনীর অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বর্গে ফিরে যান। এই রাজা নহুসের কাহিনী বেশ শিক্ষামূলক। মর্তের রাজা নহুশ নিজ কীর্তি বলে একদিন স্বর্গের রাজা হয়ে যান। প্রচণ্ড অহংকারে উনি সপ্ত ঋষিদের দিয়ে নিজের পাল্কি বওয়াতে শুরু করেন। এমনকি পাল্কি থেকে পা বের করে অগস্ত্য মুনীর মাথায় লাথি মারেন। তখন মুনীর অভিশাপ মত মর্তে পতিত হন। 

মহাভারত বা ভাগবতের তুলনায় অর্বাচীন সাহিত্য হল মনসামঙ্গল কাব্য। এখানে সাপেদের দেবী মনসার ক্ষমতা দেখানোর জন্য চাঁদ সদাগরের ছেলে লক্ষিন্দরকে সাপের কামড় দিয়ে মেরে ফেলার গল্প তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু সাপের কামড় খেয়ে মরে যাওয়ার পর আবার কি করে বেঁচে ফিরল? মনসার ক্ষমতা, তুকতাক মন্ত্রের জোর,  এসব নিয়ে যারা কয়েকশ বছর ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছে তারা এখনও গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত মানুষের কুসংস্কার আচ্ছন্ন মন ভুলিয়ে দু পয়সা করে খাচ্ছে। ওদের ঐ বুজরুকি বন্ধ করতে, বিজ্ঞান মনষ্ক মানুষেরা নানান ভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। আসল কথা হল, মনসা মঙ্গল তো মানুষের মন গড়া কাব্য সাহিত্য, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করতে হবে কেন? আমি যদি আধুনিক রূপকথার ঝাঁটায় চড়ে আকাশে ওড়ার বিজ্ঞান খোঁজার চেষ্টা করি ব্যাপারটি ঠিক ঐ রকম হবে। বসন্ত বা কলেরা রোগের জীবাণু আর চিকিৎসা আবিষ্কারের আগে লোকে ঐ অসুখ দুটির জন্যও দুই দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করত। 

সাপেদের রহস্যময় ব্যবহার, ওদের কারো কারো কামড় চোখের সামনে দেখা মানুষগুলিকে মরতে দেখা এসব কারণে ওদের নিয়ে নানান রূপকথা চালু রেখেছে। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, ডাক্তার বা চিকিৎসার চিহ্ন হিসেবে যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়, সেখানেও একটা সাপ আছে। আর আমাদের সবার শ্রদ্ধার রামকৃষ্ণ মিশনের চিহ্নেও একটি সাপ আছে। এই মিশনের সিম্বল বা চিহ্নটি স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ এঁকে দিয়েছিলেন। এখানে পদ্ম ফুল, সূর্য, জলের ঢেউ আর সাপ , প্রতিটি জিনিস এক একটি গভীর দর্শনের প্রতীক। এখানে সাপ হল যোগের প্রতীক। মিশন কিন্তু সাপের পূজা করে না। ১৬.৫.২০২৫.

 

 

আবার মুস্তাফা দর্জি 

বেশ কয়েক বছর পর আজ আবার ওনার কাছে গেলাম। সে প্রায় বছর চারেক আগে , ওনাকে নিয়ে, এই রকম  ছোট একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম; সেই নিবন্ধ পড়ে, আমার বহু পুরাতন এক বন্ধু বেশ কঠিন একটা প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। একটু অবাক হলেও, অসম্ভব মনে হয়নি। কারণ, আমার মত চোখ কান খোলা লোকেদের এই এক সমস্যা। সবই দেখি, সবই বুঝি। আমাদের অবস্থা, “ দেখন্তিক লাজ!” থাক সে কথা এখন। আমার প্রিয় পেশাদার মানুষটির সাথে অনেকদিন পরে দেখা হল। মাঝে গোটা পৃথিবীর উপর দিয়ে একটা মারাত্মক ঝড় বয়ে গেছে। 

হ্যাঁ, আমি কোভিড ঝড়ের কথাই বলছি। কত কে যে অকালে চলে গেলেন। আঠারো সালে একটি বিখ্যাত কোম্পানির বড় অফিসার এর সাথে দেখা করতে গেছলাম। বিরাট এক প্রস্তাব নিয়ে গেছলাম। কাজটা হলে, আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না; করোনা এ রাজ্যে যত প্রাণ নিয়েছে, তার থেকেও বেশি মানুষ অকালে মারা যাওয়ার থেকে বাঁচতে পারতেন। আমাদের রাজ্যের দুর্ভাগ্য; আমাদের সেই প্রস্তাব কাজে লাগেনি সময় মত। আমার মত যে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ , সেই মারাত্মক সমস্যা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরা এর মধ্যেই বুঝে গেছেন। আপনি কি জানেন? জানলেও মানেন? এই রাজ্যের নিজস্ব এন্টি ভেনম না থাকার জন্য গত সাত আট বছরে , এ রাজ্যে কত মানুষ সাপের কামড়ে মারা গেছেন! সংখ্যাটা এতটাই বেশি যে সাধারণ ভাবে বিশ্বাস করা কঠিন। করোনা এ রাজ্যে যত প্রাণ নিয়েছে, সাপের কামড় এ তার অন্তত দশ গুণ মানুষ মারা গেছেন, গত সাত আট বছরে। আমরা যে বড় কর্তার সাথে দেখা করেছিলাম, তিনিও করোনায় প্রাণ দিয়েছেন। তাঁর সেই কোম্পানী এখন আবার নতুন করে উঠে পড়ে লেগেছে। সেই সুবাদে আবার আমার মত এক নগণ্য লোকের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। আর এই জন্যই জানতে পেরেছি, সেই বড় কর্তার শেষ খবরটা। এরকম বড় কর্তার খবরই কোন কাগজে বা টিভিতে দেখিনি। তো আমার পুরনো চেনা দর্জি, আছেন কি নেই , কে তার খবর রাখে! আসলে ব্যপারটা ঠিক সে রকম নয়। আমাদের পোষাক কেনার ব্যাপারে , গত বছর ছয় সাতে একটা বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। আগে, বছরে গোটা তিনেক করে জামা আর প্যান্ট, দর্জিকে দিয়ে সেলাই করিয়ে নিতাম। সেটা কমতে কমতে গত বছর তিনেকের মধ্যে, একেবারেই শূন্য হয়ে গেল। শেষ কবে যে দর্জির দোকানে নতুন জামা প্যান্ট বানাতে ঢুকেছি, মনেই পড়ছে না। এর মূলত দুটি কারণ আমার জন্য প্রযুক্ত। প্রথম কারনটা প্রায় সর্বজনীন। রেডি মেড পোশাকের রমরমা। আমি অবশ্য “ ব্র্যান্ডেড” - এর চক্করে নেই। ব্র্যান্ডেড এর নামে , একই পোষাক সাড়ে তিন গুণ দামে কিনতে পারি না। তবুও অবস্থা বিপাকে গত তিন চার বছরে , সব পোষাকই রেডি মেড পরছি। আমি নিজে যেকটা কিনেছি, অন্যেরা তার চারগুণ কিনেছে আমার জন্য। আজও আলমারি খুললে, গোটা দুই তিন জামার প্যাকেট বেরোবে; হয়তো এক দেড় বছর আগে এসেছে, এখনও খোলাই হয়নি। যাঁরা দিয়েছেন, হয়তো ভালোবেসেই দিয়েছেন। কিন্তু একেবারেই অপাত্রে দান, বোঝাই যায়। আসলে, আর এটাই মূল কারণ; আমি লোকটা পোশাকের ব্যাপারে একেবারেই কাছাখোলা। কতবার হয়েছে, একটা জামা বা প্যান্ট পরে বেরোচ্ছি , বিয়ে বাড়ীতে যাব। আমার স্ত্রী বা ছেলে মেয়ে কেউ বলল, এটা একটা বিযে বাড়ীতে পরার মত জামা হল? তোমার কি আর জামা নেই? ব্যস্ততার মাঝেও ওরা কেউ আলমারি থেকে একটা জামা বের করে দিল। আমি যেটা পরে বেরোচ্ছিলাম তার থেকে এটা আলাদা কি , আমি বুঝলাম না। বিরাট কোন নামি কনফারেন্স এ যাওয়ার জন্য, কোট টাই পরে গেলাম। সেখানে পৃথিবী বিখ্যাত কোন শ্রদ্ধেয় মানুষ এসেছেন জেনেই, ছুটলাম স্যারকে প্রণাম করতে। স্যার কিন্তু পরে আছেন, খুবই সাধারণ একটা হাফ শার্ট! পোশাকের গুরুত্ব আজও আমি বুঝলাম না।  পৃথিবী বিখ্যাত চোখের হাসপতালের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি, পৃথিবী বিখ্যাত প্রধান সার্জন, হাসপতালের সর্বময় কর্তা, সাধারণ প্যান্ট শার্ট পরে, একটা সাধারণ স্যান্ডেল পায়ে ঢুকলেন। 

