এখানে ডা দয়াল বন্ধুর ভ্রমণ কাহিনীগুলি পাবেন। 

"বাং লা লেখাগুলি"  লিঙ্কে সরাররি গুগুল     ড্রাইভে     যেতে পারেন , 

নিচে কয়েকটি ই-বুক দেওয়া হল।


বিদেশ ভ্রমণ ২৭

আমরা আর্নো নদীর পাড় থেকে ক্রমশ ডান দিকে, ফ্লোরেন্স শহরে ঢুকে গেলাম। এই ইটালির ফ্লোরেন্স শহরে দুইজন পৃথিবী বিখ্যাত মানুষ জন্মেছেন। একজনের নামই তো শহরের নামে। আমার নিজেরই একটু দ্বিধা ছিল যে, মহামানবী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল আদৌ এই শহরে জন্মেছিলেন কি না। পরে জেনেছি, ওনার জন্ম ওখানে হলেও, ওনার ব্রিটিশ নাগরীক বাবা মা ওনাকে, এক বছর বয়সেই ইংলণ্ডে নিয়ে চলে আসেন। কিন্তু দুঃখের কথা, আমাদের দলের কেউ কেউ, সেই গাইডকে মহীয়সী নারী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এর কথা জানতে চাইলেন; কিন্তু গাইড আমাদের সেই তীর্থে নিয়ে গেলেন না। ইটালির গাইড সেই তীর্থের খবর জানেন না, এটা আমি মানতে নারাজ। উনি আর একটি বিখ্যাত জায়গা আমাদের দেখালেন না। পরে সেকথা জেনে , আমার বিশ্ব পর্যটক ডাক্তার দাদা প্রায় আমাকে চড় থাপ্পড় মারতে চেয়েছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভাস্কর, মাইকেল এঞ্জেলো এই শহরের কোথাও বসেই, ডেভিড মূর্তি খোদাই করেছিলেন। সেই জায়গায়ই, পৃথিবীর সুন্দরতম পুরুষ মূর্তি ডেভিড এখনও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সেই জায়গার হয়তো একশ ফুট দূর থেকে চলে এসেছি। পরে অবশ্য প্রফেসর সান্যাল স্যার বলেছেন যে, আসল ডেভিড মূর্তি এখন মিলানের মিউজিয়াম এ আছে। তাতে আমার আফশোস কম হওয়ার কোন যুক্তিই নেই।আমরা ঐ বয়স্ক গাইডের পিছন পিছন দল বেঁধে এগিয়ে চললাম। এই ফ্লোরেন্স শহরও ইউরোপের অন্য শহরগুলির মতোই পরিষ্কার। এখানে রাস্তায় একটু বেশী মানুষ হেঁটে চলেছে। জানিনা, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আমাদের মত পর্যটক হয়তো। আমরা যে সব এলাকায় ঢুকে গেলাম, সেখানে পাথর বাঁধানো রাস্তা। কিন্তু গাড়ী চলে না। একটু পুরনো ধাঁচের বাড়িগুলি। একটু দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, বেশ বড়, উঁচু একটি গীর্জার চূড়া। গাইড বলেছিল, ওটিই ওখানকার সবথেকে বড় গীর্জা। আস্তে আস্তে আমরা একেবারে ঐ গীর্জার পাশ দিয়ে ঘুরে, অন্য পাশের বড় চত্ত্বরে পৌঁছে গেলাম। একটা বড় ফুটবল মাঠের মত বড়, পাথর বাঁধানো চত্ত্বর। গীর্জার চূড়া এত উঁচু যে, গোটা গীর্জার ছবি তোলা যাচ্ছিল না। চত্বরের উল্টো দিকে একটি গীর্জার মত বাড়ীর বিশাল সোনালী রঙের দরজা। ওটি দেখতে বন্ধ দরজার মত; কিন্তু আসলে ওটা কোনোদিনই সম্ভবত খোলা হয় না। এই দরজা ব্রোঞ্জের তৈরী। এই বিশাল দরজায় দশটি চৌকো ভাগে, বাইবেলের দশটি কাহিনী খোদাই বা ঢালাই করা হয়েছে। পাঁচ ছয় শ বছর আগে তৈরী ঐ শিল্প কর্মগুলি এখনও বেশ উজ্জ্বল। লোহার শক্ত বেড়া দিয়ে ঐ দরজা ভালো করে ঘেরা আছে। বেড়ার ফাঁকে মোবাইল রেখে ছবি তোলা গেল। এইসব ছবি আমার ইউরোপ ভ্রমণ এর ভিডিওগুলিতে দিয়েছি। ঐসব গীর্জা ইত্যাদির অনেক বর্ণনা আমাদের গাইড দিয়েছিল; কিন্তু ঐ সব ইতিহাস শোনার মত ধৈর্য আমার ছিল না। ঐ চত্ত্বর থেকে একটা পাথর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে আমরা পাঁচ সাতশ মিটার মত দূরে আর একটি বড় বাঁধানো চত্বরের মধ্যে গিয়ে থামলাম। এই চত্বরটি বেশ বড়; দুই তিনটি ফুটবল মাঠের মত হবে। গাইড বলেছিল, আগেরটিকে রিলিজিয়াস স্কয়ার আর এইটিকে পলিটিক্যাল স্কয়ার বলা হয়। অবশ্য আমার সেই বিশ্ব পর্যটক ডাক্তার দাদা বলছিলেন, এরকম কোন নাম হয় না। ঐগুলির নির্দিষ্ট কিছু নাম আছে।আমাদের গাইডের বলা সেই পলিটিক্যাল স্কয়ার নামের বিশাল চত্ত্বরে পৌঁছেই আমরা শুনতে পেলাম, দূরে কোথাও হরে কৃষ্ণ কীর্ত্তন হচ্ছে। মাঠের একেবারে অন্য দিক দিয়ে একদল লোক খোল কর্তাল বাজিয়ে চলেছেন। মাঠের মাঝখানে একটি মহিলার মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া মাঠের পাশে পাশে বেশ কিছু মূর্তি আছে। আমি শুনেছিলাম এই ফ্লুরেন্স শহরে কোথাও ডেভিড মূর্তি আছে। কিন্তু যে কটা মূর্তি দেখলাম, সবই প্রাচীন হলেও ডেভিড মূর্তি খুঁজে পেলাম না। মাঠের এক কোন দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। সামান্য কিছু এগিয়ে একটা ছোট্ট পাথর বাঁধানো উঠান মত। একপাশে একজন বয়স্ক মানুষ, গোটা কুড়ি পঁচিশ হাতে আঁকা ছবি নিয়ে বসে আছেন। তাঁর সামনে মনে হল, একজন মানুষ বসে , নিজের একটি ছবি আঁকিয়ে নিচ্ছিলেন। আমাদের দেশের মেলা বা ঐরকম কিছু জায়গায়, এই ধরনের কিছু ছবি আঁকিয়ে পয়সা রোজগারের মানুষ দেখেছি। এরা সাধারণত গরিব শিল্পী। ঐ রকম একটা শিল্পের তীর্থেও সেরকম, গরীব শিল্পী, পথের ধারে বসে, ছবি এঁকে রোজগার করছেন, ভাবতেই কষ্ট হয়। এই জায়গার থেকে একশ হাতের মধ্যে, পৃথিবীর সর্ব কালের, সর্ব শ্রেষ্ঠ ভাস্কর, মাইকেল এঞ্জেলো একদিন ডেভিড মূর্তি খোদাই করেছিলেন। আমাদের গাইড সেই কথা বললই না! ঐ বাঁধানো চত্বরের থেকে কুড়ি পঁচিশ মিটার দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আর্নো নদী। গাইড ঐ নদীর পাড়ে আমাদের পৌঁছে দিয়েই, তাঁর দেওয়া, গলায় ঝোলানো মেশিন ফেরৎ নিলেন। আমরা নদীর পাড়ে পাড়ে হেঁটে বাসের কাছে ফিরে এলাম। সন্ধ্যা প্রায় এসে গেল। আমরা এবার হোটেলের দিকে চললাম।আজ ২৪ শেষ জুলাই। আমরা মে মাসের ২৯ তারিখ ঐ ফ্লোরেন্স শহরে হেঁটে এসেছি। শুরুর দিকে ভেবেছিলাম, বাড়ী ফিরে, এক মাসের মধ্যে এই ইউরোপ ভ্রমণ কাহিনী লেখা শেষ করে ফেলব। হল না। আরও অন্তত দুই তিন পর্ব লিখতে হবে। এসে থেকে একমাস বাড়ি বসে থেকেও সব লেখা শেষ হল না। তার কারন মাঝে অনেক কটি অন্য কাজ নিতে হয়েছে। ভ্রমণের ভিডিও ইউটিউবে দিয়েছি, সবকটাই। লেখাও পর পর আমাদের নতুন ওয়েব সাইটে তুলে রাখছি। গতকাল সন্ধ্যায় আমার এক সহৃদয় পাঠক বললেন, সবকটা লেখা একসাথে কোথাও রাখুন, টানা সব পড়ে শেষ করতে পারিনি। আমি আগেও বলেছি, আজও লিখলাম; আমাদের ওয়েব সাইটে, আমার সব লেখা পেয়ে যাবেন। www.dayalbandhu.vip এই লিঙ্কে গিয়ে, “ ভ্রমণ কাহিনী” পেজে, ভ্রমণ নিয়ে সব লেখাই পাবেন।



