শুধুই সাপের কামড় নিয়ে  ছবি ও বাংলা লেখাগুলি এখানে পাবেন

নিচের ইউ  টিউব লিঙ্কে  একটি  বাং লা  ভিডিও পাবেন , ওখান থেকে  ( Description Box)  সকল ভিডিও  লিঙ্ক পাবেন।

 

কালাচ সাপ

 

রহস্যময় কালাচ সাপ

রহস্যময় কালাচ সাপ অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে কমন ক্রেট সাপ , তাই নিয়ে এখনও বহু মানুষ প্রায় কিছুই জানেন না। ২০১৪ সালে হুগলী জেলার জাঙ্গিপাড়া গ্রামীণ হাসপাতালে, ডা শোভন সিকদার একজন এই রহস্যময় সাপের কামড় এর রুগী পেয়েছিলেন। সকাল বেলা একজন ১৬ বছর বয়স এর ছেলে পেটে ব্যাথার জন্য এসেছিল। বাড়ীর লোকের ধারণা হয়েছিল, আগের রাতে ডিম ভাজা খেয়ে পেটের গন্ডগোল হয়েছে। ডাক্তার সিকদার রুগীর চোখের দিকে তাকিয়ে “ শিবনেত্র” বা ইংরেজিতে যাকে বলে টোশিস, পেয়েই নিশ্চিত ভাবে বুঝেছিলেন, এই ছেলেটিকে আগের রাতে রহস্যময় কালাচ সাপে কামড়েছে। যেহেতু এই সাপ সাধারণত গভীর রাতে বিছানায় উঠে কামড় দেয়, কামড়ে কোন ব্যাথা লাগে না, এমনকি কয়েক ঘণ্টা পর আর কোন কামড় এর দাগও দেখা যায় না, বাড়ীর লোকের ধারণা হয় ডাক্তারবাবু ভুল বলছেন।

এই ব্যাপারটি কিন্তু মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। এই ১৬ বছর বয়সের ছেলেটির ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। ডাক্তার সিকদার অনেক বুঝিয়েও অন্টিভেনম চিকিৎসা শুরু করতে পারেন নি। উনি বলেছিলেন, একে অ্যান্টি ভেনম না দিলে একটু পরে ওর শ্বাস কষ্ট শুরু হবে। হয়েছিলও তাই। ঘন্টা দুই পরে ছেলেটির শ্বাস কষ্ট শুরু হলে বাড়ীর লোক অ্যান্টিভেনম চিকিৎসায় রাজী হন। দ্রুত দশটি অ্যান্টি ভেনম চালানো হলেও রুগীকে কলকাতায় পাঠাতে হয়। কারণ ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে, ডাক্তার সিকদার ঠিকই বুঝেছিলেন যে, ঐ রুগীকে ভেন্টিলেশনে না দিতে পারলে বিপদ আছে। উনি সবকিছু লিখে, রুগীকে কলকাতায় পাঠান। রুগী কলকাতার হাসপাতালে ভর্তিও হয়েযায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রমে এ রুগী ভেন্টিলেশনে দেওয়ার আগেই মারা যায়। তাতেই সব সমস্যার শেষ হয়নি। কোন এক ডাক্তারবাবু একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে বসেন। তাঁর মতে এটি কোন সাপের কামড় -এর রুগী ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই রুগীর বাড়ীর লোকজন উত্তেজিত হয়ে যান, তাদের তখন মনে হয় ডা সিকদার ভুল চিকিৎসা করার জন্যই তাদের রুগী মারা গিয়েছে। আমদের সৌভাগ্য যে আর একজন বড় ডাক্তারবাবু রহস্যময় কালাচ সাপের কামড় এর বিষয়ে জানতেন, উনি এসে রুগীর বাড়ীর লোকের উত্তেজনা কমান। এরপর পোষ্ট মর্টেম করেও সাপের কামড় এ মৃত্যু ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়। আরও নিশ্চিত ভাবে কালাচ সাপের কামড় বোঝা যায়, বিকেলে ঐ ছেলের ঘর থেকে একটি কালাচ সাপ উদ্ধার হওয়ার পর।

এই খবর ২০১৬ সালে, পশ্চিম বাংলার স্বাস্থ্য দপ্তর প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় ও ছাপা হয়েছে।

জেলায় জেলায় ঘুরে ঘুরে নানান রকমের অনুষ্ঠান করে, আমরা বছরের পর বছর এই সব রুগীর কথা বলে, কালাচ সাপ সম্বন্ধে লোকজনকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি। এই আলিপুর দুয়ার বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংস্থার মত অনেক সংগঠন ও সারা বছর এসব অনুষ্ঠান করে চলেছেন। এখন পশ্চিম বাংলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কর্মরত প্রায় ৯০% ডাক্তারবাবু সাপের কামড় এর বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। শুধু ঐ ছেলেটিই নয়, এরকম কয়েকশ কালাচ সাপের কামড় এর রুগীর সফল চিকিৎসা হয়েছে এ সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তারপরও আমরা রুগীর বাড়ীর লোকজন এর অজ্ঞতার খবর পাচ্ছি। 

গত ২৮ .১০. ২০২১ তারিকের সংবাদ প্রতিদিন কাগজে এরকম একটি দুর্ভাগ্যজনক খবর প্রকাশিত হয়। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ধান্যকুড়িয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, সকাল বেলা একটি বছর পনের বয়সের মেয়ে চিকিৎসার জন্য আসে। বাড়ীর লোকের কথা অনুযায়ী , মেয়েটি সকালে একবার পাতলা পায়খানা করে একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। ওর পেট খারাপের চিকিৎসার জন্যই ওকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। ডা বিশ্বাস মেয়েটিকে পরীক্ষা করে দেখতে পান, শিবণেত্র। নিজের ডাক্তারী বুদ্ধিতে ডা বিশ্বাস বুঝতে পারেন যে , একবার মাত্র পাতলা পায়খানা করে এরকম একটি কিশোরী একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে এটা হয়না; নিশ্চয়ই অন্য কোন কারন থাকবে। এসময় উনি শীবনেত্র দেখে বুঝে যান যে এটি কালাচ সাপ কামড়ের রুগী। কিন্তু সেই একই রকম সমস্যা হল, বাড়ীর লোকজন বুঝতে চাননা। তারা কামড়ের দাগ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেন। ডাক্তার বিশ্বাস বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, শিবনেত্র কালাচ সাপ কামড় এর লক্ষণ। বিপদ বুঝে ডাক্তার বিশ্বাস আমাকে ফোন করে সবকিছু জানান। আমি ওনাকে জাঙ্গিপাড়া হাসপাতালের ঘটনা মনে করিয়ে বাড়ীর লোকজনকে বোঝাতে বলি। এর মধ্যে আমি ঐ জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাই। উনি ডা বিশ্বাস এর মোবাইলে ফোন করে রুগীর বাড়ীর লোকের সাথে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বাড়ীর লোকজন বুঝতে চাইলেন না। তারা লিখে দিলেন যে, তাদের রুগীর সাপের কামড় এর চিকিৎসা করার দরকার নেই। ঘন্টা তিনেক সময় নষ্ট করে, বাড়ীর লোকজন মেয়েটিকে ঐ স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ছুটি করিয়ে বড় হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেন। পথে মেয়েটি মারা যায়।

২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সাল। সাত বছরে আমার পরিচিত ব্যাক্তি ও সংগঠন মিলে অন্তত দুই আড়াইশ বার বিভিন্ন জায়গায় ২০১৪ সালের দুঃখজনক ঘটনাটি উল্লেখ করেছি। কাজ যে খুব একটা কিছু হয়নি এই সাত বছর পর ঘটা সম্পূর্ন অবাঞ্ছিত মৃত্যুর পর আমরা বেশ বুঝেছি। 