মূলত ঐ রেডি মেড পোশাকের চাপেই,  আস্তে আস্তে দর্জির দোকানে যাওয়া বন্ধই হয়ে গেল। আমার গোটা তিনেক শীতের জন্য, মোটা কাপড়ের জামা আছে। গত শীতেও সবকটা বের করতেই হয়নি। মাস ছয় হল প্রায়ই পাহাড়ের দিকে বেড়াতে যাচ্ছি। তাই মনে হল , একটা শীতের জামা করেই নিই। বেশ বড় কাপড়ের দোকানের সামনে দিয়ে সপ্তাহে দুই একবার বাজারের ভেতরের দিকে হেঁটে যাই। কদিন আগে ওদের দোকানে ঢুকে, শীতের জামার কাপড় দেখতে চাইলাম। বলল, দোতলায় আছে, চলুন দেখাচ্ছি। সেদিন কেনার জন্য যাইনি, তাই বললাম , তাহলে থাক, পরে আসবো। আজ সন্ধ্যায় বাজারের দিকে যাওয়ার সময়, আমার প্রিয় মোস্তফা দর্জির দোকান খোলা আছে কি না দেখতে উঁকি দিলাম। দোতলায় দোকান। উনি আছেন কি না দেখতে দোতলায় উঠে গেলাম। প্রায় পাঁচ বছর পরে দেখা হল। প্রায় একই রকম চেহারা আছে। কাজে ব্যস্ত ছিলেন; আমিই ভদ্রতা দেখাতে দু একটা কথা বললাম। কতটা কাপড় কিনতে হবে জেনে,  নেমে এলাম। আবার মিনিট পনের কুড়ি পরে কাপড় নিয়ে গেলাম। হাতের কাজ থামিয়ে, জামার মাপ নিলেন। রশিদ নিয়ে চলে এলাম। ছোট্ট দোকানে বসার কোন জায়গা নেই। ওনাকেও সব সময়ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে দেখেছি। তাই ভদ্রতা দেখাতে, “ বসুন” বলারও কোন সুযোগ নেই। আজও খেয়াল করলাম, যেমন গোটা কুড়ি কোট তৈরী করে ঝোলানো আছে, তেমনি কুড়ি পঁচিশটি প্যান্টও ঝুলছে। মেঝেতেও কাটা কাপড় এর একটি স্তূপ। সেলাই মেশিন নিয়ে দুজন কারিগর সেলাই করে চলেছেন। অর্থাৎ, ওনার কাজের কোন অভাব নেই। আজই কাপড় কিনতে গিয়ে সেই দোকানের দোতলায় উঠলাম। একেবারে সিঁড়ির ধাপে ধাপে জামা কাপড় স্তূপাকার করে রাখা। বিশেষ করে চোখে পড়ল, রেডিমেড জামার প্যাকেট। কয়েক হাজার হবে। কোথায় তৈরী হয় এসব? একটার রং খুব পছন্দ হল। দাম বলল, নয়শ টাকা। যাঁরা আমাকে ভালোবেসে দিয়েছেন, তাঁরা হয়তো হাজার টাকা বা বেশী দামিও দিয়েছেন। আমি নিজে কোনোদিন পাঁচশ টাকার বেশি দাম দিয়ে জামা কিনেছি বলে মনে পড়ে না। এত হাজার হাজার রেডিমেড জামা প্যান্টের জন্য বহু লোকের কর্মংস্থানের ব্যবস্থা তো হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সিংহ ভাগ এই রেডিমেড গার্মেন্টস এর থেকে আসে শুনেছি। বিখ্যাত লেখকের লেখা পড়ে জেনেছি, আমেরিকার বিখ্যাত কাপড়ের দোকানের জামার ট্যাগে, “ মেড ইন বাংলাদেশ” লেখা দেখেছেন। ওরা যদি রপ্তানি করে, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরাও নিশ্চয়ই করে। কিন্তু শুধু সেলাই মেশিন চালানোর বিরাট বিরাট কারখানার কথা আমি অন্তত শুনিনি। এ রাজ্যের হাজার হাজার শ্রমিক “ পরিযায়ী” হয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে আছে। এদের দিয়ে সেলাই করানো যাবে না? একটা খবর , একেবারে ভেতর থেকে বলতে পারি; অনেকেই হজম করতে পারবেন না। আমার এক নিকট আত্মীয়, ডেনমার্কের এক কোম্পানির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এর চাকরী করছে। বছর তিনেক হল বাংলাদেশে আছে। ওদের দেশের গণ জাগরণ বা সরকারের পরিবর্তনে , ঐ ডেনমার্কিয় কারখানায় কোন সমস্যা হয়নি। এটুকু বুঝেছি, আপনা ভালো পাগলেও বোঝে! 

অনেক তো শিবের গীত শোনালাম। কিন্তু এই মুস্তাফা দর্জির জন্য আমার এত দুর্বলতা কোথায়? আমার সেই ‘ প্রাক্তন বন্ধু ‘ লিখেছিল, “ দেশে কি আর ** দর্জি নেই!” তাঁর লেখা ঐ তারা চিহ্ন দেওয়া শব্দটি যে, কোন কোন সময় “ অশ্লীল” ভাবে ব্যবহার করা যায়, সম্ভবত সেই প্রথম বুঝেছিলাম। আমি ঐ শব্দটির দ্বিতীয় বার , অশ্লীল ভাবে প্রয়োগ করতে চাই না। কিন্তু আমার এই দর্জিকে এত পছন্দ কেন? আজই সকালে, বিখ্যাত বাগ্মী চন্দ্রিল বাবুর একটি পুরোনো বক্তৃতা, ইউটিউবে শুনছিলাম। ওনার মতে, বাঙালির সব থেকে বড় দুর্বলতা, বা ব্যর্থতার প্রধান কারণ, “ নিজের পেশার প্রতি নিষ্ঠার অভাব!” কয়েক কোটি বাঙালির মধ্যে , একটি রবীন্দ্রনাথ, একটি সত্যজিৎ বা একটি অমর্ত্য সেন! ব্যাস, তালিকা শেষ। এই ছিল , চন্দ্রিলবাবুর মূল প্রতিপাদ্য। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমার এই মুস্তাফা দর্জি মানুষটিকে পছন্দের একটিই কারণ, ওনার কাজের প্রতি নিষ্ঠা। নিজের কাজটি একশ শতাংশ সততার সঙ্গে করেন। আমার মত প্রাচীনপন্থী লোকই নয়, আমার ছেলেও ওনাকে বেশ পছন্দ করে। ব্র্যান্ডেড পোশাকের সাথেই, ওনার তৈরী পোশাকও পরে। নানান কারণে ছেলে ঐ বছর ছয়েক হল , টিটাগরে ওনার দোকানে যেতে পারছে না। কিন্তু দর্জির প্রসঙ্গ উঠলেই বলে, হ্যাঁ, সবথেকে ভালো টিটাগড়ের মুস্তাফা দর্জি! 

মজার কথা কি জানেন? ভদ্রলোকের নাম কি আমরা কিন্তু জানিনা। ওনার দোকানের একটা নাম আছে, জানি, স্ট্যাটাস টেলার। কিন্তু ওনার নাম তাহলে মুস্তাফা দর্জি হল কি করে? সেই যে , “ মর্জিনা - আবদাল্লা “ গীতি নাটকে আছেন না, “ বা - বা মু - স্তা - ফা !”  যিনি মরা মানুষ বাঁচাতে পারেন না, “কিন্তু কাটা লাশ জোড়া দিতে পারেন!” 1.11.2024.

 

 

বদ রসিক

রসিকতা আর বদ রসিকতার মধ্যে সামান্যই ফারাক থাকে। আমার গ্রামের মদন দাদার কিছু রসিকতার কথা আপনাদের বলেছি। উনি সামান্য গ্রামের চাষি ছিলেন; কোনোদিন হাইস্কুলে পড়েছেন বলে শুনিনি। এবার আপনাদের এক উচ্চ শিক্ষিত মানুষের কিছু বদ রসিকতার কথা বলি। ডাক্তারী পরীক্ষা পাশ করার মাস তিনেকের মাথায় এক ডাক্তার দাদার সাথে আলাপ হল। উনি আমাদের কলেজ থেকে পাশ করেননি। আমাদের কলেজে চাকরী করতেন। তখনকার হিসেবে একটু দূরের জেলায় আমাকে নিয়ে গেলেন, একটা শিবিরে। ঐ জেলায় আমার মাসীর বাড়ী। এক রাত মাসির বাড়িতে থাকলাম। পরে দুই দিন দুই জায়গায় শিবির করে ফিরেছিলাম। আমরা একটা ট্রাকের মত বড় গাড়ীতে , পাঁচ ছয় জন গেছলাম। ফেরার সময় জেলা শহরে সি এম ও এইচ সাহেবের বাংলোয় তাঁর সাথে দেখা করতে ঢুকলাম। গাড়ী বড় রাস্তায় রেখে আমরা দুজনেই ঢুকেছিলাম। বাকিরা গাড়ীতে বসে থাকল। সি এম ও এইচ সাহেবের বাড়ীতে আমাদের চা খেতে দিয়েছিল। সাথে কিছু নিমকি আর নাড়ু। আমরা দুজন মিনিট পনের কুড়ি কথা বলে গাড়ীতে ফিরে এলাম। গাড়ীতে আমাদের সহযোগী একটি ছেলে ছিল; একে ঐ দাদা খুব বকাবকি করতেন, আবার স্নেহও করতেন। গাড়ীতে ফিরেই দাদা,  ওকে পকেট থেকে দুটি নাড়ু বের করে দিয়ে বললেন, নে, নাড়ু খা। আমি তো অবাক। কখন উনি নাড়ু পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছেন, আমি দেখিনি। উনি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও এরকম শিবিরে যেতেন। মাঝে মাঝে আমিও গিয়েছি। ওনার একটা সমস্যা ছিল, কোথাও সময় মত পৌঁছতে পারতেন না। আমাকে হয়তো বললেন, সকাল সাড়ে ছয়টায় গাড়ী রওনা দেবে; আমি সাড়ে ছয়টা থেকে হাজির। উনি একে ডাকছেন, ওকে কিছু একটা আনতে বলেছেন। এরকম করে বেলা দশটার পর স্যাররা এলে, তাঁদের বলতেন , স্যার বলতে ভুলে গেছি, আজ অমুক জায়গায় একটা শিবিরে যেতে হবে। স্যাররা কাজ সেরে সাড়ে এগারোটায় রওয়ানা দিতেন। অন্তত দুই জায়গায়, শিবির শেষ করে সন্ধ্যা সাতটায় দুপুরের খাবার খেতে হয়েছিল।

এই দাদার একটা শখ ছিল, মিথ্যা কথা বলে লোককে সেটা সত্যি ধরে নিতে বাধ্য করা। বাস্তবে ওনার চেহারা খুবই সাধারণ ছিল। উনি যে একজন উচ্চ শিক্ষিত ডাক্তার, বলে না দিলে বোঝা যাবে না। উনি নিজেই আমাকে গল্প শুনিয়েছেন; লোকাল ট্রেনে যাতায়াতের সময় , সুযোগ পেলেই কুলী মজুরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে মজা পেতেন। একবার কয়েকজন রান্নার লোক , বড়বড় হাতা খুন্তি নিয়ে ট্রেনে চলেছিল। ভেন্ডার কামরায় মেঝেতে বসে, বিড়ি খেতে খেতে যাচ্ছিল ওরা। এই দাদাও ওদের সাথে মেঝেতে বসে বিড়ি খেতে শুরু করেন। নিজেকে চানাচুর কারখানার মজুর পরিচয় দিয়ে ওদের সাথে আলাপ জমান। চানাচুর কারখানার কাজ ছেড়ে ওদের মত বিয়ে বাড়ীতে রান্নার কাজ করতে চান, এরকম আলোচনা করতে করতে হাওড়া চলে আসেন। 

