শুধুই সাপের কামড় নিয়ে  বাংলা লেখাগুলি এখানে পাবেন

 

কালাচ সাপ

 

রহস্যময় কালাচ সাপ

রহস্যময় কালাচ সাপ অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে কমন ক্রেট সাপ , তাই নিয়ে এখনও বহু মানুষ প্রায় কিছুই জানেন না। ২০১৪ সালে হুগলী জেলার জাঙ্গিপাড়া গ্রামীণ হাসপাতালে, ডা শোভন সিকদার একজন এই রহস্যময় সাপের কামড় এর রুগী পেয়েছিলেন। সকাল বেলা একজন ১৬ বছর বয়স এর ছেলে পেটে ব্যাথার জন্য এসেছিল। বাড়ীর লোকের ধারণা হয়েছিল, আগের রাতে ডিম ভাজা খেয়ে পেটের গন্ডগোল হয়েছে। ডাক্তার সিকদার রুগীর চোখের দিকে তাকিয়ে “ শিবনেত্র” বা ইংরেজিতে যাকে বলে টোশিস, পেয়েই নিশ্চিত ভাবে বুঝেছিলেন, এই ছেলেটিকে আগের রাতে রহস্যময় কালাচ সাপে কামড়েছে। যেহেতু এই সাপ সাধারণত গভীর রাতে বিছানায় উঠে কামড় দেয়, কামড়ে কোন ব্যাথা লাগে না, এমনকি কয়েক ঘণ্টা পর আর কোন কামড় এর দাগও দেখা যায় না, বাড়ীর লোকের ধারণা হয় ডাক্তারবাবু ভুল বলছেন।

এই ব্যাপারটি কিন্তু মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। এই ১৬ বছর বয়সের ছেলেটির ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। ডাক্তার সিকদার অনেক বুঝিয়েও অন্টিভেনম চিকিৎসা শুরু করতে পারেন নি। উনি বলেছিলেন, একে অ্যান্টি ভেনম না দিলে একটু পরে ওর শ্বাস কষ্ট শুরু হবে। হয়েছিলও তাই। ঘন্টা দুই পরে ছেলেটির শ্বাস কষ্ট শুরু হলে বাড়ীর লোক অ্যান্টিভেনম চিকিৎসায় রাজী হন। দ্রুত দশটি অ্যান্টি ভেনম চালানো হলেও রুগীকে কলকাতায় পাঠাতে হয়। কারণ ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে, ডাক্তার সিকদার ঠিকই বুঝেছিলেন যে, ঐ রুগীকে ভেন্টিলেশনে না দিতে পারলে বিপদ আছে। উনি সবকিছু লিখে, রুগীকে কলকাতায় পাঠান। রুগী কলকাতার হাসপাতালে ভর্তিও হয়েযায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রমে এ রুগী ভেন্টিলেশনে দেওয়ার আগেই মারা যায়। তাতেই সব সমস্যার শেষ হয়নি। কোন এক ডাক্তারবাবু একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে বসেন। তাঁর মতে এটি কোন সাপের কামড় -এর রুগী ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই রুগীর বাড়ীর লোকজন উত্তেজিত হয়ে যান, তাদের তখন মনে হয় ডা সিকদার ভুল চিকিৎসা করার জন্যই তাদের রুগী মারা গিয়েছে। আমদের সৌভাগ্য যে আর একজন বড় ডাক্তারবাবু রহস্যময় কালাচ সাপের কামড় এর বিষয়ে জানতেন, উনি এসে রুগীর বাড়ীর লোকের উত্তেজনা কমান। এরপর পোষ্ট মর্টেম করেও সাপের কামড় এ মৃত্যু ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়। আরও নিশ্চিত ভাবে কালাচ সাপের কামড় বোঝা যায়, বিকেলে ঐ ছেলের ঘর থেকে একটি কালাচ সাপ উদ্ধার হওয়ার পর।

এই খবর ২০১৬ সালে, পশ্চিম বাংলার স্বাস্থ্য দপ্তর প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় ও ছাপা হয়েছে।

