Bengali Writings (বাংলা লেখাগুলি)

 

ভ্রমণ কাহিনী

এখানে ডা দয়াল বন্ধু মজুমদার -এর ভ্রমন কাহিনী ও অন্য বাংলা লেখাগুলি পাবেন।

 

ইউরোপ ভ্রমন - পর্ব-৩

লন্ডনে দেড় দিনের জন্য বেড়াতে আসার জন্য আমাদের অনেক বেশী খরচ করতে হয়েছে। শুধু খরচই নয়, এখানকার ভিসা পাওয়াটাও বেশ ঝঞ্ঝাট এর ব্যাপার। আমার মেয়ের বান্ধবী একটি মেয়ে একই ট্যুর কোম্পানির সাথে ইউরোপে এসেছে; ওর UK ভিসা হবেনা, তাই ওদের ভ্রমণ শুরু করলো প্যারিস থেকে। ভিসা আপিসে বসে মেয়েটি যখন এই কথা বলেছিল তখন ব্যাপারটি ঠিক বলছে কিনা বুঝতে পারি নি। কিন্তু দুই- তিন দিন পর দেখলাম,  বিখ্যাত ভ্রমণ চ্যানেল এর শিবাজীবাবু একাই লন্ডনে চলেছেন, বন্ধু পৃথ্বীকে ছাড়াই; কারণ ঐ লন্ডনের ভিসা সমস্যা। লন্ডনে আমার বন্ধুর কন্যা মেঘা থাকে। সে কিন্তু,  “ভিসা কোন সমস্যা নয়”, এরকমই বলেছে কয়েকবার।

 আমার এই প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে লেখা শুরু করেছি, ১৮ ই মে কোলকাতা বিমান বন্দরে বসে। লন্ডনে নেমে থেকে দৌড় আর দৌড়। দ্বিতীয় পর্ব লিখতে পেরেছিলাম বোধহয় দিন চার পাঁচ ভ্রমণের পর। আজ ৩০ তারিখ ভোরে উঠে রোম এর বিমান বন্দরে ফেরার প্লেন ধরতে ছুটেছি। আন্তর্জাতিক বিমান যাত্রা করতে হলে বেশ কিছু সময় নানান কাজে কেটে যায়, প্রথম পর্বে লিখে রেখেছি। আজও সেসব তো ছিলই, সাথে আর একটা নতুন কাজ যোগ হয়েছিল অনেকের জন্য। বিদেশ থেকে দামি দামি জিনিস কিনে ফিরতে হলে, তার কিছু কাগজ পত্র, টাকা পয়সা ইত্যাদির কাজ থাকে। আমাদের দলের তিরিশ জনের মধ্যে পাঁচ ছয় জন ঐ সব কাজও রোম বিমান বন্দরে সেরে নিয়েছে। সবাইকে একসাথে নিয়ে একই বিমানে ওঠার ঝক্কি আছে। তারপর তো হারাধনের দশটির জায়গায় তিরিশটি ছেলে ( ধেড়ে খোকা, এবং খুকু) নিয়ে গোটা দশেক দেশ ঘুরে, আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়ে আনা। আমরা শুধু নিজের নিজের পরিবারের দুই বা তিন জনের ঝক্কি সামলাতে হরবর ( মেদিনীপুরের গ্রামের কথায় নাজেহাল) হয়ে যাচ্ছিলাম। ট্যুর ম্যানেজার পবনদীপ কাউর মেয়েটি প্রায় ৯৯% নিখুঁত ভাবে সেই সব হুজ্জতি সামলে নিয়ে চলেছে। রোমের বিমান বন্দরে বসে একটু সময় পেয়েছিলাম, তাই তৃতীয় পর্ব লিখতে শুরু করলাম। 