ওর পাল্লায় পড়ে একবার আমি খুব ফেঁসে গেছলাম। সকালে নটা নাগাদ হাসপাতালে কাজ করছিলাম। উনি আমাকে ধরে একটা শিবিরে নিয়ে গেলেন। শহর থেকে পঁচিশ তিরিশ মাইল মত দূরে একটা স্কুলে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাকে কাজে লাগিয়ে উনি আরও দূরের কোন শিবিরে চলে গেলেন। শীতকাল ছিল। আমি স্নান করে বেরইনি। ভাগ্যক্রমে ঐ স্কুলের বোর্ডিংয়ে আমার পরিচিত একটি ছেলেকে পেয়ে গেলাম। সে তার দাদা বা মামার কাছে একবার এসেছিল, আমাদের হোস্টেলে। ওর সাথে গিয়ে স্নান করে নিলাম। শিবিরের লোকেরা একটা রাস্তার পাশের ধাবায় নিয়ে গিয়ে তড়কা আর ভাত খাইয়ে দিল। ওরাও এক এক করে যে যার বাড়ী চলে গেল। প্রায় সূর্য ডোবার সময় হল। দাদার পাত্তা নেই। এমন সময় গ্রামের এক ভদ্রলোক মোপেড নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। আমাকে ওনার মোপেডে উঠিয়ে দেওয়া হল। তিন চার কিমি রাস্তা আসতে আসতে ওনার সাথে যেটুকু আলাপ হল। উনি বাজারে নামানোর পরে ওনার কাছে বাসের ভাড়ার জন্য তিন টাকা চেয়ে নিলাম। সন্ধ্যার পর হোস্টেলে ফিরলাম। পরদিন দাদা নির্বিকার। বললেন, ওদের তো তোকে পৌঁছে দেওয়ার কথা।

ওনার এই বদ রসিকতার জন্য একবার ওনাকে ছেলেদের হোস্টেলে ধরে এনে প্রচণ্ড রাগিং করা হয়েছিল। সে এক লম্বা কাহিনী। উনি কিন্তু ছোট বড় সবার সাথেই এরকম বদ রসিকতা করতেন। আমাদের বিভাগের চারজন স্যার একটি কোয়ার্টার নিয়ে মেস করে থাকতেন। একদিন সন্ধ্যায় এই দাদা ঐ চারজনকে নিজের কোয়ার্টারে খাওয়ার নিমন্ত্রন করলেন। ওনারা চারজন সন্ধ্যায় রান্নার মাসিকে আসতে বারণ করে দিলেন। ওনাদের কোয়ার্টার আর দাদার কোয়ার্টার দুটি আলাদা বিল্ডিং। পঞ্চাশ গজ মত দূর। রাত নটা নাগাদ স্যাররা এসে দেখেন দাদার কোয়ার্টার তালা বন্ধ। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। দোকান থেকে কিছু আনতে গেছ ভেবে ওনারা চারজন কিছুক্ষণ বিল্ডিং এর নিচে ঘোরাঘুরি করে নিজেদের কোয়ার্টারে ফিরে গেলেন। রাত দশটায় এসেও দেখেন তালা বন্ধ। এবার ওনারা বিপদের গন্ধ পেলেন। সে সময় ওদিকে একটাই দোকান ছিল; রাত দশটায় বন্ধ হয়ে যায়। ওনারা তাড়াতাড়ি গিয়ে পাউরুটি কিনে কোয়ার্টারে ফিরে তাই খেয়ে রাতের খাওয়া সারলেন। কিন্তু একটা সন্দেহ থেকেই গেল। রাত এগারোটার পর দুজন এলেন দাদার খোঁজ নিতে। ওনারা যখন ফিরে যাচ্ছেন, দাদা তখন রিক্সা থেকে নামলেন। কোথায় ছিলে জিজ্ঞেশ করলে বললেন, সিনেমা দেখে ফিরলাম। কিন্তু এতো রাত্রে ওনারা কেন এসেছেন , জানতে চাইলেন। ওখন ওনারা দুজন বললেন, “ তুমি কি আজ রাতে আমাদের নিমন্ত্রণ করেছিলে?” দাদাতো আকাশ থেকে পড়লেন। তারপর ওনাদের হাতে পায়ে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, একেবারেই ভুলে গেছেন। 

এরকম বদ রসিক মানুষ কিন্তু অনেক আছেন। এই দাদা আমাদের রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষার সর্বোচ্চ মর্যাদার পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। ঘুঘু তো বারে বারে ধান খেয়ে পার পেয়ে যায়। কিন্তু হোষ্টেলের ছাত্রেরা এদের কেমন শিক্ষা দিতে পারে, তাও আমরা দেখেছি।১৪.৪.২০২৫.

টেপিও দানা

আজ থেকে প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে একটি লেখা দেখেছিলাম। আমাদের গ্রামের মুদি দোকানে লেখা ছিল, “ এখানে টেপিও দানা পাওয়া যায়।” সেই সময় ওটা কি জিনিস, জানা হয়নি। অনেক পরে জেনেছিলাম, ঐ দানা হল, আমাদের পরিচিত সাবু দানা। তারপর বহু বছর কেটে গেছে। সেই বোঁচার দোকান নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বোধহয় পঞ্চাশ বছর আগে। এক কাল বৈশাখী ঝড় এসে একদিন সেই মাটির বাড়ীর খড়ের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেল। মাটির দেওয়াল কিছুদিন খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। একদিন সকালে দেখলাম, জমির মালিক ঘোষ বাবুদের জন চার ভাই আর কয়েকজন মজুর এসে সাবল কোদাল দিয়ে সেই দেওয়াল ভেঙ্গে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গেলেন। সেই প্রথম জানলাম, ঐ জমির মালিক আসলে ঘোষবাবুরা। ঐ দোকান লাগোয়া, হাসপতালের জমিতে একটা বিরাট ঝাঁকড়া তেতুঁল গাছের তলায় আমরা ছোট বেলায় গুল্লি খেলতাম। সেই তেঁতুল গাছ এখনও আছে। কিন্তু ডাল পালা অনেক কমে গেছে। বোঁচাদার দোকানের উঠানের কোনায় যে কয়েত বেল গাছ ছিল, সেটা কবে কাটা পড়ে, আজ আর মনে নেই। 

ভেজানো সাবু

তো সেই সাবু দানা কি করে টেপিও দানা বলে পরিচিতি পেয়েছিল, জেনেছি এই বছর খানেক আগে। একটা বিয়ে বাড়ীতে নিমন্ত্রন পেয়ে , কেরালা গেছলাম। কোঝিকোর  শহর থেকে গাড়ী করে একটু গ্রামের দিকে যাচ্ছিলাম। শহর ছাড়িয়ে মাইল তিনেক চলার পর , রাস্তার পাশের ফলের দোকানে একরকম কন্দ বিক্রী হচ্ছে দেখলাম। কোথাও কোথাও শুধুই ঐ জিনিস স্তূপাকার করে নিয়ে বসেছে। কন্দমূলগুলি কিছুটা রাঙা আলুর মত চেহারা। রং মেটে মেটে। আকারে বেশ বড়। আমার যে কুটুম্ব আমাকে গাড়ী চলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞেশ করলে বললেন, ট্যাপিওকা মূল। ডাক্তারী পড়ার সময় এই ট্যাপিয়োকা মূলের কথা একটু জেনেছিলাম। নরেশবাবু খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে বলেছিলেন, ওগুলি এখনকার দেহাতি মজুর শ্রেণীর লোকেরা খায়। সস্তার খাদ্য। এখনও বোধহয় তিরিশ টাকা কেজি দামে পাওয়া যায়। সেদ্ধ করে একটু নুন লংকা বা আচার দিয়ে খাওয়া হয়। দুদিন পর, বিয়ে বাড়ীতে নানান খাদ্যের পাশে এই ট্যপিওকা সেদ্ধও রাখা ছিল। আপ্পাম এর মত দুই একটা দক্ষিণ ভারতের বিশেষ খাদ্য ছাড়া দামী ক্যটারারের যেমন হরেক রকম ব্যবস্থা থাকে সেসব তো ছিলই। ঐ ট্যাপিওকা সেদ্ধ আছে দেখে ইকটু খেয়ে দেখলাম। একটু হলদে আভা যুক্ত আলু সেদ্ধর মত। কোন স্বাদ গন্ধ নেই। আচার দিয়ে একটু খেয়ে দেখলাম। এই জিনিসের চিপসও আলুর চিপসের মত দোকানে বিক্রী করে। এই ট্যাপিওকা থেকেই যে আমার সেই সুদূর শৈশবের “ টেপিও দানা” তৈরী হয় জেনে গেলাম। কেরালার বিভিন্ন শহর থেকে অন্য শহরে গাড়ীতে যাওয়ার সময়, রাস্তার পাশে ট্যাপিওকা চাষ দেখেছি। গাড়ী থামিয়ে, নেমে দেখা হয়নি। গাছগুলি অনেকটা ঢেঁড়স গাছের মত দেখতে। পরে ইন্টারনেট খুঁজে দেখলাম, ঐ গাছের নিচে কেমন করে চার পাঁচটা কন্দ , মুলোর মত হয়। 

সাবুদানা আমি দু রকম ভাবে খেয়েছি। খুব ছোট বেলায় জ্বর হলে ভাত খেতে দেওয়া হত না। সাবু বা বার্লি ফুটিয়ে একটা ঘন স্যুপ মত করে খেতে দেওয়া হত। একটু চিনি দিয়ে বা কখনও লেবু দিয়ে খেতাম। একাদশী বা ঐ জাতীয় কোন পার্বণে মাকে দেখতাম, সাবু দানা ভিজিয়ে খেতে। ভেজানো সাবুর সাথে কলা আর একটু গুড় দিয়ে মেখে খাওয়া, বেশ একটা উপাদেয় খাদ্য ছিল। এরপর তো এল , সাবুর পাঁপড় । অতি বিশ্রী একটি খাদ্য। ডালের পাঁপড় যতটা সুখাদ্য, এই সাবুর পাপড় ঠিক ততোটাই অখাদ্য। সস্তার ক্যাটারার আজকাল আর ডালের পাঁপড় দেয় না। আজ সকালে অনেকদিন পর আবার সাবু দানা দিয়ে তৈরী একটা খাদ্য খেলাম। রাত্রে ভিজিয়ে রাখা সাবু দানা, নানা রকম অনুপান সহযোগে কড়াইতে সামান্য তেল দিয়ে ভেজে , খিঁচুড়ি । এটাকে অবশ্য সাবুর পোলাও বললেও ভুল হবে না।

সাবুর পোলাও

 এই যে সাবুদানার প্যাকেট কেনা হয়েছে, সেই প্যাকেটের গায়ে লেখা দেখলাম, “ Taipo pearls !” বিখ্যাত মশলা কোম্পানির প্যাকেট। লেখা আছে ১৯৫৭ সাল থেকে। অর্থাৎ আমার জন্মের তিন বছর আগে থেকেই এই কোম্পানী টেপিও দানা বিক্রী করছে। আহা, আমার জন্মের আগের একটা জিনিস। ভাবলেই তো রোমাঞ্চ লাগে। ৩১.৩.২৫.