বিদেশ ভ্রমণ ২৬

ভেনিসের শহরের বাইরে পাদুয়া নামের এই জায়গাটি বেশ নিরিবিলি। আমাদের হোটেলটির চারপাশে অনেক বড় বড় গাছ। কিন্তু জঙ্গল নয়। হোটেলের ছয় সাত তলা বাড়িটি দেখলে নতুনের মত লাগে। পাঁচ সাত বছর এর মত আগের হতে পারে। কিন্তু বিশাল এলাকার মধ্যে যে সব গাছ আছে, এক একটির বয়স একশ বছর হলেও হতে পারে। আমরা অন্য দিনের মতই সকলে দল বেঁধে নেমে, দোতলার প্রাতরাশের হলে, সকালের কাজ সেরে নিলাম। এখানেই কফি মেশিনের মত বড় মেসিনে সবই ইটালিয়ান ভাষায় লেখা। কফির জন্য দুধ নিতে গিয়ে বিপদে পড়তে হল। কোন বোতামে চাপ দিতে হবে, আন্দাজে চেপে হয়তো দুধের বদলে গরম জল পড়তে শুরু করলো। এই সময় এক বিদেশিনী আমার পিছনে এসে কাপ হাতে দাঁড়িয়েছেন। ওনাকেই ইংরেজিতে বললাম, কোনটা দুধের বোতাম দেখিয়ে আমাকে সাহায্য করতে। উনিও ইটালিয়ান ছিলেন না। কিন্তু একটু ভেবে বললেন, এই “ ল্যাটটে” লেখাটাই দুধের জন্য। আমরা তল্পী গুটিয়ে বাসে উঠে বসলাম। আজ গন্তব্য ঐতিহাসিক, পিসার হেলানো টাওয়ার। আমাদের ট্যুর ম্যানেজার পবন বলে দিয়েছিল, পিশা পৌঁছতে ঘণ্টা তিনেক লাগবে। সেই একই রকম চওড়া, ঝকঝকে রাস্তা দিয়ে ছুটল আমাদের বাস। পিসার হেলানো টাওয়ার এর ছবি, আমার মনে হয় আমি ক্লাশ থ্রি বা ফোরেই দেখেছি। এটিকে পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্য জিনিসের একটি বলা হয়। আমাদের দেশের তাজমহল ঐ সাতের মধ্যে একটি। এখানে আমার একটি, অপ্রিয় সত্য কথা বলতে ইচ্ছা হল। আমি সেই ১৯৮৪ সালে প্রথম দেখি, তাজমহল। ভালো লাগেনি। সামনের বাগানের অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। বাগানের জলাশয়ে জল ছিল না। দিল্লির লাল কেল্লার ভেতরের অবস্থাও তাই। অথচ তখনকার শাসক পরিবারের সবার নামে নামে একটি করে ভ্রমণ স্থান করে নিয়েছে; সেগুলি বেশ টাকা পয়সা খরচ করে, ভালো করে রাখা ছিল। সেসব দেখে আমার সাথে দিল্লী যাওয়া, আমার বন্ধু সন্দীপ বেশ কড়া সমালোচনা করেছিল। আমরা বাস থেকে নেমে, একটা বেশ বড় বাঁধানো চত্ত্বর থেকে , ট্রামে উঠলাম। এই ট্রাম কিন্তু ওপরে টিকি বিদ্যুতে চালিত না। অনেকটা খেলনা ট্রেন এর মত, তিন কামরার, সাধারণ চাকার গাড়ী। মিনিট পাঁচেক পর আমরা ট্রাম থেকে নামলাম।  এই পিসাতে ট্রামে চড়া , রাতের আইফেল টাওয়ার দেখা, আর ভেনিসের গন্ডোলা রাইড, এই তিনটির জন্য , যারা যারা যেতে চায়, তাদের আলাদা করে টাকা দিতে হয়েছিল। এখানে না হয় ট্রামে না উঠে কেউ দুই কিমি হেঁটেই যেতে পারে; কিন্তু ভেনিসে গণ্ডলায় না চাপলে লোকে কি জন্য ভেনিসে যাবে? এটা গো কোম্পানি, প্রথমেই একসাথে টাকা নিয়ে নিতেই পারত।     ট্রাম থেকে নেমে, একটু গলি পথে হেঁটে, বাংলাদেশী হকারদের বাজারের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। একটি বড়, প্রায় দুটি ফুটবল মাঠের মত চত্ত্বরে ওপাশে সেই পৃথিবী বিখ্যাত হেলানো টাওয়ার দেখতে পেলাম। বাঁ হাতে ঘাসের মাঠ রেখে, ডান দিকের পাথর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। গোটা পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ এই চত্ত্বরে হাজির হয়েছে। সবাই হেলানো টাওয়ার পিছনে রেখে ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত। ঘাসের মাঠের অন্য দিকে গোটা দুই তিন বিশাল বড় বড় অট্টালিকা আছে। গীর্জা, তার আনুষঙ্গিক আর কি কি যেন ঐ সকল বাড়ী। পবন একবার বলেছিল, কিন্তু সেসব শুনে মনে রাখার চেষ্টাও করিনি। সবাই ঐ হেলানো টাওয়ার এর দিকেই তাকিয়ে, ক্রমশ এগিয়ে গেলাম। একশ ফুট মত দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, কিছু মানুষ টাওয়ারের উপর উঠেছে। এটাতে ওঠা যায়, এটাতো জানতাম না। একথা শুনে পবন বলেছিল, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে, পারলে উঠে যান। আট তলা উঁচুতে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা সেরকম কিছু কষ্টকর ব্যাপার নয়। পরে মনে হল, আমি পা টেনে হাঁটছি দেখে কি পবন ঐ রকম বলল? কিন্তু টাওয়ারের একেবারে কাছে গিয়ে দেখলাম, টিকিট কেটে ওঠার জন্য বেশ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েকশ লোক। টাওয়ারের গায়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ নেই। আমরা তিন চার জন হেঁটে, টাওয়ারের একেবারে উল্টো দিকে এগিয়ে গেলাম। ওদিকে পাথুরে রাস্তার পাশে পাশে দোকানপাট আছে। গোটা কয়েক ঘোড়ার গাড়িও দাঁড়িয়ে ছিল। ঐ দিকে দুটি সুন্দর ঝাউ গাছ এমন করে লাগানো হয়েছে যে, তাদের মাঝের জায়গাটা দিয়ে তাকালে , টাওয়ার এক দিকে চার ডিগ্রী হেল আছে, পরিষ্কার বোঝা যায়। আবার ঐ দুই ঝাউ গাছের মাঝে দাঁড়িয়ে, টাওয়ার পিছনে রেখে, একপ্রস্থ ছবি তোলা হল। তারপর ফেরার রাস্তা ধরলাম। সেই বাংলাদেশী হকারদের বাজারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসে একটি বাংলাদেশী দোকানে পিজা খেতে বসা হল। ইটালিতে গিয়ে পিজা খেতে কেমন লাগে, সেই রকম একটা বিশেষ কৌতুহল ছিল। কিন্তু খুবই হতাশ হতে হল। বাস্তবে এত বাজে পিজা আমি আর কোথাও খাইনি। পিজার দোকান থেকে, গো কোম্পানির দুটি দলই একসাথে হেঁটে, ট্রাম ধরার জন্য এগিয়ে গেলাম। রাস্তার পাশে মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হল। এখানেই আমাদের দলের ডা ভট্টাচার্য , রাস্তার উল্টো দিকে দৌড়ে গিয়ে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির জন্ম স্থান দেখে এসেছিলেন। এই ব্যাপারটি জানার পর, এটা গো কোম্পানির একটি বিরাট ভুল মনে হয়েছে আমার। যেটুকু সময় আমরা ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তার থেকে হয়তো আর পাঁচ মিনিট বেশী সময় লাগত। কিন্তু এত বড় একটা তীর্থের একশ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দশ মিনিট কাটিয়ে দিলাম, এটা ভেবে নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। ভেবে দেখুন, ইটালির কোন পর্যটক কলকাতায় ঘুরতে এসেছেন, উনি চিতপুর ট্রাম লাইনে দাঁড়িয়ে দশ মিনিট কাটিয়ে চলে গেলেন; কেউ ওনাকে বোললোই না, একশ মিটার দূরে থেকে গেল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান। আমরা ট্রাম ধরে আমাদের বাসের কাছে ফিরে এলাম। এবার বাস চলল, ফ্লোরেন্স শহরে। ঘণ্টা খানেকেই পৌঁছে গেলাম, ফ্লোরেন্স। একটা নদীর বাঁধানো পারের উপরে, রাস্তার পাশে দাঁড়াল বাস। নদীর পাড়ে একটা বড় বাগান মত জায়গায় আমরা ঢুকে গেলাম। কয়েক মিনিট পর একজন স্থানীয় গাইড এসে হাজির হলেন। এদের সাথে ট্যুর কোম্পানী আগে থেকেই যোগাযোগ করে রাখে। উনি আমাদের সকলকে একটি করে ছোট, গলায় ঝোলানো মেশিন দিলেন। এই মেশিনের সাথে, এক কানে লাগানোর জন্য একটি করে হেডফোন। এই মেশিন হল একটি এফ এম রেডিও সেট। গাইডের পিছনে পিছনে আমরা তিরিশ জন চললাম, ফ্লোরেন্স শহরে হেঁটে ঘুরে দেখতে। উনি রেডিওতে বলে চলেছেন, আমরা কেউ কেউ ওনার সাথেই চলেছি, কেউ কেউ হয়তো পঞ্চাশ ফুট মত পিছিয়ে পড়েছেন। ওনার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু উচ্চারণ পরিষ্কার নয়; খুব ভালো বুঝতে পারিনি আমি। স্থানীয় গাইড নিয়েও আমরা ফ্লোরেন্সের আসল জিনিস না দেখেই ফিরে এসেছি। পরে সেটা জেনে খুবই আফশোস হয়েছে।আজ জুলাই মাসের কুড়ি তারিখ। চারিদিকে একটা সাজো সাজো রব। কলকাতায় কাল বড় রাজনৈতিক সমাবেশ আছে। আমার কাল কলকাতায় কোন কাজ নেই। যাদের আছে, তারা বেশ ঝামেলায় পড়তে পারে। বাইশ তারিখ থেকে পরপর নয় দিন, স্বাস্থ্য ভবনের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষন দিতে যেতে হবে। সাধারণত মাসে এক আধ দিন যেতে হলে, মোবাইলে একটা ট্রেনের রিটার্ন টিকিট কেটে চলে যাই। এইরকম পরপর নয় দিন যেতে হবে, রোজ রোজ টিকিট কাটার হ্যাপা না করে একটা মান্থলি কেটে নিলাম, আজ সকালে। টিকিট আছে বলেই, গাছের চারা আর গোবর সার কিনতে শিয়ালদা চলে গেলাম। সাধারনত বাসে শ্যামবাজারের পাখীর হাটে চলে যাই, দুই এক রবিবার ছাড়া। শ্যামবাজারের গ্যালিফ স্ট্রীটের বাজারের মত দামেই চারা পেলাম, বি আর সিং হাসপাতালের পাশের রাস্তায়।      এই দামের কথায় মনে পড়ল , গত পর্বে একটা ভুল লিখেছি। ভেনিসের রেস্টুরেন্টে ভেজ বিরিয়ানি ১৬৫০ ইউরো লেখা হয়েছে। ওটা ১৬ দশমিক ৫০ হবে। শিয়ালদা ষ্টেশন চত্বরে বেরিয়ে দেখি সরকারী বেসরকারি বাসের মেলা বসে গেছে। বাসের ফাঁকে ফাঁকে রাস্তা খুঁজে বি আর সিং হাসপাতালের দিকে যেতে হল। দুটি বড় মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। একটির দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার সেই বছর পনের আগের মত, কয়েকজন ডাক্তার গলায় আলা ঝুলিয়ে বসে আছে। মেদিনীপুরের গ্রামের বাড়িতে থাকার সময়, বহু বছর আগে, আমরা ছেলেরা পাড়ার লোকেদের পুকুর পাড়ে , কয়েতবেল কুড়াতে যেতাম। পাশেই ছিল একটা বাঁশের ঝাড়। ওখানেই সকলে পায়খানা করার জন্য যেত। ওটাকে ওরা বলত, “ গু বন!” সেই সময় কিন্তু আমাদের সেই বেল কুড়ানোর নেশায়, গু বন, বাঁশ বন, তুলসী বন, বিছুটি বন কিছুই আলাদা করে বোঝার ক্ষমতা ছিল না। এখন চিন্তা করলে , গা ঘিন ঘিন করে। পনের বছর আগে, আমরাও ডাক্তার নেতা, দাদাদের পিছু পিছু দল বেঁধে গিয়ে, মঞ্চে বসে ঘণ্টা তিন চার কাটিয়ে আসতাম। একবার সল্টলেক স্টেডিয়ামে, আমাদের একে বিভাগীয় প্রধান, প্রফেসার ম্যাডামের সাথে বসে, “ ডিম্ভাত” খেয়ে নিলাম। তখনও অবশ্য এই “ ডিম্ভাত” কথাটা একটা একশ শতাংশ রাজনৈতিক কথা হয়ে যায়নি। ঠিক সেই গুছাইত বাড়ীর “গু বনে “ ঘুরে আসার কথা মনে পড়ে এখন, এদের দেখে। সেই ম্যাডামও আমার থেকে বছর তিনেক আগে অবসর নিয়েছেন। আর দেখা হয়নি। দেখা হলে জানার আগ্রহ আছে, ওনারও এখন, পিছনে তাকিয়ে, গা ঘিন ঘিন করে কি না।