জেলায় জেলায় ঘুরে ঘুরে নানান রকমের অনুষ্ঠান করে, আমরা বছরের পর বছর এই সব রুগীর কথা বলে, কালাচ সাপ সম্বন্ধে লোকজনকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি। এই আলিপুর দুয়ার বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংস্থার মত অনেক সংগঠন ও সারা বছর এসব অনুষ্ঠান করে চলেছেন। এখন পশ্চিম বাংলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কর্মরত প্রায় ৯০% ডাক্তারবাবু সাপের কামড় এর বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। শুধু ঐ ছেলেটিই নয়, এরকম কয়েকশ কালাচ সাপের কামড় এর রুগীর সফল চিকিৎসা হয়েছে এ সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তারপরও আমরা রুগীর বাড়ীর লোকজন এর অজ্ঞতার খবর পাচ্ছি। 

গত ২৮ .১০. ২০২১ তারিকের সংবাদ প্রতিদিন কাগজে এরকম একটি দুর্ভাগ্যজনক খবর প্রকাশিত হয়। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ধান্যকুড়িয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, সকাল বেলা একটি বছর পনের বয়সের মেয়ে চিকিৎসার জন্য আসে। বাড়ীর লোকের কথা অনুযায়ী , মেয়েটি সকালে একবার পাতলা পায়খানা করে একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। ওর পেট খারাপের চিকিৎসার জন্যই ওকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। ডা বিশ্বাস মেয়েটিকে পরীক্ষা করে দেখতে পান, শিবণেত্র। নিজের ডাক্তারী বুদ্ধিতে ডা বিশ্বাস বুঝতে পারেন যে , একবার মাত্র পাতলা পায়খানা করে এরকম একটি কিশোরী একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে এটা হয়না; নিশ্চয়ই অন্য কোন কারন থাকবে। এসময় উনি শীবনেত্র দেখে বুঝে যান যে এটি কালাচ সাপ কামড়ের রুগী। কিন্তু সেই একই রকম সমস্যা হল, বাড়ীর লোকজন বুঝতে চাননা। তারা কামড়ের দাগ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেন। ডাক্তার বিশ্বাস বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, শিবনেত্র কালাচ সাপ কামড় এর লক্ষণ। বিপদ বুঝে ডাক্তার বিশ্বাস আমাকে ফোন করে সবকিছু জানান। আমি ওনাকে জাঙ্গিপাড়া হাসপাতালের ঘটনা মনে করিয়ে বাড়ীর লোকজনকে বোঝাতে বলি। এর মধ্যে আমি ঐ জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাই। উনি ডা বিশ্বাস এর মোবাইলে ফোন করে রুগীর বাড়ীর লোকের সাথে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বাড়ীর লোকজন বুঝতে চাইলেন না। তারা লিখে দিলেন যে, তাদের রুগীর সাপের কামড় এর চিকিৎসা করার দরকার নেই। ঘন্টা তিনেক সময় নষ্ট করে, বাড়ীর লোকজন মেয়েটিকে ঐ স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ছুটি করিয়ে বড় হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেন। পথে মেয়েটি মারা যায়।

২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সাল। সাত বছরে আমার পরিচিত ব্যাক্তি ও সংগঠন মিলে অন্তত দুই আড়াইশ বার বিভিন্ন জায়গায় ২০১৪ সালের দুঃখজনক ঘটনাটি উল্লেখ করেছি। কাজ যে খুব একটা কিছু হয়নি এই সাত বছর পর ঘটা সম্পূর্ন অবাঞ্ছিত মৃত্যুর পর আমরা বেশ বুঝেছি। 