 


        পন্ডিত স্যার -এর ছেলে

   মনের কথা বলতে বলতে কদিন থেকে বেশ দূরে, একেবারে আমার এখনকার কাজের মধ্যে এনে ফেললাম। অনেকে ভাবছেন, তুমি কোথায় কি করছো তার ফিরিস্তি আমার শোনার কি দরকার। তাছাড়া আমার ফেস বুক আর হোয়াট্‌স আপ ব্যবহার করা বন্ধুরা ভাবছেন, কি সব গেঁয়ো চাষাভুষা নিয়ে কাজ লোকটার; তার আবার গল্প কিসের। আসলে শুরু করেছিলাম আমার খুব ছোট বেলার দু একটা গল্প দিয়ে। জন্মেছি মেদিনীপুরের গন্ড গ্রামে, ষোল বছর বয়স পর্যন্ত ঐ গ্রামেই কেটেছে। যতোই চাকরী সূত্রে শহরে থাকার অভ্যেস করিনা কেন, গ্রামের সংস্কার আজীবন থেকেই যায়। এখনও বাড়ী গেলেই মনে হয়, একটা গামছা নিয়ে পুকুরে লাফিয়ে পড়ি। 

     তাই আজ আবার আমার ছোটবেলার দুই খেলার সাথীর  গল্প শোনাই। বিমল আর মানস। দুজনেই আমার থেকে দু এক বছরের ছোট ছিল। আমাদের গ্রামের মাঝখানের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাঠই ছিল আমাদের খেলার জায়গা। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ওসব গ্রামে খেলা বলতে বৌ বসন্ত, লুকোচুরি এসবই ছিল। আমরা যখন ক্লাশ সেভেন বা এইটে পড়ি, হাস্পাতালের ডাক্তারবাবু, ডা অপুর্ব দাস আমাদের একটা ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি বলছি তারও কয়েক বছর আগের কথা। তখও হাস্পাতালে কোন ডাক্তারবাবু আসেননি।

       গ্রামের আট দশটা বাড়ির, বারো তেরোটা ছেলে মেয়ে বিকেল চারটা বাজতেই হাস্পাতালের মাঠে হাজির। আমাদের বাড়ি ছাড়া পন্ডিত স্যারের দুই ছেলে , এই ছিল মাষ্টারের বাড়ি, আর সব চাষির বাড়ি। হাসপাতালের কোয়ার্টারেই থাকত সুদা। বিমল আমার সমান, কিংবা একটু ছোট ছিল। ওদের বাড়িটা আমাদের বাড়ির দক্ষিনে আর পন্ডিত স্যাররা থাকতেন ঊত্তর পশ্চিমে, স্কুলের বোর্ডিং এর সাথে। বোর্ডিং এর পাশে ছোট দুটি কোয়ার্টারে ওরা ছাড়াও থাকতেন অতুলবাবুরা। অতুলবাবুর দুই ছেলেও ছিল আমাদের খেলার সাথি। মজার ব্যাপারটা হল, অতুলবাবুর পদবি ছিল পন্ডিত, আর পন্ডিত স্যারের পদবি পতি।

       বিমলের মুখটা এখনও চেষ্টা করলে মনে করতে পারি। একটু ফর্সা, গোলগাল চেহারা ছিল ওর। বোধহয় তখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ত। একদিন সকালে ওর মায়ের আর্ত চিৎকার করে কান্না শুনলাম। আমরা এতোই ছোট ছিলাম যে কেউ মারা গেলে দেখতে যাওয়ার মত সাহস হত না। পরে বহুদিন পর্যন্ত বিমলের দাদাদের কাছে শুনেছি, " বিমল টকসিন হয়ে মরেছে"। নিজে ডাক্তার হয়েও কোনদিন ওরকম কোন রোগের নাম শুনিনি।আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ঐ রকম গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা এর থেকে বেশী কিছু ছিল না। ২০১৪ সালেও হুগলীর জাঙ্গিপাড়া গ্রামীন হাসপাতালে এরকম বমি পেটব্যথা রুগীর বাড়ীর লোক " গ্যাস" হয়েছে বলে চিকিৎসা বিভ্রাট করেছে।

      সত্যিকথা বলতে কি জাঙ্গিপাড়ার ঐ রুগীর পর থেকেই আমার বার বার বিমলের কথাই মনে হচ্ছে। গত দশ বছর ধরে সাপের কামড়ে মৃত্যু নিয়ে কাজ করছি। বছর পাঁচ ছয় আগে ঐ বিমলের ছোট ভাই বিশ্বরঞ্জন ওদের একটা রাজ্য সম্মেলনে বলবার জন্য আমাকে মেদিনীপুরে নিয়ে যায়। ওখানেও এই কালাচ কামড়ের রহস্য নিয়েই বেশীরভাগ সময় বলেছি। কিন্তু এতো বছর পর বিশুরও নিশ্চয়ই  মনে হয়নি ওর দাদার সেই অপমৃত্যুর কথা।

    ঐ সন্মেলনে অতুল বাবুর দুই পুত্র, গোপী আর বিশুও ছিল। এই বিশু পন্ডিতের সমান বয়স ছিল সংস্কৃত পন্ডিত স্যারের ছোট ছেলে মানসের। মানসের দাদা তাপসদা আমাদের সাথে কোনদিন খেলেনি। আমি যখন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে,তখন পন্ডিত স্যারের হার্নিয়া অপারেশনের জন্য ওখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের বাঁকুড়ার স্যাররাও কিন্তু আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের খুব যত্ন করতেন। তাপসদা ঐ সময় এক - দু’ দিন আমার হষ্টেলে ছিল। তারপর আর ওর কোন খবর পাইনি। পন্ডিত স্যারকে নিয়ে বাঁকুড়া থেকে ফেরার কথা বেশ মনে আছে। দুর্গাপূজার ঠিক আগে আগেই স্যারকে ফিরতেই হবে। স্যার নিজের গ্রামের ওদিকে কোথাও পূজা করতেন। তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল বিশ্রী। সারা দিনে রাতে দুটি কয়লার ইঞ্জিনের প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলত। রাতের ট্রেনটা এগারোটা নাগাত বাঁকুড়ায়। পূজার ছুটিতে আমিও আসব বাড়ী। রিক্স করে ষ্টেশনে এসেই বুঝলাম পূজার ছুটির ভিড় আছে। তখন ওসব ট্রেনে রিজার্ভেশনের কোন বালাই ছিল না। সঙ্গে মা গোঁসাই ও ছিলেন। কোন রকমে মেঝেতে চাদর বিছিয়ে স্যারের জন্য শোওয়ার ব্যবস্থা হল। আজ যখন ফারাক্কা যাওয়ার জন্য জয়ন্তবাবু প্রথম শ্রেণীর রেলের টিকিট পাঠিয়ে দেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস না রেখে পারা যায়না। মনে পড়ে যায় পন্ডিত স্যারই বোধহয় পড়িয়েছিলেন, " কর্মন্যেবাধীকারস্তে........."!

      সেই পন্ডিত স্যার একবার সাইকেল সহ কাকদাঁড়ীর খালে পড়ে গেছলেন শুনেছি। জল ভর্তি ছিল খালে, তাই বেঁচে যান। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে পাকা বাড়ী বানাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা যান। 

   স্যারের ছোট ছেলে মানসকে একদিন সকালে বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম দেখতে। মানস মেঝের ওপর মাদুরে শক্ত হয়ে পড়ে আছে। পন্ডিত স্যার ওকে ধরে বিহ্বল হয়ে বসে আছেন। আজ পর্যন্ত ডাক্তারীর ছাত্র, পরে ডাক্তার হয়ে কয়েশ মৃত্যু খুব কাছের থেকে দেখলাম। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগের সেই মর্মান্তিক দৃশ্য আজও ভুলিনি। 

   কালাচ নিয়ে কয়েকশ জায়গায় বলেছি। খোলা বিছানায় উঠে ঘুমের মধ্যে কামড়ায়। আমার বাংলা সি ডি তে বলেছি, এমন কি ঘুমের মধ্যেও মারা যেতে পারে। পন্ডিত স্যার আমার সেই সি ডি শুনলে হয়তো জিজ্ঞেস করতেন, " দয়াল, আমার মানসও কি তাহলে.......?" স্যার, আপনার পড়ানো, শুক্তি রত্নাবলীর সেই শ্লোক, “  ঊদেতি সবিতা তাম্রস্তাম্র, এবাস্তমেপি চ। সম্পত্তৌ চ বিপত্তৌ চ মহতাম এক রুপতা।।“ সুর্য ওঠার সময় তামাটে, ডোবার সময় ও তামাটে। বিপদে সম্পদে মহৎ লোক একই রকম থাকে। 

      



হামার ঘর

এই হামার ঘর কথাটা মেদিনীপুরের গ্রামে খুব প্রচলিত। ধান রাখার মরাইকে বলা হত হামার। আমাদের পরিচিত সব বাড়িতেই একটি করে ধানের মরাই ছিল। এমনকি আমাদের মত একেবারেই যাদের চাষি বলা যায় না, তাদেরও একটা মরাই ছিল। এইগুলি ছিল অনেক পরিমাণ ধান জমা করে রাখার প্রকান্ড একটা পাত্রের মত। সাধারণত বাড়ীর উঠানের এক পাশে এই মরাই বা হামারগুলি থাকত। উঠানের কোনায় একটা বাঁশ আর মাটি দিয়ে তৈরি অনেকটা জল খাওয়ার গ্লাশের আকৃতির বিশাল ঘরের মত। মাথায় টোকার মত দেখতে খড়ের চাল। উপরের দিকে একটা ছোট জানালা মত। ঐ একটিই রাস্তা দিয়ে ভেতরে ধান ঢেলে রাখা হত। ধান কমে এলে, ঐ জানালা দিয়ে একজন মানুষ ভেতরে ঢুকে ধামা ভরে ধান উপরে তুলে জানালার কাছে ধরলে অন্য একজন সেই ধান ভর্তি ধামা বাইরে আনত।