এতো গেল সাধারণ জনগণকে শেখানোর মূল্যায়ন। এবার ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে ভর্তি একজন রুগীর ঘটনা বলি। তখনও ঝাড়গ্রাম হাসপাতাল জেলা হাসপাতাল হয়নি। একদিন বিকেলে একজন ৩৭ বছর বয়সী জোয়ান মানুষ পিঠে ব্যাথার জন্য ভর্তি হলেন। সকাল থেকে মাটি কাটার কাজ করে পিঠে ব্যথা হয়েছে, এই ছিল তার রোগের ইতিহাস। রুগীকে ভর্তি করা হয় অর্থোপেডিক সার্জন অর্থাৎ অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে। উনি রুগীকে একটি ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দিয়ে শুয়ে থাকতে বলেন। ব্যাথার ইনজেকশন পাওয়ার প্রায় ৪৫ মিনিট পর রুগী জানান যে তার পেট ব্যাথা করছে। কর্ত্যবরতা সিস্টার দিদিমণি ডাক্তারবাবুকে ডেকে পাঠান। উনি এসে রুগীর কথা শুনে মনে করেন যে ব্যাথার ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে পেটে ব্যথা হয়েছে। উনি সাধারণ কথায় আমরা যাকে গ্যাস অম্বলের ওষুধ বলি, তাই দিতে লিখে দিয়ে নিজের চেম্বার এ চলে যান। আবার ঐ রকম মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর রুগী জানান, গলায় ব্যাথা করছে। আবার ঐ অর্থোপেডিক সার্জেন ডাক্তারবাবুকে ডেকে পাঠান হয়। উনি হাসপাতালে এসে রুগী দেখে, নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুকে ডাকতে বলে চলে যান। নাক কান গলার বিশেষজ্ঞ এসে রুগী দেখে লিখে যান, গলায় কোন গণ্ডগোল নেই। আবারও কিছু পরে রুগী জানান যে তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আবারও সেই অর্থোপেডিক সার্জেন হাসপাতালে আসেন। এবার উনি খুবই বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেন, এটা মানসিক রুগী, কাল সকালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবু এলে দেখিয়ে নেবেন। শ্বাস কষ্ট বলেছে রুগী, তাই অক্সিজেন এর একটা নল নাকে লাগিয়ে দিতে বলে হাসপাতাল থেকে চলে যান। রুগী শ্বাস কষ্ট বলতে বলতে আধ ঘণ্টা পরে মারা যান। এবার তো হাসপাতাল একটা জরুরী অবস্থা হয়ে গেল। ঐ দুজন ডাক্তারবাবু, হাসপাতালের সুপার, ইমার্জেন্সির ডাক্তার ম্যাডাম সবাই ছুটে এসে সুপার এর ঘরে জরুরী মিটিং এ বসলেন। এরকম একটি জোয়ান মানুষ ভর্তির ঘন্টা তিনেক এর মধ্যে কী কারণে মারা যেতে পারে, কেউই বুঝে উঠতে পারছেন না। সন্ধ্যার রাউন্ড দেওয়ার জন্য আরও কয়েকজন ডাক্তারবাবু ও এসেছেন; সকলেই সুপার স্যার এর ঘরে মিটিংয়ে কি নিয়ে আলোচনা চলছে দেখতে বসে গেলেন। এই ভাবেই, আমাকে যে ডাক্তারবাবু এই ঘটনাটা পরে বলছিলেন , উনিও এসে বসেছিলেন। এই ডাক্তারবাবু এর আগে, ঐ হাসপাতালে অনুষ্ঠিত একটি সাপের কামড় এর বিষয়ে আলোচনা সভায় কালাচ সাপ কামড় এর অদ্ভুত ব্যাপারটি শুনেছিলেন। কালাচ সাপ কামড়ের রুগিও এরকম গাঁঠে গাঁঠে ব্যথা, সারা শরীরে ব্যাথা, পেটে ব্যাথা, গলায় ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে আসতে পারে, এটা উনি জানতেন। সময়ে অন্টিভেনোম না পেলে এই সব কা লা চ কামড়ের রুগী শ্বাস কষ্ট পেতে পেতে, দম বন্ধ হয়ে মারা যান। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, যে তিনজন ডাক্তারবাবু হাসপাতালে এই হতভাগ্য রুগীকে ঐ দিন দেখেছিলেন, তারা কেউই আমাদের সেই প্রশিক্ষণ ক্লাশে ছিলেন না। এই যে ডাক্তারবাবুর প্রশিক্ষণ ছিল, উনি জানতে চান, এই রুগীর শিবোনেত্র দেখা যায় কি না। সত্যি বলতে কি, পিঠে ব্যাথা, বা পেট ব্যাথা রুগীর চোখের দিকে তাকালে যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ লক্ষণ পাওয়া যেতে পারে, এই ব্যাপারটি প্রশিক্ষণ না থাকলে জানা সম্ভব নয়। তাই এই রুগী বেঁচে থাকার সময়ে এর চোখের দিকে কোন ডাক্তারবাবু ই ভালো করে দেখেননি। শুধু শিবনেত্র দেখেই, কয়েকশ কা লা চ সাপ কামড়ের রুগী বুঝে গিয়ে তাদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন , এমন প্রশিক্ষিত বহু ডাক্তারবাবু এ রাজ্যের গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে এখনও কাজ করছেন। 

এবার এই কা লা চ সাপ কামড় এর একটি রুগীকে, শুধু নিজের অদম্য জেদ দিয়ে কেমন ভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, শালবনী গ্রামীণ হাসপাতালের ডাক্তার মহতাসিব আলম, সেই কথা বলি।  দশ বছর বয়সী একটি ছেলেকে শালবনি হাসপাতালে আনা হয় একদিন সকালের দিকে। এই ছেলেটিকে তার আগে কয়েক ঘণ্টা এক ওঝার বাড়ীতে রাখা হয়েছিল। খুব সম্ভবত এই ওঝা কালাচ সাপ কামড়ের ব্যাপারটি বুজতে পেরেই ছেলেটিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। রুগী যখন হাসপাতালে পৌঁছয় তখন তার শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছে। ডাক্তার আলম দ্রুত অ্যান্টিভেনম চালিয়ে দেন। কিন্তু রুগীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে দেখে ডাক্তার আলম ছেলেটির শ্বাসনালীতে টিউব লাগিয়ে কৃত্রিম শ্বাস চালুকরে দেন। গ্রামীণ হাসপাতালে ভেন্টিলেটর থাকে না। এই রকম রুগীকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করে সেখানে ভেন্টিলেটর মেশিন দিয়ে শ্বাস চালু রাখতে হয়। কিন্তু অনেক সময় এই সব রুগীর অবস্থা এতই খারাপ থাকে যে, শহরের বড় হাসপাতালে পৌঁছনর আগেই রুগী মারা যায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মতে এদের বড় হাসপাতালে পাঠানোর সময়, ডাক্তার আলম যে ভাবে আম্বুব্যাগ দিয়ে কৃত্রিম শ্বাস চালু রেখেছিলেন , সেভাবেই পাঠানো উচিত। শালবনী হাসপাতাল থেকে কাছের বড় হাসপাতাল হল, কুড়ি কিলো মিটার দূরের মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ। আগেও ওখানে দু এক বার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে সাপে কাটা রুগী বেড খালি পায়নি। তাই ডাক্তার আলম ছেলেটিকে সেখানে পাঠানোর আগে বেড খালি আছে কি না নিশ্চিত হতে চান। উনি আমাদের কয়েকজনের কাছে ফোন করে ব্যাপারটা দেখতে বলেন। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ আমার খুবই প্রিয়জন। ওনাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাই। উনি বললেন, বেড খালি আছে কি না একটু পরেই জানাবেন। কিন্তু বেড খালি ছিল না। অধ্যক্ষ মশাই চেষ্টা করেন, কিন্তু পাঁচ ছয় ঘণ্টা পরও কোন আই সি ইউ বেড খালি হলনা। এদিকে শলবনি হাসপাতালে ভর্তি ছেলেটির শ্বাসনালীতে টিউব লাগিয়ে কৃত্রিম শ্বাস চালু রেখে বসে আছেন ডাক্তার আলম। মেডিক্যাল কলেজে বেড খালি পাওয়ার আগে ছেলেটি স্বাভাবিক শ্বাস নিতে শুরু করে। ওকে শলবনী হাসপাতাল থেকেই সুস্থ করে ছুটি দেওয়া হয়, পরের দিন। ডাক্তার আলমের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ এই রাজ্যের কেন, এ দেশেই বিরল। আমার অন্তত জানা নেই, আজ পর্যন্ত এ দেশে কোন গ্রামীণ হাসপাতালে, এ ভাবে কোন রুগীকে বাঁচানো হয়েছে কি না। 

  আমরা ডাক্তার আলম এর এই যুগান্তকারী কাজটি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে সারা দেশে প্রচার করে চলেছি। ওনার এই উদাহরণ দেখে, পরবর্তী সময়ে আরও কএক জন ডাক্তারবাবু এরকম ভাবে সাপে কাটা রুগীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন। গ্রামীণ হাসপাতালে একটি করে পোর্টেবল ভেন্টিলেটর থাকলে আরও অনেক সাপে কাটা রুগীকে নিশ্চিন্তে বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ কথা আমি এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর এর বড় কর্তাদের চিঠি লিখে জানিয়েছি। আট নয় বছরেও সে প্রস্তাব কার্যকর করার কোন প্রচেষ্টা আমি দেখিনি।

এই যে মাত্র কয়েকটি উদাহরণ এখানে দিলাম এর থেকে একটা ধারণা করা যায় না কি যে, কালাচ সাপের কামড় এর বিষয়ে শুধু সাধারণ জনগণ নয়, ডাক্তারবাবুদের মধ্যেও প্রচুর অজ্ঞতা আছে ? আবার সামান্য একদিনের প্রশিক্ষণ পেলেই, যে কোন ডাক্তারবাবু এই সাপের কামড় এর রুগীর রোগ লক্ষণ বুঝতে পারেন। আর সময় মত চিকিৎসা করা হলে রুগী বাঁচানো সম্ভব। এখন তাহলে বোঝা যাক , এই সময় মত চিকিৎসা করার ব্যাপারটি কি! 

যে কোন বিষধর সাপের কামড় এর চিকিৎসা হল ,শরীরে যে বিষ কামড়ের জন্য ঢুকেছে তাকে অ্যান্টি ভেনম দিয়ে প্রতিহত করা, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে Neutralize করা। শরীরে বিষ ঢোকার পর থেকে ঐ বিষ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতিকর কাজ শুরু করে। কামড়ের জায়গা থেকে বিষ একটু একটু করে রক্তে মিশতে থাকে। এক এক সাপের বিষ এক এক প্রত্যঙ্গ বিকল করতে থাকে। যেমন চন্দ্রবোড়া সাপের বিষ আমাদের কিডনী নষ্ট করে। ফণা যুক্ত সাপ, গোখরো আর কেউটের বিষ খুব দ্রুত রক্তে মিশতে পারে, এদের বিষ স্নায়ুতন্ত্রকে অকেজো করে দেয়। চোখের পাতা থেকে শুরু করে দ্রুত এই স্নায়ু অকেজো করার কাজটি নিচের দিকে নামতে থাকে। বুকের পাঁজর এর সাথের মাংস পেশী আমাদের শ্বাস কার্য চালু রাখে। সাপের বিষ এই পাঁজরের পেশী অকেজো করে রুগীর দম বন্ধ করে মেরে ফেলে। 

কালাচের বিষও স্নায়ুকে অকেজো করে দম বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এদের বিষ ফণাযুক্ত সাপের বিষের মত দ্রুত কাজ করে না। 