বিদেশ ভ্রমণ ২৫ ( কিংবা কালো কোটের অসভ্যতা)

দুটো দশ পর্যন্ত জজ ম্যাডাম খেতে উঠতে পারেননি। উনি মাঝে মাঝেই সরকারী উকিল বাবুকে গালাগাল দিচ্ছেন। কোন রকম কাগজ পত্র দেখে আসার বালাই নেই। একজন করে সাক্ষীকে তুলছেন; কেন ডেকেছেন, কি জানতে চাইছিলেন, কিছুই জানেন না। তাই দশ মিনিট এর কাজে আধ ঘণ্টা লাগছে। জাজ ম্যাডাম দুটো সতেরোয় বলে দিলেন যে উনি এখন যে মহিলার সাক্ষী নিচ্ছেন, তার পর খেতে নামবেন। অর্থাৎ আমরা সাড়ে তিন বা তার পর ডাক পাব। বেশ, বোকার মত বসে আর কি করা যায়; আজ ভেনিসের কথা লিখি বসে বসে। আমার সাথে একই কেসে আর একজন পুলিশ অফিসার এসে হাজির হয়েছেন, এগারোটা নাগাদ। উনি বসার জায়গা পাচ্ছেন না। আর একটি কেসে একজন সিনিয়ার পুলিশ অফিসার এসেছেন, তাই এ বেচারা বেঞ্চ খালি পেলেও বসতে পারছেন না। আমি ব্যাপার বুঝে, নিচে নেমে , ডিম টোস্ট আর চা খেয়ে নিলাম। ইউরোপে বারদিন তো দুপুরে বার্গার আর আলুভাজা খেয়েই চালিয়ে দিলাম।      ভেনিস যাওয়ার পথে, বার্গার কিং এর রঙ্গিন টুপী মাথায় ছবি তোলার কথা আগেই লিখেছি। ইটালির এলাকায় ঢুকে, একটু একটু করে রাস্তার পাশের দৃশ্য পাল্টাতে দেখলাম। সেই প্যারিস থেকে সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, তারপর অস্ট্রিয়ার প্রান্তরে গমের মত এক রকমের ফসলের ক্ষেত দেখতে দেখতে এলাম। ইটালিতে ঢোকার ঘণ্টা খানেক পর থেকে , রাস্তার দুই পাশে অন্য রকমের কিছু ফসলের মাঠ দেখতে পেলাম। মাঠের পরে একটু উঁচু টিলার মত পাহাড়। প্রথম প্রায় পঞ্চাশ কিমি মত আমরা ওগুলি কিসের চাষ বুঝতেই পারছিলাম না। প্রথম, আমাদের দলের এক স্কুলের দিদিমণি বললেন, ওগুলি আঙুরের গাছ। আমি বাঁকুড়ার ফুলবেড়িয়া গ্রামে, পি কে সরকার স্যারের আঙুর বাগান দেখে এসেছি। সেই বাগানে মে মাসের শেষের দিকে বেশ আঙুর ধরে ছিল। কিছু গোল গোল আঙুর পেকে কালো হয়ে ছিল; আমরা খেয়ে দেখেছি। ইটালির এই মাঠের আঙুর লতাগুলি দেখে মনে হলো, আরও দেড় দুই মাস পর আঙুর ধরবে। যতোই ইটালির ভেতরের দিকে ঢুকতে থাকলাম, মাঠের আঙুর এর লতাগুলী লম্বা দেখতে থাকলাম। টানা লাইন করে লাগানো আঙুরের লতা, আমাদের এখানকার উচ্ছে বা পটলের মাচার মত ব্যবস্থা করা হয়েছে। হয়তো পাঁচ- ছয় শ’ কিমি রাস্তা, দুই পাশে আঙুর আর অন্য এক রকমের বেঁটে বেঁটে গাছের বিশাল বিশাল প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে চলল। আমাদের দলের আর এক ডাক্তারবাবু , যিনি পরে একাই ছুটে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির জন্ম স্থান দেখতে চলে গেছলেন, তিনিই মোবাইলে খুঁজে বের করে বললেন, ওগুলি অলিভ এর চাষ। অলিভ মানে তো আমরা জলপাই জানি। জলপাই এর গাছ আমি চিনি। সেই উত্তর বঙ্গের, ইটাহার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, আমার কোয়ার্টারের পিছনে একটি চারা লাগিয়ে এসেছিলাম; বছর পাঁচ সাত পরে গিয়ে দেখি, সেই গাছ, তিন তলার সমান উঁচু হয়ে গেছে। এই ইটালির মাঠের অলিভ গাছ খুব বড় হলে, তিন চার ফুটের বেশি হবে না। পরে অবশ্য কোন কোন মলে, এই অলিভ ফলের আচার, কাঁচের বয়ামে রাখা আছে, দেখেছি। আমাদের দেশী খেজুরের মত, একটু বেঁটে, হলদে সবুজ ফলগুলি। বিকেলে ভেনিস শহর এর কাছে পৌঁছে দেখি, দুই দিকে দিগন্ত জোড়া জলার মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলেছে। একটি জায়গায় বাস থেকে নেমে, বাংলাদেশী লোকেদের বাজারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে একটি বেশ চওড়া নদী বা খালের পাড়ে পৌঁছলাম। পবন বলেছিল, এখান থেকে “ এভাপোরেটর” চেপে, ভেনিস যেতে হবে। পর পর একতলা, দোতলা, মেশিন চালিত জলযান এসে, দলে দলে লোক নিয়ে, ঘাট থেকে বেরিয়ে গেল। আমরা একটি ছোট, কাঁচে ঢাকা নৌকা পেলাম। এত ছোট জলযান দেখে আমাদের একটু মন খারাপ হয়ে গেল। ফেরার সময় অবশ্য দোতলা নৌকা পেয়েছি। এগুলিকে আসলে বলে, ওয়াটার বাস। আমি ভেতরে ঢুকে না বসে, চালকের পাশে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করে গেলাম। একে একে আরও তিন চার জন এসে দুই পাশে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে গেলেন। চালককে জিজ্ঞেস করে জানলাম, যে জলপথ দিয়ে চলেছি, সেটার নাম, “ক্যানালি দা জুডেইকা”। ডান দিকে যে শহর দেখা যায়, সেটার নাম, “জুডেইকা”। ঐ জলপথ বা ভেনিস শহর এর সব খালই, ভূমধ্য সাগরের সাথে যুক্ত। মিনিট পনের চলার পর ওদিকের ঘাটে দাঁড়াল আমাদের জলযান। ঐ খালের ডান পাড় ধরে, সকলে ম্যানেজার পবনের পিছু পিছু চললাম। আবার সেই, “সাবধান, সাবধান” রব উঠল। প্রায় মেলার মত লোক চলেছে। মাঝে গোটা তিনেক ছোট খালের উপর সেতু পেরিয়ে গেলাম। পবন বলেছিল, এক এক সময় ঐ সেতুগুলির উপর ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি হয়; পকেটমার তার কাজ করে। একটি সেতুর উপর দাঁড়িয়ে পবন, ডান দিকে, একশ দেড়শ ফুট দূরে একটি বাড়ী দেখিয়ে বলল, ওটি ছিল, জেলখানা। তার পরের সেতু থেকে একটি বাড়ীর তিন তলায় একটি জানালা দেখিয়ে বলল, ওটার নাম, “ লাস্ট সাই!” জেলখানা থেকে মৃত্যু দণ্ডের জন্য নিয়ে যাওয়ার সময়, ঐ জানালা দিয়ে, শেষ পৃথিবীর আলো দেখতে পেত , আসামী।      ( আমি কোর্টে সাক্ষী দিতে এসে ঠিক আসামীর মত ব্যাবহার পেলাম। দশটা পনের মিনিট নাগাদ ঢুকে, পাঁচটা পঞ্চাশ নাগাদ ছাড়া পেলাম। তারপর হেঁটে মেট্রো স্টেশনে এসে, চাঁদনী চক থেকে মেট্রোতে উঠেছি, সোয়া ছয়টা নাগাদ। মেট্রোতে বসে, কিছুটা লিখে, মনটাকে ঐ দিকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি।)আমরা পবনের সাথে হেঁটে একটা বড় বাঁধানো চত্বরের মধ্যে গিয়ে থামলাম। এর নাম , ‘ সেন্ট মার্কস স্কোয়ার’, পবন ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকটি জিনিস দেখিয়ে দিল। খালের দিকে দুটি প্রায় তিন তলা উঁচু থাম দেখিয়ে বলল, ঐ দুই থামের থেকে , সম্ভবত ফাঁসী দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। ওদিকে তাকালে বাম দিকে যে চার তলা বাড়ী, তার অন্য তলার, অন্য সব থাম সাদা রঙের, কিন্তু তিন তলার মাঝের দুটি থাম হলদে গোলাপী রঙের। পবন বলেছিল, ঐ বিশেষ বারান্দা রাজা বা সম্রাটের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। ওনারা ঐখানে বসে, ফাঁসী দেখতেন। ওর পাশের বড় প্রাসাদোপম বাড়ীতে উপরের দিকে দেওয়ালে কিছু ছবি অর্থাৎ পেন্টিং আছে। পুরনো হলেও বেশ পরিস্কার ছবি। ইউএকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কিছু একটা বাক্স খুলে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু অন্য রকম পোশাকের লোকেরা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেই মৃতদেহ এদের জন্য নিষিদ্ধ প্রানীর মাংসে ঢাকা ছিল। পবন বলেছিল, এই ভেনিসের কোন ব্যবসায়ী অর্থাৎ সওদাগর, মিশরে গিয়ে মারা যায়। সেখান থেকে মৃত দেহ আনার নিয়ম ছিল না। তার সাথের লোকেরা, এক ফন্দি করে, বাক্স ভরে সেই মৃত দেহ দেশে ফিরিয়ে আনে।         ওখান থেকে একটু গলি পথে এগিয়ে, সেই পৃথিবী বিখ্যাত গন্ডোলা রাইড এর ঘাটে এসে হাজির হলাম। এক নৌকায় পাঁচ জন করে উঠতে দেবে। মাঝি একজনই; একটিই হাল বা দাঁড় । মিনিট দশেক লাইনে দাঁড়িয়ে নৌকায় উঠলাম। পরের পর গন্ডোলা নৌকা ঘাট থেকে ছেড়ে চলল। গোটা একটা শহর। খালের পরে খাল, ডাইনে বাঁয়ে খাল, এদিকে কোন রাস্তা নেই, অন্য কোনো দিকে আছে হয়তো। মাঝে মাঝেই খালের উপর দিয়ে সেতু। সেই সেতু দিয়ে লোকজন যাওয়ার সময়, আমাদের দিকে হাত নাড়ছে। আমরা পাঁচজন একই পরিবারের, তাই আমি আর যোগেশ মোবাইলে ভিডিও কল করে, আমাদের বাড়ীতে থাকা , ছেলে মেয়ে সকলকে ভেনিসের খাল, সেই খালে চলা গন্ডোলা নৌকা, পাশের ঘর বাড়ী সব দেখলাম। আমাদের নৌকার মাঝি ছেলেটি একটু কম কথা বলে। সম্ভবত ইংরেজী বলতে পারে না। অন্য নৌকার এক বয়স্ক মাঝি, যাত্রীদের সাথে বেশ রগড় করছে দেখলাম। ওকে দেখে আমার নর্মদা নদীর নৌকার মাঝির কথা মনে পড়ল। জব্বলপুরের কাছে বিখ্যাত মার্বেল রকের মধ্যে নৌকা ভ্রমণ বেশ বিখ্যাত। ওখানে নৌকাগুলি গন্ডোলার মত সুন্দর নয়, সাধারণ ডিঙ্গি নৌকা। মাঝিরা বেশ ছড়া কেটে কেটে সব কিছুর বর্ণনা দিতে থাকে। কাশ্মীরের ডাল লেকের শিকারা ভ্রমণও বেশ বিখ্যাত। আমরা আবার না জেনেই , কোজাগরী লক্ষী পূজার বিকেলে শিকারায় উঠেছিলাম। একটু পরে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল। আমাদের ডাল লেকের শিকারা ভ্রমণ তাই নতুন মাত্রা পেয়ে গেল। ওখানেও শিকারা চালকেরা অনেক কথা বলে, বর্ণনা দিতে থাকে। কিন্তু সবসময় যেন কোন হাউস বোটের দোকানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। ডাল লেকের শিকারা নৌকার পাশে পাশে অনেক ফেরিওয়ালার ডিঙ্গি নৌকা চলতে থাকে, এটা ওটা বিক্রীর জন্য পাশে এসে দাঁড়ায়। ভেনিসের খালে সেরকম কিছু নেই। মাত্রই মিনিট পনের কুড়ির নৌকা ভ্রমণ। কিন্তু একটা পৃথিবী বিখ্যাত ভ্রমণ স্থান। তাই এই ভ্রমণটি করে বেশ অন্য রকম এক অনুভূতি হল। একটা ব্যাপারে আমাদের কারো কারো একটু আপত্তি দেখলাম। ভেনিসের খালের জলে একটা কটু গন্ধ মাঝে মাঝে নাকে লাগছিল। তার মানে এটা নয় যে, জলে যত্রতত্র প্লাষ্টিক ভেসে বেড়াচ্ছে। ঐ সভ্যতা ধ্বংশ করা উৎপাত ঐ নটি দেশের কোথাও আমি দেখিনি। ওয়াটার বাসে ফেরার সময় আমরা সবাই দোতলায় বসে এলাম। সূর্য তখন পশ্চিম দিকে প্রায় পাটে বসছেন; তাই