মরাই এর সাথে হামার ঘরের মূল পার্থক্য হল, মরাই শুধুই ধান রাখার জন্য; কিন্তু হামারে মূলত ধান রাখা হলেও এর পাশের বারান্দা মত ছাউনি দেওয়া জায়গাগুলি সাধারণ বসবাসের জন্য ব্যবহার করা হতো। হামার ঘরগুলি গোল না হয়ে চৌকো হত। একটি বাঁশ আর মাটি দিয়ে তৈরি চৌকো ঘর। কোন দরজা নেই। মরাইয়ের মত উপরের দিকে একটি জানালা। কোন কোন হামারে এই জানালা কাঠের পাল্লা দিয়ে বন্ধ করার ব্যাবস্থা থাকত। এই চৌকো ঘরটির উপর যে খড়ের চাল দেওয়া হত সেটাই চার দিকে নেমে বারান্দার চাল হিসেবে কাজ করত। কিংবা উপর একটা চাল, আর নিচে বারান্দার জন্য আর একটা চাল, এভাবেও তৈরী করা হত। এই চার দিকের বারান্দার বাইরের দিক টা ঘিরে নিয়ে ঘরের মত ব্যাবহার করা হত। এমনকি ঐ ঘেরা বারান্দার পিছনের অংশ গোয়াল ঘরের মত ব্যাবহার করতে দেখেছি। আমি আমার বন্ধু হরেনের কথা লিখেছি। ওদের মূল বাড়ীর থেকে আলাদা একটা হামার ঘর ছিল। সেই হামারের একটি বারান্দা ঢেঁকি ঘর বা ঢেঁকি শাল ছিল। আমরা অনেকদিন ঐ হামার ঘরের বারান্দাগুলিতে লুকোচুরি খেলেছি। এরকম হামার ঘরের বারান্দায় রান্নাঘর, শোয়ার জন্য ঘর সবই ছিল, শান্তা দিদির বাড়ীতে। আমাদের কয়েকটা জমিতে যখন বোরো ধানের চাষ হত সেই সময় আমাদেরও একটা মরাই ছিল। উঠানের এক পাশে সেই ধানের মরাই অনেক বছর ছিল। সেই মরাই এর নিচে দাঁড়াশ সাপ ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। একবার এক আদিবাসী শিকারীর দল একটি মোটা শেয়ালকে তাড়া করলে সেটা প্রাণ ভয়ে হেমবাবুর হামার ঘরের নীচে লুকিয়েছিল। কিন্তু মানুষের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। শিকারীর দল ওকে ঘিরে ফেলে; তীর দিয়ে মেরেছিল। 

এই হামার ঘরের একটি মাত্র জানালা অনেকটা উপরে থাকার জন্য ইঁদুর বেয়ে উঠতে পারতো না। কিন্তু ইঁদুরের খোঁজে সাপ ঢুকেছিল, এরকম একটি ঘটনা আমার জানা আছে। আমি তখন উত্তর বঙ্গের ইটাহার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চাকরী করতাম। একদিন ঠিক সন্ধ্যার মুখে একটি সাপের কামড় এর রুগী এল। জানলাম, দুপুরে মরাই থেকে ধান বের করার জন্য জানালায় হাত দিতেই, হাতে একটা কিছু যেন হুল ফোটায়। সাপ ওরা দেখেনি। বিকেলের দিকে হাত ফুলতে শুরু করে। ওরা তখন হাসপাতালে না এসে ডা সাহা চৌধুরীকে বাড়ীতে নিয়ে যায়। উনি দেখেই বোঝেন যে ওটা বিষধর সাপের কামড়। উনি রুগীকে আমার হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। সত্যি বলতে কি, সে সময় সাপের কামড় সম্বন্ধে আমাদের প্রায় কিছুই প্রশিক্ষণ ছিল না। কিন্তু রুগী দেখেই বুঝতে পারি, বিষ ঢুকেছে। একটি মাত্র এন্টিভেনম দিয়ে রুগীকে জেলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। কদিন পরেই এক সিস্টার দিদির বাড়ীতে লক্ষ্মীপূজায় গিয়ে ডা সাহা চৌধুরীর সাথে দেখা হল। উনি জানালেন, সেই রুগীটি বেঁচে গেছে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সাপের কামড় এর ওষুধ আছে, এটা উনি জানতেন না। উনি শুধুই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আম্বুলেন্সটি  পাওয়া যাবে বলেই পাঠিয়েছিলেন। এটা প্রায় তিরিশ বছর আগের খবর। তার অন্তত দশ বছর পর আমি সাপের কামড় নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। বছর দশ -বার হল , এ রাজ্যের সবকটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সাপের কামড় এর চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু এই লেখাটি লিখতে লিখতেই কাগজের খবর পেলাম একটা, সাপে কাটা রুগী ওঝার বাড়ী গিয়ে মারা গেছে। আমার গ্রামের বাড়িতে সেই মরাই আর নেই। মাটির বাড়ী দোতলা পাকা বাড়ী হয়েছে। ঐ প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িতে এ সি লাগানো হয়েছে। ঐ গ্রাম থেকে ডেবরা গ্রামীণ হাসপতালে যেতে আধ ঘণ্টা মত লাগে। তবুও গ্রামে ওঝা আছে। গ্রামের অনেক উন্নতি হয়েছে কিন্তু এই উন্নতির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ১৬.৪.২০২৫.


মন্দির দর্শন

পঁয়ষট্টি বছর বয়স পর্যন্ত চাকরী করে গত বছর অবসর নিয়েছি। এই এক বছরে দেশের মধ্যে গোটা আটেক ট্যুর বা ভ্রমণ হল। এই বিশাল দেশে এরকম বেড়ানোর জায়গা কয়েক হাজার আছে। মোটামুটি প্রচলিত জায়গাগুলি দেখতে হলেও, আমার আরও বছর কুড়ি লাগবে। আর স্বাভাবিক নিয়মেই ঐ বয়স পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর মত সুস্থ শরীর থাকার কথা নয়। তারপর তো কথা হচ্ছে, ঐ পঁচাশি বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচেই থাকবো না হয়তো। তাই , আপাতত বছরে আট দশবার ভ্রমণে বেরোব, এরকমই চিন্তা করে রেখেছি।

গত এক বছর তো শুধু নয়, আগেও বহু জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি। বেড়ানোর জায়গা বললে, পাহাড়, সমূদ্র, জঙ্গল আর মন্দির এই চার রকমের বলা যায়। বাঙালির সহজ পাহাড় হল দার্জিলিং । সে তো অনেকদিন আগেই দেখেছি। এছাড়া সিকিমের পাহাড়ও ঘোরা হয়েছে। মধ্য ভারতের কিছু পাহাড় আর পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় ঘুরেছি। আজ মনে হল, মন্দির কি কি দেখা হল তার একটা হিসেব করে দেখি।

আজন্ম দেখে আসছি আমাদের গ্রামের মন্দির। মেদিনীপুরের ত্রিলোচনপুর গ্রামের শীতলা মন্দির। প্রতিদিনই পূজা হয়। শনি মঙ্গলবার বড় তিথি। ছোটবেলায় দেখেছি, এক এক শনিবারে চার-ছয়টা পাঁঠা বলি হয়েছে। দোলের সাতদিনের মাথায় বিরাট উৎসব হয়।

 

ছোট বেলায় কলকাতায় বেড়াতে এসে মানিকতলার কাছে পরেশনাথের মন্দির দেখতে গেছলাম। গত কুড়ি পঁচিশ বছরের মধ্যে কাউকে আর সেই মন্দিরে বেড়াতে যেতে দেখিনি। কলেজে পড়ার সময় বাঁকুড়া থেকে বিষ্ণুপুর গিয়ে ওখানকার টেরাকোটার মন্দিরগুলি দেখেছি। জানতাম ওগুলি বেশ বিখ্যাত; কিন্তু আমার তেমন বিরাট কিছু মনে হয়নি। ওখানে কোন টেরাকোটার মন্দিরে কোন বিগ্রহ দেখিনি। কলেজ থেকে দিল্লিতে পরীক্ষা দিতে গিয়ে সেখান থেকে একবার হরিদ্বার হৃষিকেশ ঘুরে এসেছিলাম। ভোরবেলা হৃষিকেশ পৌঁছে একজন গাইডের পিছন পিছন ঘুরেছিলাম। সেরকম কোন মনে রাখার মতো মন্দির দেখিনি। গঙ্গা নদী আর তার উপরে লছমনঝুলা ব্রীজ কিছুটা দেখার মত মনে হয়েছিল। হরিদ্বারে কোন মন্দিরেই সেবার যাওয়া হয় নি। পরে একবার সপরিবারে হরিদ্বারে গিয়ে অনেক মন্দির আর আশ্রম দেখেছিলাম।

বাংলার এক বিখ্যাত শিব মন্দির দেখেছিলাম আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। এক চোখের অপারেশন শিবিরে থেকে গেলাম দিন পাঁচেকের জন্য। বিকেলের দিকে তেমন কোন কাজ থাকত না। আর একটি ছেলে জুটে গেল। দু’জনে চলে গেলাম তারকেশ্বর মন্দির দেখতে। খুবই সাদামাটা একটি মন্দির। আমাদের গ্রামের মন্দির ওর থেকে বড় হবে। যাত্রী আমরা দুই জনই। সাধারণ একটি শিব লিংগ দেখে বিশেষ কিছু মনে হয়নি। ঐ রকম আর এক শিবিরে গিয়ে দেখলাম, নদিয়া জেলার শিবনিবাসের মন্দির। এত বড় শিবলিঙ্গ আর কোথাও দেখিনি।

সবাই পুরী যায়, জগন্নাথ মন্দির দেখতে। আমরাও সপরিবারে গেলাম একবার। সন্ধ্যা বেলা একজন লোক মন্দিরের গা বেয়ে উঠে, মন্দিরের চুড়ায় পতাকা পাল্টে দিল। তেমন দর্শক কিছু ছিল না। পরদিন সকালে পাণ্ডার সাথে পূজা দিতে গিয়ে দেখলাম, বেশ ভিড়। একদিন সকলে একটা গাড়ী নিয়ে চললাম ভুবনেশ্বর শহর দেখতে। সেখানে কালো পাথরের লিঙ্গরাজ মন্দির দেখলাম। তার অন্তত কুড়ি বছর পর আবার গেলাম ভুবনেশ্বর। সন্ধ্যাটা খালি ছিল। একটি সরকারী গাড়ী পেয়েছিলাম। সাথের ছেলেটি বলল, চলুন লিঙ্গরাজ মন্দির দেখে আসবেন। তাকে বললাম, ও মন্দির আমি দেখেছি, তার চেয়ে বরং চল অচ্যুত সামন্ত বাবুর ইউনিভার্সিটি দেখে আসি। যারা ভুবনেশ্বর যাবেন; সুযোগ পেলে এটি দেখে আসবেন।  সেবারই পুরী থেকে কোনারকে গিয়ে বিখ্যাত সূর্য মন্দির দেখেছিলাম।