কালাচ সাপের কামড় এর পর দুই থেকে চব্বিশ ঘণ্টা পরও চোখের পাতা পড়ে আসা, অর্থাৎ শিবনেত্র ঘটায়। এই শিবনেত্র শুরু হওয়ার দুই তিন এমনকি চার পাঁচ ঘন্টা পরও শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। তাই শিবনেত্র শুরুর পর যত তাড়াতাড়ি অন্টিভেনোম দেওয়া যায় তত বেশি সাফল্য পাওয়া যায়। সাধারণত শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেলে অন্টিভেনোম্ম দিলেও কৃত্রিম শ্বাস চালু করতে হয়। ডাক্তার আলম এটা করে দেখিয়েছেন। এখানে বলে রাখা ভালো, ফণাযুক্ত সাপের কামড় এর পর শুধুই অন্টিভেনোম দিয়ে শ্বাস কষ্ট আটকানো যায় না। Atropine ও Neostigmine injection দুটি না দিলে, ফণা যুক্ত সাপের কামড় এর রুগী প্রায় বাঁচানো মুশকিল।

কালা চ সাপ কামড় নিয়ে এত বিভ্রান্তির কারন হল, আমাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা কিছু বদ্ধমূল ধারণা। আমরা প্রায় সবাই জানি, বিষধর সাপের কামড় হলে, দুটি কামড় এর দাগ থাকবেই। কালাচ সাপের কামড় এর ব্যতিক্রম। রাত্রে ঘুমের মধ্যে কামড়ের পর সকালে, অর্থাৎ কামড় এর তিন চার ঘণ্টা পর আর কোন দাগ থাকে না। এছাড়া ফণা যুক্ত সাপের কামড় এর পর যেমন কামড় এর জায়গায় পোড়ানো ব্যথা হয়, কালাচ সাপ কামড় এ তমন কোন জ্বালা ব্যাথা হয় না। কালাচ সাপ কামড়ের এই সব বিচিত্র ব্যতিক্রমী ব্যাপার সবার জেনে রাখা দরকার।

  ডা দয়াল বন্ধু মজুমদার, জাতীয় কর্মসূচী রূপায়ণ দলের সদস্য।

 

ডা জয়ন্ত দাসের অনুবাদ করা বাংলা চিকিৎসা প্রণালী  নিচে দেখুন । PDF থেকে প্রিন্ট না করে , হাই রেজোলিউশন পোষ্টার এর জন্য আমাদের ই-মেল পাঠান।

 

বাংলা পোষ্টার
Download File
বাংলা সাপের পুস্তিকা
Download File

 

 

 

"প্রাথমিক ধারণা" পেজে আরও  অনেক ছবি আর  বাংলা ভিডিও  পাবেন।


                                  সর্পদংশনের অ আ ক খ

                                       ডা দয়াল বন্ধু মজুমদার

              আমাদের পশ্চিমবাংলায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে সাপেকাটা রোগীর চিকিৎসা হয়। একেবারে গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সব সরকারি হাসপাতালে, সকলের জন্যই বিনামূল্যে এই চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। তবুও প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যাচ্ছেন। এর কারন কি? 

         সাপেকামড়ে মৃত্যুর প্রধান কারনই হল সময় মত চিকিৎসা না করা। কেন দেরী হয়?  সাপ কামড়ানোর পর প্রথম ১০০ মিনিট সময় অত্যন্ত গুরুত্তপুর্ণ। এই সময়ের মধ্যে সাপের বিষের ঔষধ এ ভি এস ( অ্যান্টি স্নেক ভেনাম সিরাম  (চিত্র নং-..এক) ১০০ মিলি লিটার ( অর্থাৎ ১০ টি) রোগীর শরীরে দিতে পারলে, যে কোন বিষধর সাপের কামড়ের রোগীই বিপদমুক্ত হয়। 

         বাস্তবে দেখাযায় বেশীরভাগ রোগীই এই ১০০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসাকেন্দ্রে এসে পৌছয় না। এমন কি ৭-৮ ঘন্টা পরেও রোগী আসছেন। এই দেরীর একটি কারন বাড়ীর থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দূরত্ব। সাপ কামড়ের দূর্ঘটনা গ্রামাঞ্চলেই ঘটে সাধারনত। রাত্রে, বিশেষত বর্ষাকালে, গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু তার থেকেও বড় কারণ অজ্ঞতা। 

        প্রায়শই দেখা যায় সাপে কামড়ানোর পর আক্রান্ত ব্যক্তি বা বাড়ীর লোক ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করেন।এই উপেক্ষা করার মূল কারন অজ্ঞতা। আমাদের অনেক পুরাতন ধারনা হল; সাপ কামড়ালে ভয়ংকর ব্যথাযন্ত্রনা হবে, কামড়ের দাগ থাকবে, রোগী ঝিমিয়ে পড়বে। এরকম কিন্তু সব সময় হয় না।একমাত্র ফনাযুক্ত গোখরো আর কেউটে সাপের কামড়ে এরকম লক্ষণ দেখা যায়। ( চিত্র নং-দুই)

            অন্য আর দুই রকম বিষধর সাপ আছে আমাদের রাজ্যে। কালাচ আর চন্দ্রবোড়া। এই দুরকম সাপে কামড়ালে, প্রথম দিকে প্রায় কোন উপসর্গ থাকে না।বহুযুগ থেকে আমাদের ধারনা বিষধর সাপে কামড়ালে দুটি কামড়ের দাগ থাকবে, এটা ঠিক নয়। কামড়ের দাগ দুটি, একটি, আঁচড়ের মত, এরকম যা কিছুই হতে পারে।বাস্তবে দেখা যায়, কালাচ সাপের কামড়ে কোন দাগই দেখা যায় না। 

         এই সমস্ত বিভ্রান্তির থেকে বাঁচতে হলে আমাদের রাজ্যের প্রধান চার রকমের বিষধর সাপ সম্বন্ধে একটু জেনে রাখা দরকার। ( সাপের চিত্রগুলি দেখুন) ফণাযুক্ত গোখরো আর কেউটে একই রকম সাপ। ওদের কামড়ে একই রকম উপসর্গ দেখা যায়।সাধারনত দুটি কামড়ের দাগ দেখাযায়। কামড়ের সাথে সাথে প্রচন্ড জ্বালা পোড়ার মত ব্যথা হয়। জায়গাটি ক্রমশই ফুলতে থাকে  ( চিত্র নং-২)। অন্ধকারে কিসে কমড় দিল দেখাই যায় না অধিকাংশ সময়ই। কিন্তু ব্যথা আর ক্রমবর্ধমান ফোলা দেখেই বোঝাযায় ফণাযুক্ত বিষধর সাপে কামড়েছে। এছাড়া এই দু রকম সাপে কামড়ালে রোগীর কথা জড়িয়ে আসে। ক্রমশ রোগী ঝিমিয়ে আসে। চিকিৎসায় দেরী হলে রোগীর শ্বাসকার্য্য বন্ধ হয়ে যায়। এদের কামড়ে রোগীর স্নায়ুতন্ত্র অকেজো হয়ে যায়, এজন্য এদের বিষকে নার্ভবিষ বলা হয়। 

        রহস্যময় কালাচ সাপের বিষও নার্ভবিষ। কিন্তু ফণাহীন এই সাপের কামড়ে , কামড়ের জায়গায় কোন রকম ব্যথা বা ফোলা হয় না। ৯৯% ক্ষেত্রে কোন কামড়ের দাগ থাকে না। এই সাপটি প্রায় সময়ই গভীর রাত্রে বিছানায় উঠে ঘুমন্ত মানুষকে কামড়ায়। এজন্য খোলা বিছানায়, মেঝেতে ঘুমানো বিপজ্জনক। কালাচ কামড়ের রোগী প্রায়শই সকালবেলা পেটের যন্ত্রনা বলে। এছাড়া গলা ব্যথা, কোমড়ে বা গাঁঠে গাঁঠে ব্যথা নিয়েও অনেকে আসে।ছোট বাচ্চা শুধু শ্বাসকষ্ট নিয়েও আসতে পারে। পেটব্যথা, গলাব্যথা, গাঁঠেব্যথার তো অনেক কারন আছে; তাহলে সাপে কামড়েছে কি করে বোঝা যায়? সাপের কামড়ের নির্দিষ্ট কিছু রোগ লক্ষণ দেখেই ডাক্তারবাবুরা বুঝতে পারেন। কালাচ বা গোখরো জাতীয় সাপের নার্ভবিষের সুনিশ্চিত প্রমান হল শিবনেত্র বা টোশিষ (চিত্র নং- তিন ) । রোগী সাপ দেখুক বা না দেখুক, কামড়ের দাগ থাক বা না থাক, শিবনেত্র, অর্থাৎ হঠাৎ দুই চোখের পাতা পড়ে আসছে দেখেই নিশ্চিত বোঝা যায় রোগীর শরীরে নার্ভবিষ ঢুকেছে।

           এখানেই দু একটি জরুরী কথা বলা দরকার। কালাচ সাপ কামড়ের ঘটনাগুলি যেহেতু সাধারনত বিছানায় ঘুমের মধ্যে ঘটে; কামড়ের দাগ ও দেখা যায় না, তাই অনেক সময়ই বাড়ির লোককে বোঝানো যায় না যে এটা সাপের কামড়। এতে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। ( এই রকম একটি ঘটনার বিবরণ   ......নং পৃষ্ঠায় দেখুন)।

           চন্দ্রবোড়া একটি ফণাহীণ ভয়ংকর বিষধর সাপ। এদের বিষ একটু অন্য রকম। এদের কামড়ে একটু ব্যথা হলেও, প্রথমেই গোখরোর কামড়ের মত প্রচন্ড ব্যথা হয়না। জায়গাটি একটু দেরীকরে, আস্তে আস্তে ফোলে। প্রায়শই রোগী ভাবে, কাঁটা ফুটেছে বা কোন পোকা কামড়েছে। কিন্তু ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘন্টা পর থেকেই , কখনও তারও আগেই শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত বেরতে শুরু করে। যেমন, কামড়ের জায়গা, দাঁতের গোড়া, নাক থেকে, থুতুর সাথে ( রক্ত তঞ্চনের গন্ডগোলের জন্য)  পরের দিকে রক্ত প্রস্রাব ও শুরু হয়। 