লেখা শুরু করেছি একেবারেই নতুন একটা অভিজ্ঞতার কথা লিখব বলে। মাঝে বারো দিনে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পেরেছি , তাই লিখতে পনের দিন তো বটেই, একমাসও লাগতে পারে। এবার তো আর শুধু একটা ভ্রমণ কাহিনী নয়; এই ছেষট্টি বছর বয়সে এসে, মাএ বারো দিনে কত বিচিত্র দিকের অভিজ্ঞতা হল, এখন ভাবলে অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভ্রমণে বেড়িয়ে কি কি বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পেরেছি তার একটা আভাস দিতেই বোধহয় আজকের পর্ব শেষ হবে। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশের থেকে পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশ দেখতে যাওয়ার বিশাল অভিঘাত সহ্য করতে করতেই গোটা দুই- তিন দেশ দেখে নিলাম। এক একটি দেশের এক দুই ,তিন, এমনকি চার পাঁচ রকমের ভ্রমণ আকর্ষণ আছে। লন্ডনের ‘লন্ডন আই’ কি বস্তু, আমি আগে কোথাও পড়িনি বা ইউটিউবে দেখিনি। আবার আইফেল টাওয়ার বা পিসার হেলানো টাওয়ার এর কথা অসংখ্যবার শুনেছি। প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়াম এর সবকটা ঘরের মধ্যে দিয়ে একবার হেঁটে ঘুরে আসতেই দিন পাঁচ সাত লাগবে। সেখানের মোনালিসা ছবির কথা নিয়েই শ্রদ্বেয় সহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল মশাই একটি উপন্যাস লিখে গিয়েছেন। ফ্রান্সের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সুইজারল্যান্ডের দিকে যাওয়ার সময় কেউ কেউ বলেছিলেন, সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরও বেশী। সেই দেশেই নিজে যাচ্ছি, ভাবতে ভাবতে কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। সে দেশের দুটি বিখ্যাত পাহাড় এর উপর উঠে , আক্ষরিক অর্থে চোখ ধাঁধানো সাদা বরফে হেঁটে ঘুরে এলাম। কদিন পরেই সে অভিজ্ঞতা স্বপ্নে দেখা, কিংবা অন্য কোন জন্মের স্মৃতি মনে হবে। জার্মানির মিউনিখ শহরটা মাএ কয়েক ঘণ্টার জন্য ছুঁয়ে এলাম। সেখানকার গাড়ী দেখানোর বিপুল আয়োজন; আবার মিউনিখ নামটা উচ্চারণের সাথে সাথে মনে এল, “ ট্র্যাজেডি ইন মিউনিখ!”  আমাদের দলের দাসবাবু মনে করতে পারলেন, ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিক এ সন্ত্রাসবাদী হানায় ১৪ জন প্রতিযোগীর হত্যার ঘটনা। ৭২ সাল মানে আমি ক্লাশ ফাইবে পড়ি। খবরের কাগজে ঐ শিরোনাম দেখে ট্র্যাজেডি কথাটার মানে শিখেছিলাম। সেই অলিম্পিক স্টেডিয়াম বাইরে থেকে দেখলাম। 

মিউনিখে দারুন পিজা খেলাম; ইতালিতে বাজে, অখাদ্য। রোমে খেলাম, জিলাটিনো আইস ক্রিম। বেলজিয়ামের ওয়াফেল খেতে ভুলে গেছলাম, সুইজার ল্যান্ডের হোটেলে পেয়ে গেলাম; সেরকম ভালো কিছু না। লন্ডনে আমার কন্যা হঠাৎ পেয়ে গেল, চকোলেট কোটেড স্ট্র বেরি। ভালো, কিন্তু দাম শুনলে পিলে চমকে যাবে। সুইজারল্যান্ডে অনেক চকলেট কিনে নিল, আমার কন্যা আর বোন। গোটা ট্যুর ধরেই সকলে চকলেট কিনে চলল। সুইজারল্যান্ডে অনেকেই ঘড়ি কিনেছে। আইফেল টাওয়ারের কাছে বিক্রী হচ্ছিল, স্ট্রীট ফুড,”ক্রেপ”; আমরা খেলাম, আর্ক ডে ট্রাম্প এর কাছে। এরকম , বিদেশের খাবার দাবার নিয়েই একটি পুরো পর্ব লিখতে হবে হয়তো। 