 

বেশ প্রাচীন মন্দির, আর বেশ বড়। আর দেখেছিলাম একটি শ্বেত শুভ্র বুদ্ধ মন্দির; ধৌলাগিরি বা ধবল গিরি মন্দির।বিশাখাপত্তনম বেড়াতে গিয়ে শহরের বাইরে, পাহাড়ের উপর একটা বড় মন্দির দেখতে গেলাম। আগে ঐ মন্দিরের নাম শুনিনি। ওখানে গিয়ে জানলাম, সিমাচলম মন্দির। মন্দিরে ঢোকার স্টিলের বেড়া ইত্যাদী দেখে বুঝলাম, এক এক সময় বেশ ভিড় হয়। আমরা কিন্তু বেশ ফাঁকায় ফাঁকায় দেখে এলাম। অনেক বছর আগে দিল্লী বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম, লোটাস টেম্পল। পরে কয়েকবার দিল্লি গেলেও মন্দির দেখার মত সময় ছিল না।

 

সাপের কামড় নিয়ে কাজ করা শুরু করার পর গোটা রাজ্যেই ঘুরে বেড়িয়েছি। কয়েকটা জেলায় গিয়ে সেখানকার বিখ্যাত মন্দিরও দেখেছি। প্রথমবার কুচবিহারে গিয়ে দেখলাম, মদনমোহন মন্দির। বেশ বিখ্যাত কিন্তু মন্দির তেমন দর্শনীয় নয়। ওখান থেকে আলিপুরদুয়ার যাওয়ার রাস্তায় পড়ে একটি বিখ্যাত শিব মন্দির; বানেশ্বরl নেমে মিনিট দশেক সময় থাকলাম। খুবই সাধারণ মন্দির। মন্দিরের পুকুরে বেশ কিছু বড় বড় কচ্ছপ আছে। লোকজন ঘাটের কাছে গেলে ওরা

 

এগিয়ে আসে। পরে একবার তুফানগঞ্জে গিয়ে একটি স্থানীয় ছেলের সাথে গেলাম, চেংমারী বর্ডার দেখতে। একজন সৈনিকের সাথে, কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে অন্য পারে গেলাম; এটাই বেশ রোমাঞ্চকর। বেড়ার ঐ পারে আছে একটি মনসা মন্দির; ওরা বলল, চাঁদ সওদাগরের  মন্দির। নতুন মন্দির, দেখলেই বুঝতে পারা যায়। পূজাপাঠ কিছু হয় বলে মনে হল না।

 

এই সাপের কামড় এর কাজ করতে গিয়েই দেখা হল, বর্ধমানের একশ আট শিব মন্দির। মন্দিরগুলি খুব একটা বড় নয়, কিন্তু একটা বড় ঝিলের চার পাড়ে সুন্দর করে সাজানো। এখনও সবকটি মন্দিরে পূজা হয়।

 

এছাড়া বর্ধমান শহরের মধ্যে বুড়ো শিবের মন্দির আছে। আর বোধহয় একটি সর্বমঙ্গলা মন্দিরও দেখেছি। এরকম একশ আট বা ঐ রকম অনেক অনেক শিবের মন্দির আছে বর্ধমানের কালনায়। সাপের ক্লাশ নিতে কালনা গেলেও সেই সব মন্দির দেখা হয়নি। কাটোয়া শহরেও বার দুই যেতে হয়েছে , এরকম সাপের কামড় এর ক্লাশ নিতে। একবার একদল শিক্ষকের সাথে গেলাম , কাটোয়া থেকে একটু ভেতরে সিঙ্গি গ্রামে। এই গ্রামে জন্মেছিলেন কবি কাশীরাম দাস। একটি সাধারণ আবক্ষ মূর্তি ছাড়া আর কিছু নেই। ওর পাশের গ্রাম শ্রীপুরে বেশ কয়েকটি পুরনো মন্দির আছে। মন্দিরের গায়ের টেরাকোটার কাজ এখনও দেখা যায়। এই বাংলার মন্দিরের শহর বলা যায় নবদ্বীপকে। অনেক ছোট ছোট মন্দির, তার থেকেও বেশি আশ্রম আছে। স্টেশনে নেমে একটা রিক্সা নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম, অনেক মঠ মন্দির।  নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে অন্য পারে মায়াপুর। এখানে তো অসংখ্য মন্দির। সবথেকে বিখ্যাত ইসকনের চন্দ্রোদয় মন্দির। এই মন্দিরটি কিন্তু একটি একতলা নাট মন্দির মত ছিল। সে  সময় ওখানে সবথেকে বড় মন্দির ছিল প্রভুপাদ সমাধী মন্দির। পরে একটি বিশাল বড় মন্দির তৈরি হচ্ছে দেখেছিলাম; এখনও নির্মাণ সম্পূর্ন হয়েছে কি না জানি না।  

 

নবদ্বীপের কয়েক ষ্টেশন পরে পূর্বস্থলী। ওখানে নেমে অটো রিক্সা নিয়ে চুপী গেলাম। চুপিতে নৌকা করে মজা ভাগীরথীর খাঁড়িতে ঘুরলাম। দুপুরে স্টেশনের অন্য পারে নিয়ে গেল টোটো। বেশ কিছুটা বাগান গাছপালার ভেতর দিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম একটি আশ্রমের গেটে। নাম দেখলাম, কপিল কুটির। বেশ বড় আশ্রম।

 

পরে ইউটিউবে এরকম বহু মঠ আশ্রমের খবর দেখেছি; কোথাও যাওয়া হয়নি।

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় মশাইয়ের উপন্যাস পড়ে জেনেছিলাম, বহরমপুরে শহরের একটু বাইরে একটি বিখ্যাত কালী মন্দির আছে। পরে ওখানকার এক পরিচিত ডাক্তারের কাছে জানলাম, ওটার নাম বিষ্ণুপুর কালীবাড়ি। নরেন ক্ষ্যাপা নামের এক বড় সাধক ওখানে থাকতেন। এক ডাক্তার দাদার গাড়ী করে গিয়ে একবার দেখে এলাম।

 

সাপের কামড় এর কাজ করতেই প্রথম আসামে গেলাম। দুপুরে কাজ সেরে গৌহাটি এয়ারপোর্টে ফেরার রাস্তায় দেখে এলাম বিখ্যাত কামাখ্যা মন্দির। সেদিন মন্দির চত্বরে দুই চারজনের বেশী লোক দেখিনি। কিন্তু কয়েক বছর পর একটি বড় দলের সাথে গিয়ে দেখি বিশাল ভিড়। আমাদের দলের সকলে ভোরে লাইনে দাঁড়িয়ে বিকেলের পরে পূজা দিয়ে ফিরেছিল। আমি লাইন ছেড়ে একা একাই ভুবনেশ্বরী মন্দির আর উমানন্দ দেখে এসেছি। এবারই সন্ধ্যায় বশিষ্ঠ আশ্রম আর দুই একটা নতুন মন্দিরও দেখেছিলাম।

 

ঐ দলের সাথেই কাজিরাঙ্গা যাওয়ার সময় মাঝপথে একটা বিশাল শিব লিঙ্গের মত দেখতে মন্দির দেখে গেলাম। নাম বলল, মহা মৃত্যুঞ্জয় jমন্দির। শিলং শহরের যে পাড়ায় আমরা দুই রাত ছিলাম, সেখানেও একটা কালী মন্দির ছিল।

সাপের কামড় নিয়ে একটা কর্মশালায় যোগ দিতে ভেলোরের বিখ্যাত মেডিক্যাল কলেজে গেলাম। ওদের কলেজ থেকে হাস্পাতাল পাঁচ কিমি মত দূরে। এক বিকেলে আমরা পাঁচজন একটা গাড়ী নিয়ে ওদের হাস্পাতাল দেখতে চললাম। গাড়ীতে উঠে একজন বললেন, ভেলোরের স্বর্ণ মন্দির বিখ্যাত, চলুন ওটা দেখে যাই। দুপুর তিনটে নাগাদ পৌঁছলাম। মাথাপিছু আড়াইশ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। একটা বিশাল বড় প্রান্তরের চারদিকে প্রায় এক কিমি হেঁটে মন্দিরের সামনে পৌঁছলাম। পিতলের বিষ্ণু মূর্তি মনে হল। কিন্তু বেরোনোর রাস্তার পাশে একজন সৌম্য দর্শন মনুষের ছবি বিক্রী হচ্ছে দেখলাম। পুরুষ মানুষ, কিন্তু কি যেন একটা আম্মা বলে নাম, এটুকু মনে আছে।

প্রথমবার মধ্যপ্রদেশ বেড়াতে গিয়ে জব্বলপুরকে কেন্দ্র করে ঘুরেছিলাম। ওখানকার নর্মদা নদীর ধুঁয়াধারা জলপ্রপাত দেখতে যাওয়ার সময় আমাদের ড্রাইভার বড় রাস্তা ছেড়ে ছোলা গমের মাঠের মাঝখান দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা দিয়ে কয়েক কিমি ঢুকে একটি দেবী মন্দিরে নিয়ে গেল। সাধারণ মন্দির, কিন্তু বেড়ার গায়ে গায়ে হাজার হাজার নারকেল বাঁধা অবস্থায় আছে দেখেছিলাম।

 

জলপ্রপাত দেখে বিখ্যাত মার্বেল রকের দিকে যাওয়ার সময় একটা টিলার নিচে থেকে ড্রাইভার বলল, উপরে চৌষট্টি যোগিনী মন্দির আছে, উঠে দেখে আসতে পার। আমরা উঠিনি। জব্বলপুর থেকে বান্ধবগড় দেখে আমরা চলে গেছলাম, অমরকণ্টক । অমরকণ্টক এর নর্মদা উদগম মন্দির দেখলাম। মন্দিরের থেকে একশ মিটার দূরে কর্ন মন্দির। লাল রঙের বেশ পুরনো কয়েকটা মন্দির। এখন খুব যত্নে বাগান দিয়ে সাজানো। তপোভূমি নর্মদা বইতে ঘোষাল মশাই লিখেছেন, সে সময় ঐ মন্দির জঙ্গলে ঘেরা ছিল।