          রক্ত প্রস্রাব একটি মারাত্বক লক্ষণ। বিষের প্রতিক্রিয়ায় রোগীর কিডনি নষ্ট  হতে শুরু হলেই মূত্রে রক্ত আসা শুরু হয়। দ্রুত রোগীকে এ ভি এস দিতে পারলেই কিডনি বাঁচানো সম্ভব। চিকিৎসায় দেরী হলে কিডনি নষ্ট হয়ে প্রস্রাব একেবারে বন্ধ হতে পারে।এসব ক্ষেত্রে - দিন ডায়ালিসিস লাগে। হাত বা পা ফুলে থাকে  কিছুদিন।

                                                           প্রাথমিক চিকিৎসা

             সাপ কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা বলতে কিছু হয় না। কিছু একটা কামড়েছে সন্দেহ হলেই দ্রুত নিকটের স্বাস্থকেন্দ্রে পৌঁছতে হবে। শহরের বড় হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভাল; তাতে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। 

                       বাঁধন বা টুর্নিকেট দিয়ে কোন লাভ হয় না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা, "বাঁধন দেওয়ার" কোন দরকার নেই। বাঁধনে বিষ আটকায় না। এতেও হিতে বিপরীত হয়েছে অনেক সময়।বিশেষকরে  চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের পর বাঁধন দিয়ে   হাত – পায়ে পচন ধরে যেতে পারে ( চিত্র নং চার) অনেকে , হাত বা পায়ে হাড় ভাঙ্গলে যে ভাবে নড়াচড়া বন্ধ করে বাঁধা হয়  ( Immobilization) ,সেভাবে বাঁধতে বলেন । বাস্তবে , মাঠেঘাটে সবসময় সেরকম অভিজ্ঞ লোক পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই , এই পদ্ধতিতে বাঁধার চেষ্টাও না করাই ভালো।

                      মনোবল বাড়ান : যে কোন লোককে সাপে কামড়ালেই , স্বাভাবিক ভাবেই সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই আতঙ্ক বা উদ্বেগ নানান রকম বিপদ বাড়ায়। এমনকি সাধারণ একটি নির্বিষ সাপের কামড়ের পর আতঙ্কে রুগীর হার্টের অসুখ থাকলে বেড়ে যাবে। আতঙ্ক বা উদ্বেগ আমাদের শরীরে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয় ; এতে সাপের বিষ শরীরে তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। এজন্যই  সাপের কামড়ের ব্যক্তির কাছে যারা থাকবেন , তাঁদের কাজ হবে রুগীর মনোবল বাড়ান। রুগীকে বোঝান যে ৭০-৮০ শতাংশ সাপের কামড়ই নির্বিষ সাপের কামড় । এমনকি বিষধর সাপে কামড়ালেও ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে বিষ মানুষের শরীরে ঢোকে না।  ( চিত্র নং..পাঁচ)   সব থেকে বড় কথা হল , হাসপাতালে সাপের কামড়ের ভালো চিকিৎসা আছে। 

                                                                          তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলুন

               কিছু একটা কামড়ালেই অকারন আতঙ্কিত না হয়ে বাড়ীর কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাড়াতাড়ি পৌছতে হবে। সব সময় মাথায় রাখতে হবে, প্রথম ১০০ মিনিট দারুন মূল্যবান। রোগী নিজে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে না, তাতে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সাপ মেরে বা ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই। এজন্যই সাপটিকে খোঁজার বা মেরে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন সময় নষ্ট করার দরকার নেই। সাপ দেখে চিকিৎসা হয় না ; আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ লক্ষণ দেখেই চিকিৎসা করা হয়। 

  দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল হল আদর্শ পরিবহন। ( চিত্র নং..ছয়) । গ্রামে গঞ্জে চার চাকার আম্বুলেন্স এর থেকে মোটরসাইকেল পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। গ্রামের সরু রাস্তায় চার চাকার আম্বুলেন্স এর থেকে মোটরসাইকেল অনেক স্বচ্ছন্দে চলতে পারে। মাঝে খেয়া পেরোতে হলেও মোটরসাইকেল সহজেই পের করা যায়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে মাঝে বসিয়ে , একজন পিছন থেকে তাকে ধরে বসবেন । 

    সাপে কামড়ের পর প্রথম দিকে রুগী একেবারে সুস্থ থাকলেও নিজে সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। সাইকেল চালালে শরীরে রক্ত চলাচল বেড়ে যায় , তাতে বিষ তারাতাড়ি ছড়িয়ে পড়বে। বিশেষ করে ফণাযুক্ত সাপে কামড়ালে , কিছু সমর পর থেকেই শরীর দুর্বল হয়ে আসবে ; সেক্ষেত্রে রুগী নিজে চালালে দুর্ঘটনা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা। 

           রুগীর পিছনে যিনি বসবেন তাঁর আরও কিছু জরুরী কাজ আছে। উনি রুগীর সাথে কথা বলতে বলতে যাবেন। উনি সবসময় রুগীর মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করে চলবেন। এছাড়া , হাসপাতালে পৌছনোর আগে পর্যন্ত , রুগী কখন কি কি অসুবিধা বলেছেন , সেটা ডাক্তারবাবুকে জানানোটা চিকিৎসার জন্য জরুরী। অনেক সময়ই, রুগী হাসপাতালে পৌছনোর আগেই কথা বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক কত সময় আগে পর্যন্ত কথা বলতে পেরেছেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। 

           আমাদের বহু যুগের কিছু ভ্রান্ত ধারনা আমরা ভুলতে পারছি না। সাপে কামড়ালে এখনও বহু লোকে ওঝার বাড়ী যাচ্ছেন। বিষধর সাপে কামড়ালে শরীরে যে বিষ ঢোকে, কোন মন্ত্রতন্ত্র বা গাছ গাছড়ায় বিষ নষ্ট হয়না। যত দ্রুত সম্ভব ভি এস দিয়েই চিকিৎসা সম্ভব। ওঝার বাড়ী ঘুরে আসার জন্য যেটুকু সময় নষ্ট হয় , সেটাও অনেক সময় মারাত্মক হতে পারে। 

                                                                     কয়েকটি প্রচলিত ভুল পদক্ষেপ 

   ১)     গত কয়েক বছরে আমদের রাজ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। এ জন্যই ছোট খাট সামান্য দরকারেই , আমাদের শহরে আসার প্রবনতা বেড়েছে। অন্য যে কোন রোগের ক্ষেত্রে, শহরের বড় হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা ভালো থাকতে পারে। কিন্তু এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসাই সব সময় ভালো। কারন, সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে প্রতিটা মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। শহরের বড় হাসপাতালে যেতে যদি পনের মিনিট বেশী লাগে, সেটাই প্রাণঘাতী হতেপারে।     এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্যাপারটি সম্বন্ধে অধিকাংশ মানুষের ধারনা পরিস্কার নয়। প্রথম কথা হল, ঐ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চব্বিশ ঘন্টা ডাক্তার থাকতে হবে। ওখানে রুগী ভর্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের যে কোন প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে ঐ দুটি ব্যাপারে নিশ্চয়তা আছে, সাপের কামড়ের চিকিৎসা সেখানে হবেই। অবশ্য যদি, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া বা বর্ধমানের মত  গ্রামীণ  মেডিক্যাল কলেজের দু চার কিমির মধ্যে সাপে কামড়ায়, সেক্ষেত্রে ঐসব হাসপাতালেই তাড়াতাড়ি পৌছন সম্ভব।

২) বাঁধন দেওয়া , সাপ মেরে বা ধরে হাসপাতালে আনা , ওঝার বাড়ী সময় নষ্ট করা এ সব বহুল প্রচলিত ভ্রান্ত ধারনা নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। 

৩) কামড়ের জায়গা বা তার আশে পাশে কেটে চিরে বিষ বের করার চেষ্টা মারাত্মক ভুল। এতে বিষতো বেরবেই না , উল্টে চন্দ্রবোড়া জাতীয় সাপের কামড়ে প্রাণঘাতী রক্তপাত হতে পারে। 

৪) কামড়ের জায়গা ধোওয়া বা বরফ ইত্যাদি লাগেবেন না। কুকুর বেড়াল কামড়ালে সাবান দিয়ে ধুতে বলা হয় ; সেই থেকে মনে করা হয় , যে কোন কামড়েই ধুয়ে দিতে হয়। সাপের বিষ ইঞ্জেকসন দেওয়ার মত অনেকটা ভেতরে ঢূকে যায় । ধুয়ে লাভ তো হয়ই না ; উল্টে বিষ তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। 

৫) কোন ছোপ বা কেমিক্যাল কামড়ের জায়গায় লাগাবেন না। 

৬) রুগীকে কোন রকম অনুপান বা  টোটকা ওষুধ খাওয়াবেন না। 

                                                                 পশ্চিমবাংলার বিপজ্জনক সাপ কি কি ?