বিশাল চওড়া খালের জলে অস্তাচলের সূর্যের কিরণ আমাদের ভেনিস ভ্রমণকে আরও মায়াময় করে দিয়েছিল। এপারের সেই বাংলাদেশীদের বাজারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে ফেরার সময়, ওরা স্বাভাবিক ভাবেই ডাকাডাকি শুরু করলো। কেউ কেউ ওদের দোকানে ঢুকে দুই একটা মেমেন্টো কিনেছেন। কিন্তু আমরা ভারতীয় বাঙালি বোঝার পর ওদের যেন কেমন ব্যাজার মুখে তাকাতে দেখলাম। আমাদের বাসে চেপে মিনিট কুড়ি এসে , একটি ভারতীয় রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে ঢুকলাম। বাইরে বেরিয়ে অপেক্ষা করার সময় ওদের খাদ্য তালিকা দেখলাম, লম্বা বোর্ডে ইংরেজিতে লেখা। ছবিও তোলা হল। দেখলাম, ভেজ বিরিয়ানি এক প্লেট ১৬৫০ ইউরো। অর্থাৎ আমাদের দেশের টাকায় প্রায় ১৬০০ টাকা। ওখান থেকে বাসে চেপে, শহরের বাইরে একটি সুন্দর হোটেলে এসে রাত্রে থাকলাম। এই হোটেলের সেন্ট্রাল এ সি বোধহয় ঠিক ছিল না। আমার তো এ সি লাগেই না। তাই সমস্যাটা বুঝতেই পারিনি। যোগেশ আর আমার কন্যা অনেক কসরত করেও, ওদের ঘরের ঠাণ্ডা মেশিন চালাতে পারেনি। পরদিন সকালে শুনলাম, যোগেশ রাত্রে ঘুমাতে পারেনি। আমার চাষার মত জীবন যাপন, এই একটি নমুনা দেখে বুঝলাম, বেশী আধুনিক হওয়ার বিপদও আছে। আজ ১৯ জুলাই। গতকাল সারাটা দিন এক কোর্টে সাক্ষী দিতে গিয়ে নষ্ট করে এলাম। সকাল নটা পাঁচ নাগাদ বাড়ী থেকে বেরিয়ে, সন্ধ্যা ছয়টা চল্লিশে বাড়ী ফিরে, আর লেখার মত মনের অবস্থা ছিল না। আমার জীবনে বহু বহু বার অদ্ভুত অদ্ভুত সমাপতন ঘটেছে। সরকারী ভাবে বরিষ্ঠ নাগরীক হয়েছি ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। ইনকাম ট্যাক্স, ব্যাংকের কাজ বা ট্রেনের টিকিট কাটার সময়, জন্ম তারিখ থেকেই লোকটা সিনিয়র সিটিজেন বুঝে নেয়। কিছু কিছু আর্থিক সুবিধাও পাওয়া যায়। গত কালই আমার কন্টাক্ট লিষ্টে থাকা, আনন্দবাবু একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। এই বাতিল ( ভদ্র ভাবে যাদের বরিষ্ঠ নাগরীক বলে) মানুষদের সরকারী ভাবে কি কি সামাজিক সুবিধা দেওয়ার কথা তার তালিকা। আর কালই কোর্টে বসে বসে যেভাবে মানসিক আর শারীরিক নির্যাতন পেয়েছি, আনন্দবাবু নেহাত বয়স্ক মানুষ বলেই একটা বাঙলা গালাগাল দিতে পারিনি। আমার বন্ধু স্থানীয় কেউ হলে, অবশ্যই গালাগালি খেয়ে যেত। এই বাঙালি সমাজের কাছে আমার বিন্দুমাত্র কোন পাওয়ার আশা নেই। যারা নিজেদের শিক্ষিত, ভদ্র, বরিষ্ঠ বা নেহাত “ ডাক্তার” বলে এই সমাজের কাছে ভদ্র ব্যবহার আশা করেন এখনও, তাঁদের জন্য আমার করুণা ছাড়া অন্য কিছু দেওয়ার নেই। কিন্তু কাল, এক শ্রেণীর মানুষের প্রতি যে “ ঘৃণার” মানসিকতা আমার চির দিনের জন্য মনের গভীরে ঢুকে গেল, সেটার থেকে বোধহয় আর মুক্তি নেই। কালই বিকেলে সেই ভেনিসের সেন্ট মার্কস স্কোয়ারে, দেওয়ালের ছবিতে, মিশরের লোকেদের ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কথা লিখলাম। ঠিক সেই সময়ই মনে হল, কালো কোট গায়ে জনা দশেক প্রাণী আমার দিকে বন্য বরাহের মত দাঁত বের করে হাসছিল। আমি সকাল থেকে বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত বসিয়ে রাখার কথা মহিলা বিচারককে জানালে, উনি সরকারী উকিলটিকে বেশ ধমক দিচ্ছিলেন। ঐ বন্য বরাহের মত প্রাণীগুলির কেউ কেউ আবার সেই অমানবিক সরকারী উকিলকেই সমর্থন করে টিপ্পনী কাটছিলেন। ডাক্তার হিসেবে কারো কাছে বিন্দু মাত্র সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করি না বহু বছর হল। একটা ছেষট্টি বছর বয়সী লোক, ছয় ঘণ্টার উপর এক জায়গায়, বেঞ্চে বসে ছিল; জাজ মহিলা নিজেই বললেন, “ ওনাকে তো আমি দশটা সতের থেকে বসে আছেন দেখেছি!” সেটা জানার পরও যে প্রাণীগুলি দাঁত বের করে মজা করে, তাঁদের দেখলেই তো এরপর থেকে মনে হবে, ড্রেন থেকে উঠে এল। আমার সন্তান সম নতুন ডাক্তারদের বহু বহু বার বলেছি, একমাত্র মেট্রোর লাইনে ঝাঁপ দিয়ে পড়া ছাড়া অন্য অপশন না থাকলে এই চাকরীতে এসো না। সারা চাকরী জীবন কেউ বিন্দুমাত্র সম্মান দেবে না। চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর শুধু আমার মত হেনস্থা হতেই হবে, হতেই হবে। আমার কালকের দুর্দশার কথা শুনে, আমার এক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক লিখেছেন, “ এইরকম প্রতি সপ্তাহেই ভুগছি, সত্তর বছর পেরিয়ে গেছে, সামনের সপ্তাহেই কোলকাতা থেকে দুই শ কিমি দূরে সাক্ষী দিতে যেতে হবে।” তাই সাধু সাবধান। বিন্দু মাত্র সুযোগ পেলে, এই “চোরের চাকরি“ থেকে শত হস্ত দূরে থাকতে হবে। আমার এক বন্ধু দুদিন আগে বলছিল, “ যো ডর গিয়া ও মর গিয়া।” আমি বলছি, “ যো ঘুস গয়া, ও ফাঁস গয়া!”