এতো গেল সাধারণ জনগণকে শেখানোর মূল্যায়ন। এবার ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে ভর্তি একজন রুগীর ঘটনা বলি। তখনও ঝাড়গ্রাম হাসপাতাল জেলা হাসপাতাল হয়নি। একদিন বিকেলে একজন ৩৭ বছর বয়সী জোয়ান মানুষ পিঠে ব্যাথার জন্য ভর্তি হলেন। সকাল থেকে মাটি কাটার কাজ করে পিঠে ব্যথা হয়েছে, এই ছিল তার রোগের ইতিহাস। রুগীকে ভর্তি করা হয় অর্থোপেডিক সার্জন অর্থাৎ অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে। উনি রুগীকে একটি ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দিয়ে শুয়ে থাকতে বলেন। ব্যাথার ইনজেকশন পাওয়ার প্রায় ৪৫ মিনিট পর রুগী জানান যে তার পেট ব্যাথা করছে। কর্ত্যবরতা সিস্টার দিদিমণি ডাক্তারবাবুকে ডেকে পাঠান। উনি এসে রুগীর কথা শুনে মনে করেন যে ব্যাথার ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে পেটে ব্যথা হয়েছে। উনি সাধারণ কথায় আমরা যাকে গ্যাস অম্বলের ওষুধ বলি, তাই দিতে লিখে দিয়ে নিজের চেম্বার এ চলে যান। আবার ঐ রকম মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর রুগী জানান, গলায় ব্যাথা করছে। আবার ঐ অর্থোপেডিক সার্জেন ডাক্তারবাবুকে ডেকে পাঠান হয়। উনি হাসপাতালে এসে রুগী দেখে, নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুকে ডাকতে বলে চলে যান। নাক কান গলার বিশেষজ্ঞ এসে রুগী দেখে লিখে যান, গলায় কোন গণ্ডগোল নেই। আবারও কিছু পরে রুগী জানান যে তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আবারও সেই অর্থোপেডিক সার্জেন হাসপাতালে আসেন। এবার উনি খুবই বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেন, এটা মানসিক রুগী, কাল সকালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবু এলে দেখিয়ে নেবেন। শ্বাস কষ্ট বলেছে রুগী, তাই অক্সিজেন এর একটা নল নাকে লাগিয়ে দিতে বলে হাসপাতাল থেকে চলে যান। রুগী শ্বাস কষ্ট বলতে বলতে আধ ঘণ্টা পরে মারা যান। এবার তো হাসপাতাল একটা জরুরী অবস্থা হয়ে গেল। ঐ দুজন ডাক্তারবাবু, হাসপাতালের সুপার, ইমার্জেন্সির ডাক্তার ম্যাডাম সবাই ছুটে এসে সুপার এর ঘরে জরুরী মিটিং এ বসলেন। এরকম একটি জোয়ান মানুষ ভর্তির ঘন্টা তিনেক এর মধ্যে কী কারণে মারা যেতে পারে, কেউই বুঝে উঠতে পারছেন না। সন্ধ্যার রাউন্ড দেওয়ার জন্য আরও কয়েকজন ডাক্তারবাবু ও এসেছেন; সকলেই সুপার স্যার এর ঘরে মিটিংয়ে কি নিয়ে আলোচনা চলছে দেখতে বসে গেলেন। এই ভাবেই, আমাকে যে ডাক্তারবাবু এই ঘটনাটা পরে বলছিলেন , উনিও এসে বসেছিলেন। এই ডাক্তারবাবু এর আগে, ঐ হাসপাতালে অনুষ্ঠিত একটি সাপের কামড় এর বিষয়ে আলোচনা সভায় কালাচ সাপ কামড় এর অদ্ভুত ব্যাপারটি শুনেছিলেন। কালাচ সাপ কামড়ের রুগিও এরকম গাঁঠে গাঁঠে ব্যথা, সারা শরীরে ব্যাথা, পেটে ব্যাথা, গলায় ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে আসতে পারে, এটা উনি জানতেন। সময়ে অন্টিভেনোম না পেলে এই সব কা লা চ কামড়ের রুগী শ্বাস কষ্ট পেতে পেতে, দম বন্ধ হয়ে মারা যান। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, যে তিনজন ডাক্তারবাবু হাসপাতালে এই হতভাগ্য রুগীকে ঐ দিন দেখেছিলেন, তারা কেউই আমাদের সেই প্রশিক্ষণ ক্লাশে ছিলেন না। এই যে ডাক্তারবাবুর প্রশিক্ষণ ছিল, উনি জানতে চান, এই রুগীর শিবোনেত্র দেখা যায় কি না। সত্যি বলতে কি, পিঠে ব্যাথা, বা পেট ব্যাথা রুগীর চোখের দিকে তাকালে যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ লক্ষণ পাওয়া যেতে পারে, এই ব্যাপারটি প্রশিক্ষণ না থাকলে জানা সম্ভব নয়। তাই এই রুগী বেঁচে থাকার সময়ে এর চোখের দিকে কোন ডাক্তারবাবু ই ভালো করে দেখেননি। শুধু শিবনেত্র দেখেই, কয়েকশ কা লা চ সাপ কামড়ের রুগী বুঝে গিয়ে তাদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন , এমন প্রশিক্ষিত বহু ডাক্তারবাবু এ রাজ্যের গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে এখনও কাজ করছেন। 