          পশ্চিমবাংলায় মাত্র সাত -আট রকমের বিষধর সাপ আছে ;  তার মধ্যে মাত্র চার রকমের সাপই ৯৯ শতাংশ বিপদ্গুলি ঘটাচ্ছে। ১) চন্দ্রবোড়া ২) কেউটে , ৩) গোখরো আর  ৪) কালাচ , এই চার প্রজাতীর সাপই প্রায় সমান সমান আছে আমাদের রাজ্যে। 

  এছাড়া সমুদ্রের সাপ , শাখামুটি, শঙ্খচুড় , কৃষ্ণ কালাচ ও সিন্ধু কালাচ এই পাঁচ রকমের বিষধর সাপ এ রাজ্যে থাকলেও বছরে দু একটির বেশী কামড়ের ঘটনা ঘটেনা। 

                         সাপের কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে বা চিকিৎসার জন্যও সাপ চেনাটা খুব জরুরী নয়। তবে সাপগুলি সম্বন্ধে কিছু প্রাথমিক ধারনা থাকলে , হাসপাতালের চিকিৎসা বুঝতে সুবিধা হয়।

        এবার আমাদের বাড়ীর আশেপাশে যে বিপজ্জনক চারটি সাপ প্রায়শই দেখা যায় , তাদের নিয়ে কয়েকটি কথা।

           চন্দ্রবোড়া সাপটি একটি ফনাহীন সাপ। ( চিত্র নং.সাত)    একটু বাদামিঘেঁষা হলদেটে রঙের সাপ। গায়ে চাকা চাকা দাগ থাকে। বাড়ীর আশেপাশে ঝোপঝাড়, ফসলের মাঠে , যে কোন জায়গায়ই থাকতে পারে। ব্যাঙ ইঁদুর প্রভৃতি খাদ্যের খোঁজে ঘরের ভিতরেও চলে আসে। যে কোন সাপের মতই, আঘাত পেলে মানুষের শরীরে কামড় দেয়। এদের বিষ দাঁত বেশ লম্বা। অনেক পরিমাণ বিষ, সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে মানুষের শরীরের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়। কামড়ের দাগ থাকলেও , ফনযুক্ত সাপের কামড়ের মতো সাথে সাথেই প্রচন্ড জ্বালা যন্ত্রনা না হওয়ায় , অনেক সময়ই প্রথমে এটাকে সাপের কামড় মনে হয় না। সাধারণ কাঁটা ফোঁটা বা পোকার কামড় বলে ভুল হয়। কিন্তু এক দেড় ঘন্টা থেকে চার ঘণ্টা পরে শরীরের নানান জায়গা থেকে অস্বাভাবিক রক্তপাত শুরু হয়। কামড়ের জায়গা ক্রমশ ফুলতে থাকে। সাপ দেখতে না পেলেও, ঐ অস্বাভাবিক রক্তপাত দেখেই ডাক্তারবাবুরা রক্ত তঞ্চনের গণ্ডগোল অনুমান করেন। 

        নির্দিষ্ট করে সাপের কামড় জানা না থাকলে একটি খুব সাধারণ রক্ত পরীক্ষা করেই , মাত্র কুড়ি মিনিটেই রক্ততঞ্চনের পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় ।  20WBCT বা কুড়ি মিনিটের রক্ত পরীক্ষা ( চিত্র নং আট।) প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই , রুগীর বিছানার পাশেই  পরীক্ষাটি করা হয়, কোন ল্যাবরেটিরী দরকার হয় না। এই পরীক্ষা চার- পাঁচ বারও করার দরকার হতে পারে।

    চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের চিকিৎসায় দেরী হলে রুগীর কিডনী নষ্ট হয়। মুত্রে রক্ত দেখা গেলেই বোঝা যায় , কিডনী আক্রান্ত হয়েছে। সেক্ষেত্রে বড় হাসপাতালে গিয়ে ডায়ালিসিস করাতে হয়।

    গোখরো সাপ : - ( চিত্র নং.৯ ) ফণাযুক্ত এই সাপটির অঞ্চলভেদে আরও কয়েকটি নাম আছে । মেদিনীপুর জেলায় বলে খরিশ সাপ। মালদায় বলে গোমা সাপ। এই সাপের ফণার পিছনে গোরুর খুরের মত বা খড়ম চিহ্ন থাকে। 

   কেউটে সাপ : - ( চিত্র নং.১০) এদের ফণার পিছনে একটি পদ্ম ফুলের মত চিহ্ন থাকে। ফণাযুক্ত এই সাপটিরও অঞ্চলভেদে আরও কয়েকটি নাম আছে । কালো সাপ , টক সাপ , কাল কেউটে , শামুকভাঙ্গা সাপ , ঝাংলাই প্রভৃতি। ফণাযুক্ত এই দু রকমের সাপই আমাদের রাজ্যে প্রায় সমান সমান সংখ্যায় দেখা যায়। এদের বিষ তীব্র নার্ভ বিষ। দু রকমের সাপেরই থাকার জায়গা , স্বভাব চরিত্র , কামড়ের রোগ লক্ষণ , চিকিৎসা একই। এজন্যই প্রাণীবিদ্যার শ্রেণীবিভা্গে আলাদা হলেও , চিকিৎসার ক্ষেত্রে এদের একই সাপ বলে ধরা হয়।  কোন সাপে কামড়েছে দেখতে না পেলেও , কামড়ের প্রায় সাথে সাথেই প্রচন্ড জ্বালা , পোড়ানোর মত যন্ত্রনা , আর কামড়ের জায়গা দ্রুত ও ক্রমবর্ধনাম ফোলা দেখেই বোঝা যায় , ফণাযুক্ত সাপে কামড়েছে। 

  কালাচ সাপ :- ( চিত্র নং.১১)  ফণাহীন এই সাপটিও আমাদের রাজ্যে প্রচুর সংখ্যায় আছে। এটি মারাত্মক বিষধর একটি সাপ। এই সাপটিরও অঞ্চলভেদে আরও কয়েকটি নাম আছে । কালচিতি, ডোমনা চিতি, শিয়রচাঁদা , ঘামচাটা এসব নামেও এদের পরিচয় আছে। কালো রঙের সাপটির গায়ে সরু সরু সাদা চুড়ির মত দাগ বা ব্যান্ড থাকে , লেজের শেষ পর্যন্ত। এরা সাধারণত রাতের বেলায় বেরয় । এদের এক বিচিত্র স্বভাব হল , এরা খোলা বিছানায় উঠে আসে। এজন্য একটি কথা চালু আছে যে, এরা বোধহয় ঘামের গন্ধে মানুষের কাছে চলে আসে ( এই জন্য ঘামচাটা নাম)। কালাচের কামড়ের রুগীদের প্রায় আটানব্বই শতাংশই রাত্রে ঘুমের মধ্যে ঘটে। এদের কামড় বেশ রহস্যজনক । মারাত্মক নার্ভ বিষ হলেও , এদের কামড়ে একটুও ব্যথা যন্ত্রনা হয়না। কামড়ের জায়গা ফুলে ওঠে না। এমন কি কামড়ের কয়েক ঘন্টা পর থেকে কামড়ের দাগও খুঁজে পাওয়া যায় না। 

      কালাচ সাপের কামড়ের রোগ লক্ষণও রহস্যময়। সাধারণত রুগী সকালে পেটে ব্যথা নিয়ে আসে। তাছাড়াও গলা ব্যথা, গাঁঠে গাঁঠে ব্যথা, গলা বসে যাওয়া , সারা শরীর দুর্বল লাগা , মাঠে কাজ করতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়া , বাচ্চাদের শ্বাস কষ্ট , এরকম বিচিত্র সব রোগ লক্ষণ নিয়ে বিপদটা শুরু হয়। ডাক্তারবাবুরা নার্ভবিষের প্রধান লক্ষণ , শিবনেত্র বা টোশিশ ( চিত্র নং..৩) দেখেই বুঝতে পারেন যে , এটি কালাচের কামড়। যেহেতু ঘুমের মধ্যে কামড়ায় , রুগী জানতেই পারে না যে তাকে সাপে কামড়েছে । ডাক্তারবাবুরা , সাপে কামড়েছে , বলার পরও অনেক সময়ই রুগী বা তার বাড়ীর লোক মানতে চাননা। কামড়ের দাগ খুঁজতে গিয়ে চিকিৎসায় মারাত্মক দেরী হয়ে যায়। এরকম একটি ঘটনার বিবরন পরে দেওয়া হল। ( চিত্র নং-16)

      নির্বিষ সাপের সাথে অনেক সময় বিষধর সাপের নামের বা চেহারার কিছু মিলের জন্য বিভ্রান্তি দেখা যায় । সব থেকে বেশী বিভ্রান্তি দেখা যায় কালাচ আর ঘরচিতি সাপের মধ্যে। দুটি সাপের নামের মধ্যে চিতি কথাটি আছে।  এছাড়া দুটির গায়েই  চুড়ির মত ব্যান্ড আছে। ছবিতে দেখলেই পরিস্কার বোঝা যায় , চুড়িগুলির পার্থক্য আছে। কালাচের চুড়ি লেজের শেষ পর্যন্ত থাকে , আর ঘরচিতির লেজের কাছে কোন ব্যান্ড নেই। ( চিত্র নং.১২)

                                                   বিষধর সাপে কামড়েছে কিনা কি করে অনুমান করবেন ? 

কামড়ের দাগ :- যুগ যুগ ধরে চলে আসা কিছু ভ্রান্ত ধারণা আমাদের ভুলতে হবে। দুটি কামড়ের দাগ মানেই বিষধর সাপের কামড় , এই ধারনা ঠিক নয়। কালাচের কামড়ে দাগ নাও পেতে পারেন। আবার গোখরো কেউটে বা চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে একটি বা দুইয়ের বেশী দাগও পেতে পারেন। ছবিতে দেখুন , কেউটে সাপের কামড়ে একটি চেরা দাগ দেখা যাচ্ছে। ( চিত্র নং.১৩) । আরেকটি ছবিতে দেখুন , ( চিত্র নং-৫)  , পরিস্কার দুটি কামড়ের দাগ ; অথচ এই রুগির শরীরে কোন বিষের লক্ষণই আমরা পাইনি। অর্থাৎ , কামড়ের দাগ দেখে আমরা নির্দিষ্ট করে কিছুই বুঝব না। 

   বিষ ঢোকার লক্ষণগুলি কি কি : - সাপ দেখতে পাওয়া যাক বা না যাক, কামড়ের জায়গায় জ্বালা যন্ত্রনা আর ক্রমবর্ধমান ফোলাই বিষ ঢোকার প্রথম লক্ষণ। ফণাযুক্ত সাপে কামড়ালে খুব তাড়াতাড়ি রুগীর শরীরে নার্ভ বিষের লক্ষণ দেখা যাবে। হঠাৎ দুই চোখের পাতা পড়ে আসা , অর্থাৎ শিবনেত্রই নার্ভ বিষের নিশ্চিত লক্ষণ। ( চিত্র নং.৩.) । ফণাযুক্ত সাপে কামড়ালে খুব তাড়াতাড়ি রুগী ঝিমিয়ে পড়বে, কথা জড়িয়ে যাবে। কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া বা একেবারে নিস্তেজ হয়ে যেতে পারে। 

   চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে প্রথম দিকে এতোটা জ্বালা যন্ত্রনা বা ফোলা নাও থাকতে পারে। কামড়ের জায়গা বা শরীরের অন্য যে কোন স্থান থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ দেখেই সন্দেহ করা হয় , শরীরে চন্দ্রবোড়া সাপের বিষ ঢুকেছে। হয়তো একটি টিটেনাসের ইঞ্জেকসন দেওয়ার পর জায়গাটি ফুলে যাচ্ছে। দাঁতের গোড়া, নাক , পুরনো কোন ঘা থেকে রক্ত বেরতে পারে। থুতুর সাথে, বমির সাথে বা প্রস্রাবে রক্ত আসতে পারে। 

    প্রথম দিকে একটু সন্দেহ থাকলে ডাক্তারবাবু 20WBCT ( চিত্র নং.৮) পরীক্ষাটি করে দেখে নিতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডাক্তারবাবু , কোন পরীক্ষা ছাড়াই চন্দ্রবোড়া সাপের কামড় বুঝতে পারেন। পরীক্ষা করার জন্য কুড়ি মিনিট সময় নষ্ট করাটাও রুগীর কিডনীর পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে। দরকার হলে , পরীক্ষার জন্য রক্ত টানা হলেই , স্যালাইনে এ ভি এস চালিয়ে দেওয়াটা বাঞ্ছনীয়। 

    কি কামড়েছে দেখতে না পেলেও , কিছু একটা কামড়ের পর , বমি করা , শরীরে বিষ ঢোকার একটি লক্ষণ। 

          কালাচের কামড়ের সব কিছুই বিচিত্র। সাধারণ পেটে ব্যথার চিকিৎসায় সাড়া না দিয়ে , শিবনেত্র হলেই নিশ্চিত ভাবে ধরে নিতে হবে , কালাচ সাপে কামড়েছে। আগের রাত্রে মেঝেতে ঘুমানো , পরে পেট ব্যথা গলা ব্যথার মত সাধারণ রোগ লক্ষণ ,প্রচলিত চিকিৎসায় সাড়া না দেওয়া ; অবশেষে , শিবনেত্র হলেই নিশ্চিত ভাবে ধরে নিতে হবে , কালাচ সাপে কামড়েছে । এক্ষেত্রে কোন পরীক্ষা নিরিক্ষার সুযোগ নেই। 

                                                          প্রাথমিক হাসপাতালের চিকিৎসা 

            রুগী প্রথমে যে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসবে , সেখানেই অবশ্যই ভর্তি করতে হবে। প্রথমেই নিশ্চিত বিষ ঢোকার লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তখন শুধু অবজারভেশন বা নিরিক্ষার জন্যই ভর্তি রাখা হয়। আমাদের রাজ্যের সরকারী চিকিৎসা বিধির ফ্লো চার্ট বা চিকিৎসা সারনী মেনে সাপের কামড় -এর চিকিৎসা বেশ সহজ। যে কোন সাপের কামড়ের সন্দেহ হলেই , রুগীকে ভর্তি করা হয়। যতক্ষন না নিশ্চিত ভাবে বোঝা যাচ্ছে যে শরীরে বিষ ঢুকেছে, একটি সাধারণ স্যালাইন আস্তে চালানো থাকবে।

বিষ শরীরে ঢুকেছে বোঝা মাত্রই চালু স্যালাইনের ভেতরে দশটি এ ভি এস মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই এভি এস যুক্ত স্যালাইন দ্রুত চালানো হয়। 

  আমাদের দেশে যেহেতু পলিভ্যালেন্ট এ ভি এস ই পাওয়া যায়, সেজন্য সব সাপের কামড়েই একই ওষুধ। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও একই পরিমান এ ভি এস দিতে হবে। কিন্তু স্যালাইনের পরিমান আর অন্নান্য ওষুধ-পত্র , বাচ্চার শরীরের ওজন মত নির্ধারণ করতে হবে। ( ফ্লো চার্টে দেখুন)। ( চিত্র- নং – ১৪)

              এই এ ভি এস আসলে ঘোড়ার সিরাম। তাই মানুষের শরীরে এর কিছু  পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করার জন্য ওষুধ পত্রের নির্দেশ ও দেওয়া আছে। তবে সব ক্ষেত্রে হাসপাতলগুলোতে যেমন যেমন সরবরাহ থাকে, আর ডাক্তারবাবুর বিবেচনার ওপর নির্ভর করবে কোনটি কতোটা প্রয়োগ করবেন। 

          খুব মারাত্মক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হাজারে একটাও হয়না।

   সাধারনত মুখ মন্ডল , গলা বা বুকে আমবাতের মত চাকা বের হয়। রুগী ঘোরের মধ্যে থাকলেও মাথা চুলকাতে থাকে। বমি করা বা হঠাৎ রক্ত চাপ কমে যাওয়া একটু উদ্বেগের কারণ হয়। যে কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া একটি মাত্র , সামান্য দামের, অ্যাড্রেনালিন ইনজেশন দিলেই পাঁচ সাত মিনিটে ঠিক হয়ে যায়।  এই পাঁচ সাত মিনিট ঐ এ ভি এস যুক্ত স্যালাইন বন্ধ রাখতে হয়।

   ফণাযুক্ত সাপে কামড়ালে আরও কয়েকটি ইনজেশন খুবই জরুরী। দুই চোখের পাতা পড়ে আসা , অর্থাৎ শিবনেত্রই নার্ভ বিষের নিশ্চিত লক্ষণ। তাই শিবনেত্র দেখলেই আগে একটি আট্রোপিন ইঞ্জেকসন রুগীর শিরায় দেওয়া হয় ( Intra venous). এর পর তিন মিলি লিটার নিওস্টিগমিন ইঞ্জেকসন রুগীর শিরায় কিংবা পেশীতে (  Intra Muscular)  দেওয়া হয় ।  IV  নাকি IM দেওয়া হবে , সেটি ডাক্তারবাবু রুগীর অবস্থা বিবেচনা করে ঠিক করেন। এই দুই ইঞ্জেকসন , ফণাযুক্ত সাপের কামড়ে অত্যন্ত ভালো কাজ করে ।  এই দুই ইঞ্জেকসন-এর বদলে একই রকম কাজের  একটি ইঞ্জেকসন ও পাওয়া যায় ; সেখানে আট্রোপিন-এর বদলে গ্লাইকোপাইরোলেট ওষূধটি নিওস্টিগমিন-এর সাথে মেশানো থাকে।   এমনকি যেখানে এ ভি এস নেই , সেখানেও দূরের হাস্পাতালে যাওয়ার আগে একটি এই মিশ্র ইঞ্জেকসন রুগীর শিরায় দেওয়া হলে , ফনা যুক্ত সাপের কামড়ে , নার্ভ অকেজো হওয়া (  Paralysis )  কিছুটা দেরী করে হয়। 

   প্রথম দশটি এ ভি এস দেওয়ার এক ঘন্টা পর , ডাক্তারবাবু রুগীর অবস্থা বিবেচনা করে , আরও দশটি দিতে পারেন। বিশেষ করে চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে , মোট তিরিশটি এ ভি এস ও দরকার হতে পারে। 

                                                           শহরের বড় হাসপাতালে কেন যেতে হয়  (Referral)

        নার্ভ বিষের সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে , যদি দেরী করে চিকিৎসা শুরু হয় , রুগীর শ্বাস কার্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিপদ থাকে।  ডাক্তারবাবু রুগীর অবস্থা বিবেচনা করে , বড় হাসপাতালে পাঠাতে পারেন। রুগীর শ্বাস কার্য বন্ধ হয়ে গেলে , মেশিনের সাহাহ্যে শ্বাস কার্য চালু রাখতে হয়  ( Ventilation)। ঐ মেশিন সব থেকে কাছের যে ঊচ্চতর হাসপাতালে আছে , সেখানেই রুগীকে পাঠানো হয়। এ ক্ষেত্রে , ঐ  ঊচ্চতর হাসপাতালে আগেই ফোন করে জানিয়ে রাখতে পারলে খুব ভালো হয়। 

  চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে রুগীর কিডনী বিকল হওয়ার সম্ভাবনা আছে মনে করলে , যে হাসপাতালে ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা আছে , সেখানেই রুগীকে পাঠানো হয়।     

                                                                 পরীক্ষা নিরিক্ষা (  laboratory Test)

  সাপের কামড়ের চিকিৎসার জন্য রুগীর রোগ লক্ষণই আসল । অধিকাংশ  ক্ষেত্রে কোন পরীক্ষা নিরিক্ষা দরকারই হয় না। একমাত্র চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে রক্ততঞ্চনের পরীক্ষাটি  ( 20WBCT)  রুগীর বিছানার কাছেই করা সম্ভব ; এর জন্য কোন ল্যাবরেটরী লাগে না। রুগীর কিডনী বিকল হওয়ার সম্ভাবনা আছে মনে করলে কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা করার দরকার পড়ে , এগুলিও আমাদের রাজ্যের সব সরকারী হাসপাতালেই বিনামূল্য করা হয়।

       অপারেশন ( Surgery)

      কামড়ের জায়গায় ঘা থেকে গেলে বা পচন ধরলে কিছু ছোটখাট অপারেশন দরকার হতে পারে। ( চিত্র-নং-১৫) যে কোন জেলা স্তরের হাস্পাতালেই তা করা সম্ভব । এসব ক্ষেত্রে , কিংবা অনেক ফোলা থেকে গেলে , কিছু আন্টিবাইওটিক অষুধ দেওয়ার দরকার হয়। ফোলা কমানোর জন্য ম্যাগ্নেসিয়াম সালফেটের পটি ভালো কাজ দেয়। 