বিদেশ ভ্রমণ ২৪

আমি আগেও কোথাও লিখেছি, অষ্ট্রিয়ার ইন্সব্রুক শহরের কাছে যে, সরোভস্কি ক্রিস্টাল মিউজিয়াম আছে, সেটাকে একশ নম্বর দিলে, লণ্ডনের মাদাম তুসোর খেলনা মিউজিয়ামকে আমি দশের বেশী দেব না। এই বিদেশী ভাষার কিছু কিছু শব্দের বাংলা উচ্চারণ নিয়ে সমস্যা আছে। বিশেষ করে ফরাসী বা রাশিয়ান ভাষার বাংলা উচ্চারণে বেশ ঝামেলা আছে। এই যে স্বরোভোস্কি কথাটির মাঝে ভি আছে, এটা অনেকে বাদ দিয়ে উচ্চারণ করে। আমাদের ম্যানেজার পবন এটা সরোস্কি উচ্চারণ করছিল। সে যাই নাম বলি না কেন, যাঁরা অস্ট্রিয়া যাবেন, চেষ্টা করবেন এই ক্রিস্টাল মিউজিয়ামটি দেখতে। বাসে যেতে যেতে পবন বলে দিয়েছিল, এত বেশী ছবি তোলার মত মনে হবে যে, এখানেই দেরী হয়ে যাবে। তার থেকে ভিডিও করে নিতে পারলে ভালো। পবন মজা করে আর একটা কথা বলে দিয়েছিল; এই একটি জায়গায় দাদারা তাড়া লাগায়, বৌ দিদিরা বের হতে চায় না। ( এখানে একটি কথা বলে নিই। গত পর্বে লিখেছিলাম; সকাল দশটায়, নিধিরাম সর্দারকে আদালতে যেতে হবে; এক মহান দায়িত্ব পালন করতে। আমি দশটা পাঁচ নাগাদ এই আদালত বাড়ীর নিচে এসে হাজির হলাম। আর যাই হোক, এটা আমাদের সাধের, এবং গর্বের মাতৃভূমি ; তিরিশ বছর একটা সরকারী চাকরী করে, অবসরের আগে মাথার প্রায় সব চুল পাকিয়ে নিয়েছি। তাই তিন তলায় ওঠার আগে, একটি দোকানে বসে চা খেয়ে নিলাম। তিনি তলায় ওঠার জন্য লিফ্ট পেয়ে গেছি; এর জন্য নিশ্চয়ই গর্ব করতে পারি। কুড়ি নম্বর কোর্ট এর ঘরে ঢুকে একজন কর্মচারীকে পেয়ে গেলাম, এর জন্য আমি এই রাজ্যের বাসিন্দা হিসেবে ধন্য। কিন্তু আমি কে, কি জন্য এসেছি বলার পর, উনি যা বললেন, তাতে একেবারেই নিশ্চিত হওয়া গেল যে, এটাই আমার গন্তব্য। উনি বললেন, এত সকালে এলেন কেন? উকিল বাবুরা এগারোটার আগে আসে না। বসুন কথাটি বলার মত পরিশ্রম করতে, ওনাদের কেউ বেশী বেতন দেবে না; এটা উনি যেমন জানেন, আমিও জানি, হাড়ে জানি। তখনও ঐ ঘরে আমরা এই দুটি মানুষ। গোটা তিনেক চেয়ার আর, একটি বেঞ্চ আছে দেখলাম। এক পাশের একটি চেয়ারে বসে গেলাম। সাড়ে দশটা নাগাদ পাশের দরজা দিয়ে, কালো জোব্বা পরিহিতা এক মহিলা হনহন করে হেঁটে সোজা বিচারকের আসনে বসতে চেষ্টা করছেন দেখলাম। সেই প্রথম কর্মচারি ওনার পিছন পিছন সেই উঁচুতে রাখা বিচারকের আসনের কাছে পৌঁছে, মুখে একটি মৃদু শব্দ করে, যেন আমার দিকে তাকালেন। একবার খুব বেকায়দায় পড়ে, ব্যাপারটি জানি, তাই উনি কি বলতে পারেন তার একটি ধারণা ছিল। তাই “ হুজুর আসছেন বা এসেছেন” , ধরে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মিনিট দশেক পর থেকে, এক এক করে অন্য কর্মচারি এলেন। কিন্তু বিচারকের চোখের সামনে বসে, মোবাইল ফোন বের করতে পারছিলাম না। এগারোটার পর থেকে এক এক করে কালো কোট গায়ে উকিল বাবুরা আসতে থাকলেন। আমি ঢুকেই, ঐ কর্মচারীকে আমার কেস নম্বর বলেছি; তাই উনি যা করেন, সেই ভরসায় বসে বসে , বিচার প্রক্রিয়া দেখতে থাকলাম। বারোটা পর্যন্ত সময় ঐ ভাবেই কাটল। এত সময়ে ঘরের মধ্যে জন দশ বারো উকিল, আর জন পাঁচ সাত অন্য লোকজন এসে গেছে। আমি বিচারক মহিলার চোখের আড়ালে চলে গেছি বুঝে, মোবাইল বের করলাম। এবার আমার সময় কাটানোর নিজস্ব উপায় কাজে লাগালাম। এই সব অঢেল অতিরিক্ত সময়ে, মোবাইলে লেখা, এই হল আমার নিজস্ব উপায়) । এখন একটা বেজে গেছে; এবার তাহলে অস্ট্রিয়ায় ফিরে চলুন।