এবার এই কা লা চ সাপ কামড় এর একটি রুগীকে, শুধু নিজের অদম্য জেদ দিয়ে কেমন ভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, শালবনী গ্রামীণ হাসপাতালের ডাক্তার মহতাসিব আলম, সেই কথা বলি।  দশ বছর বয়সী একটি ছেলেকে শালবনি হাসপাতালে আনা হয় একদিন সকালের দিকে। এই ছেলেটিকে তার আগে কয়েক ঘণ্টা এক ওঝার বাড়ীতে রাখা হয়েছিল। খুব সম্ভবত এই ওঝা কালাচ সাপ কামড়ের ব্যাপারটি বুজতে পেরেই ছেলেটিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। রুগী যখন হাসপাতালে পৌঁছয় তখন তার শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছে। ডাক্তার আলম দ্রুত অ্যান্টিভেনম চালিয়ে দেন। কিন্তু রুগীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে দেখে ডাক্তার আলম ছেলেটির শ্বাসনালীতে টিউব লাগিয়ে কৃত্রিম শ্বাস চালুকরে দেন। গ্রামীণ হাসপাতালে ভেন্টিলেটর থাকে না। এই রকম রুগীকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করে সেখানে ভেন্টিলেটর মেশিন দিয়ে শ্বাস চালু রাখতে হয়। কিন্তু অনেক সময় এই সব রুগীর অবস্থা এতই খারাপ থাকে যে, শহরের বড় হাসপাতালে পৌঁছনর আগেই রুগী মারা যায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মতে এদের বড় হাসপাতালে পাঠানোর সময়, ডাক্তার আলম যে ভাবে আম্বুব্যাগ দিয়ে কৃত্রিম শ্বাস চালু রেখেছিলেন , সেভাবেই পাঠানো উচিত। শালবনী হাসপাতাল থেকে কাছের বড় হাসপাতাল হল, কুড়ি কিলো মিটার দূরের মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ। আগেও ওখানে দু এক বার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে সাপে কাটা রুগী বেড খালি পায়নি। তাই ডাক্তার আলম ছেলেটিকে সেখানে পাঠানোর আগে বেড খালি আছে কি না নিশ্চিত হতে চান। উনি আমাদের কয়েকজনের কাছে ফোন করে ব্যাপারটা দেখতে বলেন। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ আমার খুবই প্রিয়জন। ওনাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাই। উনি বললেন, বেড খালি আছে কি না একটু পরেই জানাবেন। কিন্তু বেড খালি ছিল না। অধ্যক্ষ মশাই চেষ্টা করেন, কিন্তু পাঁচ ছয় ঘণ্টা পরও কোন আই সি ইউ বেড খালি হলনা। এদিকে শলবনি হাসপাতালে ভর্তি ছেলেটির শ্বাসনালীতে টিউব লাগিয়ে কৃত্রিম শ্বাস চালু রেখে বসে আছেন ডাক্তার আলম। মেডিক্যাল কলেজে বেড খালি পাওয়ার আগে ছেলেটি স্বাভাবিক শ্বাস নিতে শুরু করে। ওকে শলবনী হাসপাতাল থেকেই সুস্থ করে ছুটি দেওয়া হয়, পরের দিন। ডাক্তার আলমের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ এই রাজ্যের কেন, এ দেশেই বিরল। আমার অন্তত জানা নেই, আজ পর্যন্ত এ দেশে কোন গ্রামীণ হাসপাতালে, এ ভাবে কোন রুগীকে বাঁচানো হয়েছে কি না। 

  আমরা ডাক্তার আলম এর এই যুগান্তকারী কাজটি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে সারা দেশে প্রচার করে চলেছি। ওনার এই উদাহরণ দেখে, পরবর্তী সময়ে আরও কএক জন ডাক্তারবাবু এরকম ভাবে সাপে কাটা রুগীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন। গ্রামীণ হাসপাতালে একটি করে পোর্টেবল ভেন্টিলেটর থাকলে আরও অনেক সাপে কাটা রুগীকে নিশ্চিন্তে বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ কথা আমি এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর এর বড় কর্তাদের চিঠি লিখে জানিয়েছি। আট নয় বছরেও সে প্রস্তাব কার্যকর করার কোন প্রচেষ্টা আমি দেখিনি।

এই যে মাত্র কয়েকটি উদাহরণ এখানে দিলাম এর থেকে একটা ধারণা করা যায় না কি যে, কালাচ সাপের কামড় এর বিষয়ে শুধু সাধারণ জনগণ নয়, ডাক্তারবাবুদের মধ্যেও প্রচুর অজ্ঞতা আছে ? আবার সামান্য একদিনের প্রশিক্ষণ পেলেই, যে কোন ডাক্তারবাবু এই সাপের কামড় এর রুগীর রোগ লক্ষণ বুঝতে পারেন। আর সময় মত চিকিৎসা করা হলে রুগী বাঁচানো সম্ভব। এখন তাহলে বোঝা যাক , এই সময় মত চিকিৎসা করার ব্যাপারটি কি! 