উন্নত দেশের মানুষ আমাদের মত বিশৃঙ্খল লোকের সাথে কেমন ব্যবহার করল। ভেনিসে আর পিসায় বাংলাদেশী হকারদের রমরমা। ভ্যাটিকান সিটির দুটি ভিখারিনী । নর্থ সীতে জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ড থেকে নেদারল্যান্ডে যাওয়া। এরকম হাজারো অভিজ্ঞতা এই মাত্র বারো দিনে। খুঁটিনাটি লিখতে হবে! একটা পাঁচ সাতশ পাতার বই হয়ে যাবে। আমার পরিচিত, সহৃদয় পাঠকেরা অনেকেই এখন, দুটি পর্ব পড়ে, পরের পর্বগুলোর অপেক্ষায় আছেন, জানিয়েছেন। সবার কথা মাথায় রেখেই লিখছি। আমাদের এই ১২ দিনের ভ্রমণ দলের কেউ কেউ আগের পর্ব দুটি পড়েছেন। তাঁরা হয়তো আমার লেখার সময় ভুলে যাওয়া ঘটনাগুলি মনে করিয়ে দেবেন। আবার যারা আমার লেখা পড়ে ভবিষ্যতে এইরকম একটা বিদেশ ভ্রমণ করার উৎসাহ পাবেন তাঁদের কথাও মাথায় রেখে লেখার চেষ্টা করছি। 

দোহা থেকে কাতার এয়ারওয়েজ এর প্লেনে কোলকাতা যাওয়ার সময় এই পর্বটা শেষ করার চেষ্টা করছি। কলকাতায় নেমে আমার নিজের মোবাইলের নেটওয়ার্ক পেয়ে এই পর্ব আপনাদের পাঠিয়ে দেব। 

দোহা বিমান বন্দর বিশাল। ঝকঝকে সব দোকানপাট এর মধ্যে দিয়ে এক জায়গায় নেমে আর আর এক জায়গায় পরের বিমান ধরার জন্য অনেক হাটা হাটি করতে হয়। মাঝে আবার প্রায় হাফ কিমি ট্রামে চড়ে গেলাম। ফেরার সময় ট্রাম নেই, চলমান পথ আছে। আমরা ইউরোপের অনেক শহরে ট্রাম চলতে দেখলাম, চাপা হয়নি। দোহাতে নেমে একটা সমস্যা হল; আমরা সবাই ইউরোপের জন্য নতুন সিম কার্ড নিয়েছি, বা নিজের সিমে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং করিয়ে নিয়ে গেছলাম। কিন্তু দোহাতে সেসব কাজ করে না। আমাদের দলের সব থেকে বয়স্ক দুই সহযাত্রী দোহাতে নেমে হারিয়ে গেলেন। আমরা লন্ডনের ফ্লাইটের গেট নম্বর জেনে দলবদ্ধ ভাবে এগোচ্ছিলাম। ট্রামে ওঠার আগে, ম্যানেজার পবন সকলকে একসাথে দাঁড়াতে বলল। দেখা গেল দুজন কম পড়ছে। পবন ছাড়া আমরা আর প্রায় কেউ তখন ওনাদের চিনি না। পবন ওনাদের খুঁজতে পিছন দিকে দৌড় দিল; হাতে গো এভরি হোয়ার এর কমলা পতাকা। মিনিট দশেক খুঁজে, ওনাদের না পেয়, আমাদের নিয়ে পবন এগিয়ে চলল। আমরা সবাই ততক্ষণে পরের প্লেনের গেট নম্বর জেনে গেছি। তাই আন্দাজ করা যাচ্ছিল, ওনারা দুইজন গেটে পৌঁছে যাবেন। গিয়ে দেখি ঠিক তাই। দুই দাদু সবার আগে পৌঁছে, বোর্ডিং এর চেষ্টা করছেন। আমরা প্রায় সবাই বলছিলাম, আপনারা কোথায় হারিয়ে গেছলেন! দুই দাদুর মধ্যে যিনি চটপটে, তিনি বললেন, “আমরা হারাইনি, আপনারাই হারিয়ে গেছলেন।” গোটা সফরে, বিশেষ করে শান্ত দাদুকে নিয়ে পবন হিমশিম খেয়েছে। কিন্তু ফেরার সময়, আজ সকালে , রোম বিমান বন্দরে চটপটে দাদু এমন জিনিস হারিয়ে বসলেন যে, পবনের হাড় কালী করে ছেড়েছেন। সেসব কথা পরে হবে। এখন এদের হিসেবে রাত পৌনে নটা, কলকাতায়  সোয়া এগারোটা। রাতের খাওয়ার দেওয়া শুরু হয়েছে। এই পর্ব এখানেই শেষ করছি। আজ ৩০.৫.২০২৫.