          উপসংহার – সাপের কামড়ের চিকিৎসায় সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন । এজন্যই সবথেকে কাছের যে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চব্বিশ ঘন্টা ডাক্তারবাবু থাকেন , সেখানেই দ্রুত , রুগীকে নিয়ে চলুন। পশ্চিমবাংলার সকল সরকারী হাস্পাতালে , সাপের কামড়ের সব রকম চিকিৎসা বিনামূল্যেই হয়। এছাড়াও সরকারী হাস্পাতালে , সাপের কামড়ের রুগী মারা গেলে , বিপর্যয় ব্যবস্থাপন দপ্তর (  Disaster Management) থেকে , এক বা দু লাখ টাকা অনুদান পাওয়া যায়। এই অনুদানের জন্য , বি ডি ও আপিসে বিপর্যয় ব্যবস্থাপন আধিকারিকের সাথে যোগাযোগ করতে হয়।    

 

                                    


প্রদীপের তলায় অন্ধকার

আজ দুটি ব্যাপার আবার আমার কাছে পরিষ্কার করে দিল, প্রদীপের তলায় অন্ধকার, কেমন হয়। এই কদিন আগে কুড়ি পঁচিশ পাতার একটা লেখা তৈরী করে আমার পরিচিতদের কাছে পাঠিয়েছিলাম। আমার দেখা মন্দিরগুলি নিয়ে লিখেছিলাম। একশ মত মন্দিরের কথা লিখেছি। সাথে কুড়ি পঁচিশ বা তারও বেশি মন্দিরের ছবি দিয়েছি। আজ বিকেলে দমদম স্টেশনের দিকে যেতে গিয়ে দেখি, একজন যুবক, আমাদের আবাসনের কৃষ্ণ মন্দিরের দিকে ঝুঁকে নমস্কার করছে। মনে পড়ল, এই মন্দিরের কথা লেখা হয়নি। 

এই মন্দিরটি সম্বন্ধে কিছু কথা আছে। দু হাজার বারো সালে আমরা যখন এই আবাসন দেখতে আসি, তখন দুই তিন তলা মত উঠেছে। এই জায়গাটা কেমন ছিল , দেখা হয়নি। পাশেই একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া গুল কারখানা ছিল। এদিকেও ঐ কারখানার কিছু জমি ছিল। আর বোধহয় একটা ডোবা পুকুর ছিল। ঐ ডোবা পুকুর থেকে নাকি এই কৃষ্ণ মূর্তি পাওয়া যায়। পাথরের, নীল রঙের মূর্তিটি কিন্তু অক্ষতই ছিল। আগে কোথায় ছিল? কোনোদিন কোথাও পূজা হত কি না, কিছুই জানি না। আবাসনের নিচের তলায়, সিঁড়ি আর লিফটের জায়গা রেখে, পিছন দিকে ছয় ফুট লম্বা আর পাঁচ ফুট চওড়া একটি জায়গা থেকে যায়। প্রোমোটার ঐ জায়গায় কৃষ্ণ ঠাকুরের জন্য একটি ঘর করে দেন। আমরা এসে থেকেই দেখছি, ঐ মন্দির বা ঠাকুর ঘরে, ফুট তিনেক উঁচু এই কৃষ্ণ মূর্তি। আবাসন আমাদের কাছে হস্তান্তরের পর বছর দুই জন্মাষ্টমী উদযাপন উপলক্ষে বেশ একটু উৎসব উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, প্রোমোটারের পয়সায়। তারপর আর প্রোমোটারের দেখা পাওয়া যায় নি। আবাসনের কিছু ভক্তের উৎসাহে এখনও জন্মাষ্টমী উদযাপন করা হয়। একজন পুরোহিত প্রতিদিন দুপুরে এসে পূজা করে যাচ্ছেন। আমরাই মাসিক চাঁদা দিয়ে মন্দিরের পূজার ব্যবস্থা চালু রেখেছি। অথচ আমার মন্দির দর্শনের তালিকায় এই কৃষ্ণ মন্দিরের কথাই বেমালুম ভুলে গেছি। 

গতকালই বিকেলে আমার প্রিয় ডাক্তার ভাই শুভেন্দু ফোন করেছিল। এই শুভেন্দুকে আমার পরিচিত লোকজন প্রায় সকলেই চেনেন। বিশেষ করে আমাদের সাপের কামড় এর কাজ নিয়ে যারা একটু আধটু খবর রাখেন তাঁরা সবাই শুভেন্দুকে চেনেন। দিন তিনেক আগেই স্বাস্থ্য ভবনে সাপের কামড় নিয়ে কিছু পরিকল্পনার জন্য একটি মিটিং হল। সেখানেও শুভেন্দুর মত সাপের কামড় চিকিৎসার বিখ্যাত কিছু ডাক্তারবাবুকে নিয়ে একটি মেন্টর গ্রুপের কথা ভাবা হল। এই শুভেন্দু এখন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে কাজ করছে। বছর তিনেক হল শুভেন্দু আমাদের মতোই জেলা শহরে ঘুরে ঘুরে নতুন ডাক্তারদের সাপের কামড় এর প্রশিক্ষণ দিতে যাচ্ছে। 

শুভেন্দু ফোনে যে খবরটি দিল, সেটা শুনেই আমার মনে হল, একেই বলে, প্রদীপের তলায় অন্ধকার! 

শুভেন্দু আগে যেখানে কাজ করেছে সেই ডেবরা হাস্পাতাল এখনও সাপের কামড় এর চিকিৎসা বেশ ভালো করে। কদিন আগেই দুই মহিলা ডেবরা গ্রামীণ হাসপতালে ভর্তি হয়েছিলেন। রাত্রে একই বিছানায় মশারী ছাড়া শুয়েছিলেন। সকালে উঠে বমি করেন। পেটের গণ্ডগোল ভেবেই হাসপতালে আসেন। কিন্তু ডেবরা গ্রামীণ হাসপতালে ডাক্তার বাবুরা রোগ লক্ষণ দেখেই বুঝতে পারেন, এদের দুই জনকেই কালাচ সাপে কামড়েছে। বয়স্ক মহিলার চিকিৎসা ডেবরাতেই শুরু হয়। ওনাকে সাপের কামড় এর ওষুধ এন্টি ভেনম দিয়ে , মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। গণ্ডগোল এখানেই শুরু হয়েছে। আপনাদের হয়তো মনে আছে, হুগলীর জঙ্গিপাড়া গ্রামীণ হাসপতালে একটি ষোল বছর বয়সী ছেলেকে সাপের কামড় এর চিকিৎসা করে কোলকাতার মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হলে, বড় ডাক্তারবাবু অবাঞ্ছিত মন্তব্য করে ব্যাপার জটিল করে তুলেছিলেন। অবশ্যই পরে প্রমাণিত হয় যে, জঙ্গিপাড়ায় ঠিকই চিকিৎসা হয়েছিল। এই ডেবরা হাস্পাতাল থেকে পাঠানো বয়স্ক মহিলার ক্ষেত্রেও একই রকম অবাঞ্ছিত মন্তব্য করেছেন, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের বড় পণ্ডিতেরা। এই মহিলা কিন্তু সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে গেছেন। কিন্তু বছর তিরিশের মহিলাকে পাঁচ তাঁরা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে, বড় বড় পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায়নি। রুগী এখনও ভেন্টিলেশনে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের বড় পণ্ডিতেরা বেয়াড়া মন্তব্য করায় এই মহিলার সাপের কামড় এর চিকিৎসা করা হয়নি। 

শুভেন্দু যে সাপের কামড় এর একজন দিকপাল, দূরের জেলায় জেলায় প্রশিক্ষণ দিতে যাচ্ছে, এসব খবর কিন্তু মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বা অন্যরা সবই জানেন। কিন্তু আজও মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে একটা সাপের কামড় নিয়ে শিক্ষা মূলক আলোচনার ( CME ) ব্যবস্থা করা হয়নি। আমরা আবারও শুভেন্দুকে জেলায় জেলায় প্রশিক্ষণ দিতে পাঠাবো। প্রদীপের তলায় অন্ধকার থেকেই যাবে! ২৯.৪.২০২৫.

গতকাল ৯ই জুলাই, ২০২৫, কোলকাতা দূরদর্শনে শুভেন্দু আর আমি  , সাপের কামড় নিয়ে আলোচনা করলাম। দূরদর্শনের ইউটিউব চ্যানেলে অনুঠানটি দেখতে পারেন। লিংক এখানে।  

 

 




থ্রী ডি

   ইংরেজী পি অক্ষরটা তিনবার লিখে, অর্থাৎ পি থ্রি বলে একটা বেশ নামকরা কোম্পানী ছিল; তাদের গেঞ্জী আমি কিনেছি। এখন আর ওদের নাম শোনা যায় না। পরে এই তিনটে পি দিয়ে আরও কিছু কথা শুনেছি। এখন এই “পি পি পি” বললে আমরা বুঝি, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ। সরকারী হাসপতালের মধ্যে সিটি স্ক্যান, MRI এসব এর ব্যবস্থা; কিন্তু চালায় বেসরকারি কোম্পানি। প্রথম দিকে বাজারের থেকে সস্তায় এসব জায়গায় পরীক্ষা করা যেত। এখন তো সবটাই বিনামূল্যে; ভিখারী জমিদার সবার জন্যই।

     এই তিনটে পি এর মত তিনটে ডি বা থ্রি ডি বললে আমরা বুঝি থ্রি ডাইমেনশনাল। একটা ছবি দেখে যদি তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা বোঝা যায়, তখন তাকে থ্রি ডি বলা হয়। এই তিনটে ডি দিয়ে একটা ভালো জিনিস আজই জানলাম। আমাদের সাপের কামড় নিয়ে আলোচনার একটা ভারত বিখ্যাত হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ আছে। এ দেশের চোদ্দ পনেরোটা রাজ্যের ছাড়াও, নেপাল বাংলাদেশ -এর বিখ্যাত সব ডাক্তার -বিজ্ঞানী, সমাজ কর্মী আছেন সেই গ্রুপে। আজ হাওড়ার এক গ্রামীণ হাসপাতালের এক ডাক্তারবাবু একটি বিষধর চন্দ্র বড়া সাপের ছবি দিয়ে জানিয়েছেন যে, ওটি হাসপাতালের একটি বেডের তলায় ঢুকে ছিল। হাসপাতালে কি করে সাপ ঢুকল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা শুরু হল।