 

এ ছাড়া পাহাড়ের একেবারে মাথায় দেখলাম একটি বিশাল জৈন মন্দির। বিশাল মার্বেল পাথরের তৈরি মন্দিরটি তখনও অসম্পূর্ণ। ফেরার পথে আমাদের গাড়ী আরও গোটা দুই শিব মন্দির ঘুরিয়ে পেনড্রা রোড স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিল। ঐ শিব মন্দির দুটির একটিতে প্রায় বারো ফুট উচু শিব লিঙ্গের মাথায় জল দেওয়ার জন্য সিঁড়ি করা আছে।  ছবি খুঁজে বের করতে গিয়ে দেখি এই শিবের নাম , মহাকালেশ্বর। এই ক’মাস আগে উজ্জয়নি বেড়াতে গিয়ে জানলাম, সেখানকার বিখ্যাত শিবের নাম , 

উজ্জয়িনী তো শুধুই মন্দিরে ঠাসা। একটা আটো নিয়ে এক বেলা ঘুরে ঘুরে পাঁচ সাতটা মন্দির দেখলাম। উজ্জয়িনী, ইন্দোর , ওমকারেশ্বর আর প্রয়াগরাজ ভ্রমণের কথা আগে বিস্তৃত লিখেছি। ইন্দোর শহরের মধ্যে বিরাট অন্নপূর্ণা মন্দির দেখলেও জৈনদের কাঁচ মন্দির খোলা পাইনি। ওমকারেশর এর দুটি বিখ্যাত শিব মন্দির তো দেখলাম। পরদিন সকালে দ্বীপ পরিক্রমা করতে করতে আরও গোটা চার -পাঁচ মন্দির দেখলাম, বাইরে থেকে; সবকটি মন্দিরে ঢুকে দেখা হল না। মহেশ্বরে রাণী অহল্যা বাই এর নিজের পূজার ঘর দেখলাম। সেখানে সোনার সিংহাসনে শিব লিংগ।

 

এছাড়া দুর্গের মধ্যে বিরাট শিব মন্দির ছাড়াও আরও দুটি মন্দির দেখেছি। আমরা যখন প্রয়াগরাজ হয়ে ফিরি সেই সময় সরকারী ভাবে কুম্ভ মেলা শুরু হয়েছে। তার দিন সাতেক আগে প্রধান মন্ত্রী মেলার উদ্বোধন করে গেছেন। আমাদের অবশ্য মেলা নিয়ে সেরকম উৎসাহ ছিল না। আমরা এলাহাবাদ শহরটি ঘুরে দেখতে চেয়েছিলাম। স্টেশন থেকে একটি গাড়ী নিয়ে, শহর দেখতে চাই বলেছিলাম। প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেল হনুমান মন্দিরে। বিরাট চত্বরের মধ্যে মন্দির। মন্দির বললে আমরা যেমন বুঝি সেরকম দেখতে নয়। বিশাল নাট মন্দিরের মত। সেখান থেকে গেলাম ভরদ্বাজ আশ্রম। পুরনো আশ্রমের কোন চিহ্নই নেই; শহরের মধ্যে ঝকঝকে মার্বেল পাথরের কয়েকটা ছোট ছোট মন্দির। শহরের মধ্যে সতী মন্দিরটি কিছুটা পুরনো মনে হল। সঙ্গমে স্নান করে ফেরার সময় “ শোয়ানো হনুমানের মন্দির” দেখার কথা ছিল; রাস্তা বন্ধ থাকায় দেখা হয়নি।

২০২৪ সালেই একবার বেরিয়ে নৈনিতালের দিকে কয়েকটা জায়গা ঘুরে এলাম। জুন মাসের মাঝামাঝি ওদিকে প্রচণ্ড গরম থাকে, জানা ছিল না। ভীম তাল থেকে রানিক্ষেতের দিকে যাওয়ার পথে পড়ে ওদিককার বিখ্যাত নিব করোরি বাবার কাঁইচি ধাম। ঐ সময় মেলা চলছিল। আমরা জ্যামে আটকা পড়ে গেলাম। তিন চার কিমি রাস্তা পেরোতে ঘণ্টা দুই লাগল। ভিড় দেখে আর আশ্রমে ঢোকার চেষ্টা করলাম না। রানিক্ষেতে পৌঁছে প্রথমে গেলাম , ঝুলা দেবী মন্দিরে। মন্দির সাধারণ। সেরকম যাত্রী ও ছিল না। যেটা দেখার মত সেটা হল, বেড়ার গায়ে গায়ে হাজার হাজার পিতলের ঘণ্টা ঝোলানো।

 

দুদিন পর এর প্রায় দশগুণ ঘণ্টা দেখলাম, চিতোই গোলু দেবতার মন্দিরে। রাণীক্ষেতে আরও গোটা দুই ছোট ছোট মন্দির দেখেছি। এই চিতোই গোলু দেবতা ঠিক কোন ঠাকুর বোঝা গেল না। খুবই সাধারণ একটি মন্দির। কিন্তু গোটা চত্ত্বর জুড়ে লাখ খানেক ঘন্টা ঝুলছে। ঘন্টার সাথে নিজের নিজের মনোবাসনা লিখে একটি করে চিরকুট। মন্দিরে ঢোকার আগেই রাস্তার পাশে ডালার দোকানের মত শুধুই ঘণ্টা বিক্রীর দোকান। বিনসার থেকে কাসার দেবী আসার রাস্তায় আর একটি গোলু দেবতার মন্দিরে ঢুকে দেখে এলাম। যাত্রী প্রায় নেই।

 

কাসার দেবী খুব বিখ্যাত জায়গা। একটি ছোট পাহাড়ের উপর ছোট্ট মন্দির। মূর্তি বেশ ছোট। মন্দিরও বেশ ছোট। ঐ পাহাড়ের নাকি বিরাট কি সব মাহাত্ম আছে। কি সব মহাজাগতিক রশ্মির সমাবেশ হয় ওখানে। ঐ পাহাড়ের উপরে একটি ছোট্ট খোঁদলের মত গুহায় বসে স্বামী বিবেকানন্দ ধ্যান করেছিলেন। বাঙালি ছাড়া আর কেউ ওদিক দেখতে যায় বলে মনে হল না। ঐ পাহাড়ের উপর একটি সারদা মঠ আর একটি বৌদ্ধ মনাস্ট্রিও দেখলাম। নৈনিতালের লেকের পাড়ে নয়না দেবী মন্দিরে সবাই পূজা দিচ্ছে দেখলাম। পরদিন সকালে ঘুরতে বেরিয়ে গুরুদ্বোয়ারায় ঢুকলাম। ওখানে ঢোকার সময় মাথায় একটি ফেটটি বেঁধে ঢুকতে হল। এটাই আমাদের প্রথম শিখ ধর্মের মন্দিরে ঢোকার অভিজ্ঞতা। আর মুসলিম মাজারে ঢুকেছিলাম, মুম্বই এর হাজী আলী দরগায়। সমুদ্রের মাঝে সমাধী মন্দির।

পাহাড়ের এক বিখ্যাত সমাধী মন্দির আছে সিকিমে। সে হল বাবা মন্দির। প্রয়াত সৈনিক বাবা হরভজন সিং এর স্মৃতি মন্দিরে ঢুকে দেখে এসেছি। সেদিন বরফ ছিল না, কিন্তু রাস্তা কালো মেঘে ঢেকে গেল। আমার জীবনের সবথেকে পুরনো যে সমাধী মন্দির দেখার কথা মনে পড়ে সেটা আমাদের গ্রামের বাড়ীর পুরোহিত চন্ডি বাবুর সমাধী। ওনাকে আমি চোখে দেখিনি। ওনার সেই ছোট্ট সমাধী মন্দির আমাদের স্কুলে যাওয়ার পথের পাশে দেখতাম। সিমেন্টের সেই মন্দির কি করে একেবারে উধাও হয়ে গেছে জানিনা। শেষ বোধহয় দেখেছি পঞ্চাশ বছর আগে।

 

এই মাস দুই আগেই ঘুরে এলাম দক্ষিণ ভারতের কয়েকটা বিখ্যাত জায়গা। তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত আগেই লিখেছি। একবছর আগে আর একবার কোঝিকোর  শহরে গেছলাম। সেবারও শুনিনি যে ঐ শহরে থালি মন্দির নামে একটি বিখ্যাত মন্দির আছে। ওখান থেকে একদিনেই গিয়ে দেখে আসা যায় বিখ্যাত গুরুভায়ুর মন্দির। কিন্তু মন্দির দেখার আগ্রহ ছিল না। একইভাবে সেবার ত্রীবান্দ্রম হয়ে ফিরলেও ঐ শহরের অতি বিখ্যাত পদ্মনাভস্বামী মন্দির দেখার কোন উৎসাহ ছিল না। এবার হঠাৎ করেই, সকালে হাঁটতে বেরিয়ে থালি মন্দির দেখে এলাম। মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দেখা বা পূজা দেওয়ায় চেষ্টা করিনি। কন্যকুমারী তো লোকে যায় বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল দেখতে। আমরাও তাই করলাম। ঐ একই জায়গায় দেবীপাদ মন্দির নামে একটি মন্দির আছে; উঁকি দিয়ে দেখলাম। পরদিন সকালে একটা গাড়ী নিয়ে কন্যাকুমারী ঘুরে নাগের কোয়েল স্টেষণে ফিরলাম। কন্যাকুমারীতেই অন্তত পাঁচটি সুন্দর মন্দির দেখলাম। ফেরার পথে সূচীন্দ্রম মন্দির দেখে নিলাম। এই সুচিন্দ্রম মন্দিরের গোপূরমেই নাকি সবথেকে বেশী মূর্তি আছে।

 

মাদুরাই এর মীনাক্ষী মন্দিরের চারটি গোপুরম পৃথিবী বিখ্যাত। আমরা যখন গেলাম সে সময় ওগুলি চট দিয়ে ঘেরা, মেরামতির কাজ চলছে। ওখান থেকে মাইল দশেক দূরে আলাগিরী পাহাড়ে গোটা তিনেক মন্দির দেখে এলাম। রামেশ্বরম মন্দিরের ভেতরে ঢুকে, বিখ্যাত করিডোরের ছবিও তুলেছি। কিন্তু ওখানকার বাইশ কুন্ডের জলে স্নান করতে যাই নি। আটো নিয়ে ধনুষ্কোডির দিকে যেতে বিভিশনের মন্দির দেখলাম। রামেশ্বরমে গোটা তিনেক কুণ্ড নামের ডোবা পুকুর দেখলাম ।