যে কোন বিষধর সাপের কামড় এর চিকিৎসা হল ,শরীরে যে বিষ কামড়ের জন্য ঢুকেছে তাকে অ্যান্টি ভেনম দিয়ে প্রতিহত করা, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে Neutralize করা। শরীরে বিষ ঢোকার পর থেকে ঐ বিষ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতিকর কাজ শুরু করে। কামড়ের জায়গা থেকে বিষ একটু একটু করে রক্তে মিশতে থাকে। এক এক সাপের বিষ এক এক প্রত্যঙ্গ বিকল করতে থাকে। যেমন চন্দ্রবোড়া সাপের বিষ আমাদের কিডনী নষ্ট করে। ফণা যুক্ত সাপ, গোখরো আর কেউটের বিষ খুব দ্রুত রক্তে মিশতে পারে, এদের বিষ স্নায়ুতন্ত্রকে অকেজো করে দেয়। চোখের পাতা থেকে শুরু করে দ্রুত এই স্নায়ু অকেজো করার কাজটি নিচের দিকে নামতে থাকে। বুকের পাঁজর এর সাথের মাংস পেশী আমাদের শ্বাস কার্য চালু রাখে। সাপের বিষ এই পাঁজরের পেশী অকেজো করে রুগীর দম বন্ধ করে মেরে ফেলে। 

কালাচের বিষও স্নায়ুকে অকেজো করে দম বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এদের বিষ ফণাযুক্ত সাপের বিষের মত দ্রুত কাজ করে না। 

কালাচ সাপের কামড় এর পর দুই থেকে চব্বিশ ঘণ্টা পরও চোখের পাতা পড়ে আসা, অর্থাৎ শিবনেত্র ঘটায়। এই শিবনেত্র শুরু হওয়ার দুই তিন এমনকি চার পাঁচ ঘন্টা পরও শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। তাই শিবনেত্র শুরুর পর যত তাড়াতাড়ি অন্টিভেনোম দেওয়া যায় তত বেশি সাফল্য পাওয়া যায়। সাধারণত শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেলে অন্টিভেনোম্ম দিলেও কৃত্রিম শ্বাস চালু করতে হয়। ডাক্তার আলম এটা করে দেখিয়েছেন। এখানে বলে রাখা ভালো, ফণাযুক্ত সাপের কামড় এর পর শুধুই অন্টিভেনোম দিয়ে শ্বাস কষ্ট আটকানো যায় না। Atropine ও Neostigmine injection দুটি না দিলে, ফণা যুক্ত সাপের কামড় এর রুগী প্রায় বাঁচানো মুশকিল।

কালা চ সাপ কামড় নিয়ে এত বিভ্রান্তির কারন হল, আমাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা কিছু বদ্ধমূল ধারণা। আমরা প্রায় সবাই জানি, বিষধর সাপের কামড় হলে, দুটি কামড় এর দাগ থাকবেই। কালাচ সাপের কামড় এর ব্যতিক্রম। রাত্রে ঘুমের মধ্যে কামড়ের পর সকালে, অর্থাৎ কামড় এর তিন চার ঘণ্টা পর আর কোন দাগ থাকে না। এছাড়া ফণা যুক্ত সাপের কামড় এর পর যেমন কামড় এর জায়গায় পোড়ানো ব্যথা হয়, কালাচ সাপ কামড় এ তমন কোন জ্বালা ব্যাথা হয় না। কালাচ সাপ কামড়ের এই সব বিচিত্র ব্যতিক্রমী ব্যাপার সবার জেনে রাখা দরকার।

  ডা দয়াল বন্ধু মজুমদার, জাতীয় কর্মসূচী রূপায়ণ দলের সদস্য।

 

বাংলা সাপের পুস্তিকা
Download File