 

 

 

পান্ডা এবং ফান্ডা 

পান্ডা মানে আমরা কি জানি? প্রথমেই মনে আসবে, মন্দিরের পান্ডা। পুরীর মন্দিরের পান্ডা তো বিখ্যাত। বিশেষ করে এই পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে যারা একবার ঘুরে এসেছেন, তাঁরা তো পান্ডা ব্যাপারটি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। কয়েক ডজন পান্ডার দাপটে স্বয়ং জগন্নাথ দেবের চোখও কপালে উঠে এসেছে। কোলকাতার বিখ্যাত কালী মন্দিরের পান্ডাদের অত্যাচারের কথা খুব শুনতাম। বোধহয় সেই ভয়েই, প্রায় পঞ্চাশ বছর কলকাতায় যাতায়াতের মধ্যেও, একবারও সেই মন্দিরের দিকে যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি। আজকাল অবশ্য কলকাতার ঐ এলাকার নাম মাহাত্ম অন্য কারণে বিপুল পরিমাণ বেড়ে গেছে। যে কেউই ঐ জায়গার নাম করলেই লোকে সন্দেহের চোখে দেখে। ভাবে, এই লোকটা আবার কোন ধান্দায় ওদিকে যাতায়াত করছে! সেই সব কাণ্ড কারখানা দেখেই বোধহয়, স্বয়ং মা কালী লজ্জায় জিভ কেটেছেন।

 গয়া গিয়েছেন কখনও? হিন্দু বাঙালির এক পবিত্র কর্তব্য পালন এর জন্য একবার যেতেই হয়। আমিও গিয়েছি। বংশ পরম্পরায় কি অদ্ভুত কায়দায়, এক শ্রেণীর বামুন ( ব্রাহ্মণ বলে শ্রদ্ধেয় সম্প্রদায়ের অপমান করার ইচ্ছা নেই আমার) তীর্থ যাত্রীদের কাছে টাকা আদায় করে চলেছে , না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমরা আমাদের ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাময়িক আশ্রয় থেকে বাইরে পা ফেলার সাথে সাথেই একদল যুবক আমাদের ঘিরে ধরল। তাদের সবার একটিই জিজ্ঞাসা, পাণ্ডার নাম কি? আমাদের বড়দা আগে একবার গয়া তীর্থে ঘুরে এসেছেন; ওখানকার ব্যাপার স্যপার একটু জানা ছিল, তাই আগেই বলে রেখেছিলেন যে, আমাদের পাণ্ডার নাম, “ গনেশ।” সেই জন্যই আমাদের সেজদা বা মেজদা, ঐ যুবকদের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “ গনেশ।” সাথে সাথেই ওদের একজন মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “গনেশ ঠাকুর বোলো!” ভিড়ও সাথে সাথে পাতলা হয়ে গেল। ওদের মধ্যে যে ছেলেটি গনেশ পাণ্ডার লোক ; সম্ভবত নাতি, পুতি, বা পুতির পুতি কেউ হবে,” ঠিক আছে, চলো মন্দিরের দিকে”, বলেই সিনেমার হিরোর মত মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে, ভোটভটিয়ে চলে গেল। আমরা সেবাশ্রমের গেটের বাইরে থেকে একটি বড় আটো ভাড়া নিয়ে চললাম, মন্দিরের দিকে। গয়া শহরের রাস্তা বা বাড়ী ঘরের যে করুন অবস্থা সেই বছর কুড়ি বাইশ আগে দেখেছি, সে কথা আর এখানে লিখলাম না। বোধহয় ঐ রকম একটা প্রতিবেশ এর জন্যই, আমার ভক্তি শ্রদ্ধা আগেই অর্ধেক চলে গিয়েছিল। 