      কর্ণাটকের সর্পবিদ নাগভূষণ সুন্দর একটা কথা লিখেছেন। উনি লিখেছেন ডি থ্রি মেনে চললে এসব অবাঞ্ছিত ঘটনা আটকানো যায়। উনি যা যা করতে বলেছেন, আমরাও বছরের পর বছর ওসব কথা বলে আসছি। এদের যে এভাবে তিনটে ডি দিয়ে, সহজে মনে রাখার মত করে বলা যায়, আগে ভেবে দেখিনি। স্বাভাবিক ভাবেই গ্রুপের অনেকেই এই থ্রি ডি ব্যাপারটা অনেক বিস্তৃত লিখতে বলেন। উনি লিখলেন, Deny Entry, Deny Food chain আর Deny shelter. ব্যাপারটি খুব কঠিন নয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা এর এক অনাও মেনে চলি না। 

      যে কথাগুলি নাগভূষণ ইংরেজীতে লিখেছেন, আমরা একটু নিজের ভাষায় বোঝার চেষ্টা করি। প্রথম কথাটা হল, সাপকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া চলবে না। শহরে বসে কথাটা বলে দেওয়া যতো সহজ, গ্রামে এটা মেনে চলা ততো সহজ নয়। গ্রামে, বিশেষ করে মাটির বাড়িতে সাপের ঢুকে পড়া আটকানো প্রায় অসম্ভব। গ্রামের বাড়ি গুলি একেবারে চাষের জমির মধ্যে না হলেও, বাগান বা ঝোপ ঝাড় দিয়ে ঘেরা থাকে। এই সব ঝোপ ঝাড় বা বাগান, ব্যাঙ আর ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের স্বাভাবিক থাকার জায়গা।  সাপেদেরও। এই সব গাছ পালা ঝপ ঝাড় বাড়তে বাড়তে এক সময় বাড়ীর দরজা জানালায় চিলে আসে। বিশেষ করে বাড়ীর পিছনের দিকের জানালা বেয়ে লতা গাছের উঠে আসা খুবই স্বাভাবিক। এছাড়া মাটির মেঝেতে ইঁদুরের গর্ত , ফাটল এসব তো আছেই। সাপেরা সহজেই ঘরে ঢুকে যায় । বারান্দায় , উঠানে , কলতলায় ঘুরে বেড়ায়। এই ভাবেই সাপের গায়ে পা পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। মানুষের থাকার জায়গায় সাপ চলে না এলে , সাপের কামড়ের দুর্ঘটনাও কমবে। বন জঙ্গল ছেড়ে সাপ যেন ঘর বাড়ীতে ঢুক্তে না পারে , সেটা দেখতে হবে। এ নিয়ে একটা ভুল ধারনা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ঘরে একটা কার্বলিক আসিডের বোতল রাখলেই আর সাপ ঘরে আসবে না। ভয়ংকর ভুল ধারনা। গোটা বাড়ির চারপাশে আসিড ছড়ালে হয়তো সাপের ঘরে ঢোকা আটকাতে পারে; বাস্তবে কি তা সম্ভব?  আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ঘরে একটা পোষা দেশী কুকুর থাকলে , সাপের ঘরে ঢোকা আটকায়। বেড়ালও তাই।  ছোটকেল নামের একটি দেশী কুকুর কেমন করে একটি বড় চন্দ্রবোড়া সাপকে আটকে রেখেছিল , সে কথা আগেও কয়েকবার লিখেছি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে এক সন্ধ্যায় একটি চন্দ্রবোড়া সাপ ঢুকতে গেলে, পোষা কুকুরটি তাকে আটকে রেখেছিল প্রায় এক ঘন্টা। কুকুরের অদ্ভুত ডাক শুনে দাদা আলো নিয়ে বেরিয়ে সাপটিকে দেখতে পায় । সাপ যাতে সহজে ঘরে ঢুকে আসতে না পারে সেটা দেখতে হবে, এটা হল প্রথম ডি।

   দ্বিতীয় ডি হল Deny food chain. Food chain বা খাদ্য শৃঙ্খল আটকাতে হবে। সাপের স্বাভাবিক চরিত্র হল মানেষের থেকে দূরে থাকা। প্রাণী মাত্রেরোই খাদ্যের দরকার হয়। সাপের খাদ্য ইঁদুর আর ব্যাঙ। যেখানে ইঁদুর আর ব্যাঙ থাকে সাপ সেখানে চলে আসে শিকার ধরতে। ইঁদুর আসে ধান, চাল, ডাল খেতে। গ্রামের বাড়িতে বারান্দায় এই সব খাদ্য শস্য ছড়ানো ছিটানো থাকে, তাই অনেক ইঁদুর ঘরে বারান্দায় থাকে। সপেরাও ইঁদুর ধরতে আসে; বিপদ তখনই ঘটে। ঘরে বারান্দায় ভাত মুড়ি পড়ে থাকলে সেসব খেতে পোকা মাকড় আসে। ঐ পোকা মাকড় খেতে আসে ব্যাঙ। কালাচ্ জাতীয় সাপও পোকা মাকড় খেতে আসে। তাই এই খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিলে সাপ ঘরে ঢুকে আসার সম্ভাবনা কমে।

      তিন নম্বর ডি হল, Deny shelter; সাপ যেন লুকিয়ে বসে থাকার মত জিনিস আর জায়গা না পায়। ঘরে বারান্দায় অপ্রয়োজনীয় বা বাতিল জিনিসপত্র জমিয়ে রাখা আমাদের একটা বাজে অভ্যাস। সাপ কোন একটা সুযোগে ঝোপ ঝাড় থেকে উঠে এসে এই সব লুকানোর জায়গা খুঁজে আশ্রয় নেয়। চাষের জিনিস, খড় বিচালী, কলাই গাছ, তিল গাছ উঠানে, বারান্দায় জমানো থাকলে সাপ সেখানে আশ্রয় নেয়। উঠানে বড় গাছ থাকলে তার তলায় শুকনো পাতা জমতে থাকে। এই শুকনো পাতা নিয়মিত ঝাঁট দিয়ে সরিয়ে নিতে হবে। এই হল আমাদের নাগভূষণের ডি থ্রী বা থ্রী ডি ফর্মুলা। 

      সাপেদের সাথে মানুষের সংস্পর্শের আরও অনেক জায়গা বা সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে চাষের জমিতে আর মাছ ধরতে গিয়ে সাপের কামড় -এর সংখ্যাই বেশী। আমন ধান কাটার সময় দক্ষিণবঙ্গে প্রচুর চন্দ্রবোড়া সাপের কামড় ঘটছে। ধানের মাঠে কাজ করার সময় এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। ধান কাটার আগে একটা লাঠি বা গাছের ডাল দিয়ে কিছুটা ধান গাছ নেড়ে নিলে সাপ ওখান থেকে সরে যাবে। ছোট চাষীদের পক্ষে সম্ভব না হলেও, আজকাল ধান কাটার মেশিন ব্যবহার করে এই বিপদগুলি এড়ানো সম্ভব হচ্ছে। 

       অন্ধকার রাস্তায় চলা খুবই বিপজ্জনক। হাতে একটা আলো নিয়ে পথ চলা নিরাপদ। কালাচের কামড় থেকে বাঁচার জন্য মশারী টাঙিয়ে বিছানায় ঘুমানো উচিত। মেঝেতে খোলা বিছানায় ঘুমানো উচিত নয়; এতে কালাছ সাপ কামড়ের বিপদগুলী হয়। 

  এই যে পরামর্শ দেওয়া হলো, এগুলি সবই সাপের কামড় যাতে না হয় তার ব্যবস্থা। সাপে কামড়ালে সময় নষ্ট না করে দ্রুত কাছের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হবে।


 How the 5 cases of different types managed :

( See the cases in the "S.B Study material " page)

 

All these cases are from our records; see the managements given to each individual cases .

Case No.1.

 B. Hazra was successfully managed at Habra S G Hospital in Oct 2007. He was immediately admitted and IV fluid started. IV infusion of 15 vials of Polyvalent ASV was given within 45 minutes. Inj. Atropin IV and Inj. Neostigmine IM were given simultaneously. The Pt. Opened his eyes within 40 mins and could tell his name after 45 mins, could walk to other bed after 75 mins. Inj. Adrenaline ( 0.5 ml) was given IM as some urticarial rashes were noted on his throat and chest after completion of ASV drip. Recovered completely and was discharged in the afternoon.

 Case  No.2.

 B Manna was managed at Debra BPHC in April 2010. He was admitted in the BPHC , and IV ASV was started . 10 vials of ASV were infused in 1 hr. 20WBCT was normal after infusion of AVS. The pt. was not transferred to any higher center as there were no clinical abnormalities; blood test from outside shown normal renal function. Pt. was discharged after 2 days.

Case  No. 3. 

T Bag attended a private NH at Mecheda in Sept 2009. Artificial ventilation was started by Ambu bag and a fluid was started. Neurotoxic snake bite was diagnosed by typical history (including floor bed). 10 vials of AVS were infused in the ambulance when the pt. was being transferred to Kolkata with Ambu bag support by one OT support staff , Mr Srikanta Jana. Pt. survived after artificial ventilation for 5 days in a private hospital of Kolkata. One Common Krait snake was recovered from the room where the boy slept last at home.

Case  No. 4. 

This boy was managed at Habra S G Hospital in Nov. 2007. All ligatures were released after IV fluid was started. No progress of local swelling was noted; swelling subsided within one hour. 20WBCT was normal. No ASV was given as it was a case of non venomous snakebite. Pt. discharged after 24 hours.  

Case No.5. 

This boy was managed at Bishnupur S D Hospital in March 2012. Pt. admitted and a plain drip started. 20WBCT test was done on admission, and repeated thrice in one hr. Intervals. No clotting abnormality note.  Diagnosed as a dry bite, pt. discharged on the next day.