আর যে দুটি বিখ্যাত মন্দিরে বাঙালি মাত্রই একবার যাবেই তাদের কথা বলে শেষ করা যাক। গয়া গিয়ে পিতৃপুরুষের পিণ্ড দেওয়া হিন্দুদের পবিত্র কর্তব্য। আমিও দাদাদের সাথে গেলাম। গোটা গয়া শহরটাই অত্যন্ত নোংরা। দেখেই একটা অশ্রদ্ধা হয়ে গেল। ওখানকার বিষ্ণু মন্দির কেমন দেখেছিলাম, একটুও মনে নেই। ওখান থেকে একটা বড় আটো নিয়ে বুদ্ধ গয়া দেখতে গেছলাম। বুদ্ধ গয়া বেশ পরিস্কার সুন্দর জায়গা। বৌদ্ধ মন্দির আর বুদ্ধ মূর্তি বেশ সুন্দর। পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচির আশেপাশে বেশ কয়েকটি বড় জলপ্রপাত আছে। আমরাও ঐ জলপ্রপাত দেখতেই গেছলাম। ওদিকের কোন একটা বিখ্যাত দেবী মন্দির লোকে দেখতে যায়। রাজারাপ্পার সেই মন্দির আমাদের দেখা হয়নি। আমাদের ড্রাইভার আমাদের নিয়ে চলল শহরের দক্ষিণ প্রান্তের জগন্নাথ মন্দির দেখাতে। একটা ছোট্ট টিলার উপর এই মন্দির। নতুন হয়েছে। মন্দিরের থেকেও দূরে , নীচে শহরটা দেখতে বেশি সুন্দর লাগে।

সিকিম বেড়াতে গেলে কিছু বৌদ্ধ মোনাষ্ট্রী দেখা হয় ; আমরাও দেখেছি।একটি মোনাষ্ট্রীতে অনেক লামা দেখেছি। কিন্তু দার্জিলিঙের রিশিহাটে যে ফার্মস্টেতে ছিলাম তার অনেকটা উপরে পাহাড়ের মাথায় একটি মনাষ্ট্রী আছে। উঠে দেখে এলাম। কিন্তু কোন মানুষজন দেখলাম না। দার্জিলিং এর ম্যাল থেকে একশ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে একটা মন্দির আছে; শিব মন্দির বোধহয়। আমরা বছর কুড়ি আগে একবার দেখেছি। পশ্চিম সিকিমের নামচি বাজারের কাছে একটা চারধাম তৈরী হচ্ছিল, সে বোধহয় বছর পনের কুড়ি আগে। এতদিনে নিশ্চয়ই পুরো তৈরী হয়ে গেছে।বেনারসে আমি যখন গেছলাম তখনও বিখ্যাত বিশ্বনাথের গলি ছিল। আজকের মত ঝকঝকে করিডোর হয়নি তখনও। বিশ্বনাথ আর অন্নপূর্ণা মন্দির দেখলাম। ঐ গলির প্রসঙ্গ এলেই আমার এক ডাক্তার দাদার কথা মনে আসবেই। সে এক আলাদা গল্প। এই দাদা অন্নপূর্ণা মন্দির এর সামনের রাস্তায়, অলৌকিক ভাবে , মা অন্নপূর্ণার প্রাসাদ পেয়েছিলেন। সেবারই সারনাথের বৌদ্ধ বিহার, স্তূপ ইত্যাদী দেখতে গিয়ে অনেক বিদেশী বৌদ্ধ তীর্থ যাত্রী দেখেছিলাম।

 

 

জম্মু কাশ্মীরের বিখ্যাত বৈষ্ণদেবী মন্দিরে আমরা যাওয়ার চেষ্টা করিনি। কাটরা ষ্টেশন হয়ে ফেরার সময় দেখেছি, শত শত যাত্রী খোঁড়াতে খোঁড়াতে ট্রেনের জন্য চলেছে। এত কষ্ট করে পূণ্য অর্জন করতে পারবো না। আর এই জন্যই তিরুপতি দর্শন করার ইচ্ছাই হয়নি। গুলমার্গে ছোট্ট টিলার উপর একটি কাঠের শিব মন্দির আছে। ওটি একবার পুড়ে গেছল। কোন এক হিন্দি সিনেমার গান ওখানে শ্যুটিং হয়েছিল, তাই খুব বিখ্যাত। দূর থেকে দেখলাম। শ্রীনগরে একটি পাহাড়ের উপর একটি শিব মন্দির দেখতে সবাই যায়, আমরাও গেলাম। চার পাঁচশ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়।

 

গোটা দেশ ঘুরে ঘুরে অনেক বিখ্যাত অখ্যাত মন্দির দেখা হল। এবার বাড়ীর কাছে ফিরে আসি। বছর কুড়ি আগে একবার হলদিয়া ঘুরতে গেছলাম। ফেরার পথে মহিষাদল রাজবাড়ীর পুরনো মন্দির দেখেছিলাম। আর দেখেছিলাম তমলুকের বিখ্যাত বর্গভীমা মন্দির।এই বরগভীমা একটি সতী পীঠ। এ রাজ্যের সবথেকে বিখ্যাত সতী পীঠ হল তারাপীঠ। প্রায় তিরিশ বছর আগে একবার গেছলাম; পূজা দিয়েছিলাম কি না মনে নেই। ঠিক করোনা অতিমারী শুরুর আগে  একবার মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গেছলাম। সেবার হাজার দুয়ারী না দেখে অন্য পারে চলে গেছলাম। ঐ পারে আর এক সতী পীঠ, নলাটেশ্বরি মন্দির দেখলাম। ওদিকেই আছে আমাদের গৃহ দেবতা প্রভু জগদ্বন্ধু আশ্রম , ডাহাপাড়া ধাম।

 

বছর কুড়ি আগে একবার সাগরদ্বীপ দেখতে গেছলাম। না, মেলার ভিড়ে যাওয়ার সাহস হয়নি। অন্য সময় দেখে বোঝা মুস্কিল যে মেলার সময় ওখানে কি ভয়ংকর ভিড় হয়। আমরা ওখানে কপিল মুনীর মন্দির দেখেছি। এখন শুনছি সমুদ্র এগিয়ে আসছে। কয়েক বছর পর হয়তো এই মন্দির আর থাকবে না।

মেদিনীপুর শহরে থাকার সময় একবার গেছলাম, কর্নগড়ের মহামায়া মন্দিরে পূজা দিতে। মেদিনীপুরের জগন্নাথ মন্দির বেশ পুরোনো, দেখেছি কয়েকবার ; ভেতরে ঢোকা হয়নি। মেদিনীপুর শহরে কেন্দ্রে বটতলা চকের কালী মন্দির বেশ বিখ্যাত। এছাড়া হবিবপুরের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরও বেশ বিখ্যাত। উত্তর দিনাজপুর জেলায় চাকরী করার সময় খুব শুনতাম পতিরামের বোল্লা কালী মন্দিরে কথা। কালী পূজার রাত্রে হাজার খানেক বলী হয় শুনেছি। কোনদিন দেখার ইচ্ছাই হয়নি। প্রথম যেদিন ইটাহার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রাত্রে ছিলাম, সেই রাত্রেই ছিল কালী পূজা। ভোর থেকে দেখলাম স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাঠ পেরিয়ে লোকে চলেছে, খড়ের খাঁচায় বলি দেওয়া পায়রা নিয়ে। রাস্তার অন্য পারে কালী মন্দির দেখতে গেলাম। তখন বলী শেষ হয়েছে। মন্দিরের উঠান রক্তে লাল।

 

আমার বর্তমান জেলা উত্তর ২৪ পরগনায় আছে বিখ্যাত লোকনাথ বাবার মন্দির। বাড়ীর কাছের দুটি বিখ্যাত মন্দির কয়েকবারই দেখেছি। দক্ষিণেশ্বর আর বেলুড়ের মন্দির। কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি রাস্তা থেকেই দেখা যায়; সেই এগারো বারো ক্লাশে পড়ার সময়  ঐ রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতাম। বালিগঞ্জে একটি বিরাট মিন্দির একবার দেখতে ঢুকেছিলাম; কি দেবতার মন্দির মনে নেই। আর কলকাতার মন্দির বললে যে কালী মন্দির বোঝায় সেটা আমার দেখা হয়নি। এখন তো আর ঐ জায়গার সেই স্থান মাহাত্ম নেই। উল্টে ঐ নামটা শুনলে কেমন এক বিতৃষ্ণা হয়। Iআমার বাড়ির থেকে হাঁটা দুরত্বে দমদমের হনুমান মন্দির; কোনোদিন ভেতরে ঢুকে দেখা হয়নি। আর এখন আমার বাড়ীর ঠিকানা বোঝাতে লোককে বলি, বড় কালী বাড়ীর কাছে। একবার একটা গাড়ী নিয়ে চাকলা আর কচুয়া ধাম ঘুরে এলাম। ঐ দিনই যাওয়ার পথে দেখে গেলাম নীলগঞ্জের নন্দদুলাল মন্দির। এই মন্দিরের কাঁঠাল প্রাসাদ নাকি কোন কোন বড় অসুখ সারিয়ে দেয়। ব্যারাকপুরের বি এন বোস হাসপাতালের কাছেই , গঙ্গার ধারে আছে, অন্নপূর্ণা মন্দির; অনেকটা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মত। কিন্তু বেশ অযত্নে আছে। বারাকপুর স্টেশনের হনুমান মন্দিরে বেশ যাত্রী হয় দেখেছি।

চাকলা ধামএরকম মাহাত্ম্য প্রায় সব কটি মন্দিরেরই কিছু না কিছু আছে। আমরা কোন মন্দিরেই কোন অলৌকিক দেখতে যাইনি। মন্দিরের ভাস্কর্য দেখতেই মূলত যাওয়া। অনেক বিখ্যাত মন্দিরেই দেখার মত তেমন বিগ্রহ নেই। এ দেশে ভ্রমণে বের হতে হলে যে দুটি রাজ্য অবশ্যই দেখতে চায় সকলে সেগুলি হল , কাশ্মীর আর আন্দামান। কাশ্মীরে একটি মন্দিরে ঢুকেছি। আন্দামানের যে মন্দির সকল ভারতবাসীর কাছে পবিত্রতম সেটা হল আমাদের মুক্তির মন্দির, সেলুলার জেল। ওটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।

 

৮.৪.২০২৫.


2024 সালের ভ্রমণ কাহিনীগুলি
Download File
বিবিধ নিবন্ধ
Download File