আমরা অটো রিক্সা থেকে নামার সাথে সাথেই সেই নব্য যুবক, পাণ্ডার পুতি,  আমাদের সামনেই একটি দোকান দেখিয়ে, সেখান থেকে জিনিস পত্র কিনে নিতে বলল। সেই দোকানের হতশ্রী অবস্থাও আমার ভক্তির ভান্ডারে টান দিয়েছিল। আমরা পূজার বা পিণ্ড দানের সামগ্রী নিয়ে কয়েক পা হেঁটে একটি পাথর বাঁধানো চত্বরের মধ্যে গিয়ে থামলাম। সেই যুবক বা অন্য কেউ আমাদের ঐ চাথালের এক জায়গায় বসে যেতে বলল। আমাদের মত আরও কয়েকটি দল ঐ ভাবে, এদিক ওদিক বসে গিয়েছে। এবার এসে হাজির হলেন, আমাদের আসল পান্ডা। সম্ভবত ঐ পুতি পাণ্ডার বাবাই হবেন। বছর ষাট   মত বয়স হবে। কাচা ধুতি আর ফতুয়া পরিহিত মানুষটি, বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ভদ্র ভাবেই আমাদের সাথে কথা বার্তা বলতে থাকলেন। কিন্তু মুখের থেকে সেই সকাল আটটা - সাড়ে আটটাতেই ভুর ভুর করে ধেনো মদিরার গন্ধ ছড়াচ্ছিল। বড়দা একটি পিতলের ঘটি কিনেছিলেন, ফল্গু নদী থেকে পূজা পাঠের জন্য জল নিতে। পান্ডা মশাই জেনে নিলেন, আমরা স্নান সেরে এসেছি কি না; না হলে ফল্গু নদী থেকে স্নান সেরে আসতে বললেন। দাদা তখন ঐ ঘটিতে জল তোলার কথা বললেন। পান্ডা মশাই বললেন, যাও, নদীতে নেমে জল নিয়ে এসো। 

ফল্গু নদীর সন্বন্ধে যে বিখ্যাত প্রবাদ চালু আছে, আমাদের সামনে তা দেখলাম না। বর্ষার ঠিক শুরুতে বলেই, নদীতে হাঁটু পর্যন্ত জল ছিল। বেশ ঘোলা, লাল মাটি গোলা জল। সেই জল হেঁটে পেরিয়ে কেউ কেউ অন্য পারে চলে যাচ্ছিল। সেই জলই এক ঘটি তুলে আনা হল। বছরের অধিকাংশ সময় বোধহয় নদীর বালী খুঁড়ে জল বের করতে হয়। এই রকম আর একটি জায়গায় গিয়ে আমাকে হতাশ হতে হয়েছিল। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে, চেরাপুঞ্জি গিয়ে দেখি, ঝাঁ ঝাঁ রোদ। রোদের জন্য ছাতা মাথায় দিতে হল। মাসখানেক বোধহয় এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েনি। 

সেই পাথরের চাথালে বসে তো আমাদের শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ করালেন, পান্ডা মশাই। আমাদের পান্ডা যে, গনেশ ঠাকুর মশাই, সে কথা কি করে জেনেছি, এই রকম কোন কথায় উনি জানলেন যে, বহু বছর আগে, আমাদের প্রয়াত পিতৃদেব একবার গয়ায় এসেছিলেন। কোন জেলায় বাড়ী? কত বছর আগে নাগাদ বাবা গয়ায় গেছলেন, এইরকম কয়েকটি তথ্য জেনেই, সেই পাণ্ডার পুতি , চট করে কোথাও গিয়ে, একটি পুরনো জাব্দা খাতা নিয়ে এল। আর আমাদের চমকে দিয়ে, সেই খাতার একটি পাতায়, আমাদের বাবার সই দেখিয়ে দিল। আমার রাঙা দাদা খুবই আবেগ প্রবন মানুষ। বাবার হস্তাক্ষর দেখেই, আবেগে কেঁদে উঠলো। এবার, পাণ্ডার কাজ শেষ করতে হবে; “তীর্থ গুরুকে” কত হাজার টাকা দক্ষিণা দেব, জানতে চাইলেন। নিজেই বললেন, পাঁচ হাজার টাকা দেবে, না কি দশ হাজার? সেজদা ব্যবসায়ী মানুষ। মেদিনীপুরের বড় ডোম পাড়ায়, মাসিক পাঁচ টাকা ভাড়ায় খড়ের চালের ঘরে ভাড়া থেকে, কলেজে পড়েছে। সে পঞ্চাশ টাকা থেকে দরাদরি শুরু করে, শেষ পর্যন্ত বোধহয় এক হাজার টাকায় রফা করল। এখন নিশ্চয়ই সেই যুবক পাণ্ডার পুতি নিজেই “ তীর্থ গুরুর” স্থান নিয়েছে। জাবদা খাতার সব তথ্য কম্পিউটারে ওঠানো হয়েছে কি না জানিনা। সেদিন আমরা বাবার সই এর নিচে, সকলে সই করে এসেছি। আমাদের পরের প্রজন্মের কেউ হয়তো একদিন মেদিনীপুরের গ্রামের মানুষ এর খোঁজ করে, সেই খাতার পৃষ্ঠাটি আবিষ্কার করবে। 

পান্ডাকে তাঁর দক্ষিণা মিটিয়ে , আমরা আসে পাশের আরও কিছু জিনিস দেখে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাময়িক আস্তানায় ফিরে এসেছিলাম। বিকেলে একটি বড় আটো ভাড়া নিয়ে ঘুরে এলাম, বুদ্ধ গয়া। কি সুন্দর এক প্রশান্তির জায়গা। না গেলে, গয়া শহরের একটা ঘিনঘিনে স্মৃতি সারা জীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হত।

গয়া তীর্থের পাণ্ডার গল্প শোনাতে কি আপনাদের এতটা সময় নষ্ট করলাম? না। মিশনের মহারাজের পাঠ আলোচনা শুনছিলাম, প্রতিদিন সকাল এর মত। উনিই “ পান্ডা” কথাটি বলে, এর উৎপত্তি ইত্যাদি বুঝিয়ে দিলেন। স্বয়ং আদি শঙ্করাচার্য বলেছেন, পন্ডিত কথাটির মূল হল, এই পান্ডা শব্দটি। কোন একটি বা একাধিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন যিনি, তিনিই পান্ডা বা পণ্ডিত! অথচ আজ দেখুন, পণ্ডিত আর পান্ডা দুটি জিনিসে কয়েক হাজার মাইল দূরত্ব। পান্ডা মানে ঐ রকম অর্ধ শিক্ষিত, গলায় একটি পৈতা ঝুলিয়ে, লোকের আবেগ আর ভক্তিকে কাজে লাগিয়ে, পয়সা উপার্জন করা একটি শ্রেণীর মানুষকেই বুঝি আমরা। পণ্ডিত মানুষ কখনোই ঐ ভাবে লোক ঠকিয়ে পয়সা রোজগারের কথা ভাববেন না। 

এই যে পান্ডা মানে আসলে পণ্ডিত মানুষ; এই খবরটি জানার পর, আমার বেশ মজার একটি কথা মনে এল। সেই আশির দশকে আমি যখন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে পড়তাম, তখন “ ফান্ডা” কথাটা আমাদের মধ্যে খুব চালু ছিল। আর আশ্চর্যের কথা, সেই সময় আমরা “ ফান্ডা” বলতে কিন্তু ঐ পাণ্ডিত্যের কথাই বোঝাতাম। আমাদের ক্লাশের বন্ধু বিদ্যুৎ ছিল, আক্ষরিক অর্থেই পণ্ডিত। প্রতিটা বিষয়েই আমাদের সবার থেকে বেশী পড়াশোনা করে, অনেক বেশি জানত। আমাদের সার্জারীর বিখ্যাত শিক্ষক, পূজ্যপাদ ডি কে রায় স্যার,  এক একদিন টানা তিন - চার ঘণ্টা ক্লাশ নিতেন। সে একে অপূর্ব সুন্দর, আনন্দের সঙ্গে শেখার অভিজ্ঞতা। মাঝে মাঝেই স্যার অদ্ভুত কৌশলে আমাদের সকলকে মাতিয়ে তুলতেন। কিছু একটা পড়া জিজ্ঞেশ করে, কেউ না বলতে পারলে, বলতেন, “ পণ্ডিত, বল এবার!” আসলে প্রথম দিনেই স্যার বুঝে গেছেন, এই বিদ্যুৎ ছেলেটি গোটা ক্লাসের থেকে পড়াশোনায় অনেক বেশি এগিয়ে আছে। কয়েক মাস আগে, স্যারের কলকাতার বাড়ীতে গেছলাম একবার। প্রায় নব্বই বছর বয়সী স্যারের শরীরের সাথে স্মৃতিও জব্দ হয়ে গেছে, এটাই স্বাভাবিক। কথা বলতে বলতে, আমাদের ক্লাশের কে কি করছে, এইসব কথা জানতে চাইলেন। বিদ্যুৎকে নিশ্চয়ই মনে আছে স্যার? না রে, নাম মনে রাখতে পারি না আজকাল, বললেন স্যার। কিন্তু আমাদের ক্লাশের “ বড় পণ্ডিত?” সেই চল্লিশ বছর আগের মত হৈ হৈ করে উঠলেন স্যার। মোবাইলে ভিডিও কল করে পণ্ডিতকে ধরলাম। আহা, গুরু শিষ্যের সেই কথপোকথন আমি চুপ করে বসে শুনলাম। এ যেন কোন উপনিষদের যুগে ঘুরে এলাম আমি। 

বিদ্যুতের ছিল ডাক্তারি পড়াশোনায় “ ব্যাপক ফান্ডা।” আর , আড়া পাগলা জ্ঞান দাদার ছিল, পূর্ব ইউরোপের জিয়ো পলিটিক্সের উপর ফান্ডা। কারো কারো ছিল, খেলাধুলার খবরের ফান্ডা। এই সেদিনও আমাদের সহকর্মী এক ভাইয়ের ছিল, “ শেয়ার মার্কেটের ফান্ডা!” আমাদের নন্দ দাদার কাছে হাত জোড় করে বসে নিতাম, “ মিউচুয়াল ফান্ডের ফান্ডা।” আমার ছেলের কলেজের দাদা,  পবিত্র দাদার আছে, “ মোটর সাইকেল এর উপর ফান্ডা!” সেই আদি শঙ্করাচার্য এর যুগের “ পান্ডা” আজ কি করে “ ফান্ডা” হয়ে গেল, সেই ফান্ডা আপনাদের কারো থাকলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন। আজ ২৪.৬.২৫. গতকাল সন্ধ্যা থেকে শুরু করে আজ সকাল এগারোটার পর এই লেখাটা শেষ করলাম।