     বাসের থেকে নেমেই একটি বড় বাঁধানো চত্বরের মধ্যে, একটি জিনিস দেখে, তার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ওখানে একটি কৃষ্টালের বিরাট বড় মডেল রাখা আছে। পবন আমাদের তাড়া দিয়ে মিউজিয়ামের দিকে নিয়ে চলল। এসব যেহেতু ট্যুর কোম্পানী থেকেই ঠিক করে রাখা, তাই আমাদের নিজের নিজের টিকিট কাটার জন্য আর দাঁড়াতে হল না। একটু খোলা মাঠের পর , ঢোকার গেটটি বেশ দেখার মত। একটি সবুজ ঘাসে ঢাকা টিলার মত, মাঝখানে মানুষের মুখমণ্ডলের মত; চকচকে দুটি চোখ, মুখ দিয়ে জলের ধারার মত জিভ। টিলার তলা দিয়ে, সুড়ঙ্গের মত ঢোকার রাস্তা। মিউজিয়াম বাড়ীতে ঢুকে থেকেই চমক। হাজার রকমের কৃষ্টাল আর কৃত্রিম মণি মানিক্য দিয়ে নানান মূর্তি তৈরী করা হয়েছে। একের পর এক ঘরে ঢুকছি, আর চমকে চমকে উঠেছি। মণি মানিক্য ইত্যাদির ঝলক, আর আলোর বৈচিত্র আমাদের ঘণ্টা দেড়েক একেবারে অন্য এক জগতে নিয়ে গেল। ছবি আর ভিডিও করতে করতে এগিয়ে গেলাম। যখন মনে হল চমক শেষ, তখন শুরু হল পবনের বলা সেই , “ দাদাদের বিপদ।” বিরাট এলাকা জুড়ে অলঙ্কার এর প্রদর্শনী। হাজার রকমের কৃত্রিম মণি মানিক্য দিয়ে তৈরী সব অলঙ্কার। মহিলাদের তো দেখলেই কেনার ইচ্ছা হবেই। আমার কন্যা আর তার পিসি বেশ কিছু জিনিস কিনে নিল;নিজেদের জন্য, আত্মীয় স্বজনদের জন্যও। দামের ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করা আর আমাদের গ্রামের বাড়ীতে গরু ছাগল যে দেখত সেই কানাই বুড়িকে লণ্ডনের মাদাম তুসোর মিউজিয়ামের বর্ণনা দিতে বলা, একই রকম হবে। এর পর আমরা চললাম ভেনিস শহর এর উদ্দেশ্যে। সেই ভেনিস, যেখানকার সওদাগরের গল্প আমরা স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়, ইংরেজিতে পড়েছি। আর চল্লিশ বছর আগে, আমার ডাক্তার দাদা, কোলকাতার বিখ্যাত বাবুলাল দাদার কাছে শুনেছি, এমন একটি শহর আছে, যেখানে রাস্তা নেই; তার বদলে আছে, অসংখ্য খাল। সেই খালে এক বিচিত্র নৌকো চলে; যার নাম “ গন্ডোলা!” আমরাও সেই গন্ডোলায় চাপতে চলেছি। 

আজ ১৮ই জুলাই , এখন একটা আটত্রিশ বাজে। দশটায় ডাকা হয়েছে আমাকে। দুটোর আগে কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না। বেশ, আমি না হয় একটা অবসর নেওয়া বেকার লোক। কত কাজের মানুষ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসে, চুপ চাপ বসে আছে। এই দেশের কোন উন্নতির আশা করাটাই আহাম্মকের মত কাজ হবে।



বিদেশ ভ্রমণ ২৩

অস্ট্রিয়া দেশের ইন্সব্রুক শহরে আমরা বিকেলের দিকে পৌঁছেছিলাম। পুরনো শহরে ঘন্টা দুই ঘোরার পর আমরা হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। প্রায় সব শহরেই আমরা মূল শহরে না থেকে , একটু শহরতলীর  দিকের হোটেলে থেকেছি। এখানেও একটু পুরনো শহরের বাইরে একটি হোটেলে উঠলাম। এই হোটেলের রাতের খাবার অন্য জায়গার মত হবেনা, বাসেই বলেছিল, ম্যানেজার পবন। এখানে আমরা হোটেলের ঘরে ব্যাগপত্র রেখে, মুখহাত ধুয়ে, নিচে খেতে নামলাম। অন্য হোটেলের মত এখানে বুফে ডিনার নেই। আমরা চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে যাওয়ার পর, টেবিলে টেবিলে খাদ্য বস্তু পোঁছে দিতে থাকলেন, জন তিনেক মহিলা কর্মচারি। আমার যেহেতু খাওয়ার নিয়ে বিশেষ চাহিদা কিছু নেই, তাই কোন অসুবিধা হয়নি। একটাই চাহিদা, লাল লংকার গুঁড়ো না দিলেই হল। এই বারো দিনে , একটি হোটেলেই, একটি ভারতীয় রান্না আমার ঝাল মনে হয়েছিল; সেটা সম্ভবত ভেনিসে। এখানে পরিবেশন করছিলেন যে মহিলারা, তারা ঠিক অন্য এগারোটি হোটেলের কর্মচারিদের মত মিষ্টভাসি ছিলেন না, একথা আমি আমাদের মহিলাদের কাছে শুনেছি। আর একটি নতুন কথা শিখলাম এখানে। আসলে কথাটা নতুন শুনলাম এরকম নয়; এই ভেতো বাঙালী ডাক্তারের ঐ পশ্চিমী আদব কায়দা নিজে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আগে হয়নি। ঐ যে, পরিবেষণকারী টেবিলে টেবিলে এসে খাওয়ার “সার্ভ” করে গেলেন, এর একটা গাল ভরা নাম বলেছিল, পবন; “ থ্রি কোর্স ডিনার।” আমার এক ডাক্তার ভাই প্রথম দিকেই বলেছিলেন, ঐ সকল দেশে ঘুরে, লোকজন, রাস্তাঘাট, খাদ্য পানীয়ের ব্যাপারে যেন বিস্তৃত লিখি। তাই এই সামান্য ব্যাপারটি নিয়ে আপনাদেরকে কয়েকটি কথা লিখে জানালাম। 

ইন্সব্রুকের এই আল্ফ হোটেলে আর একটি কৌশল শেখা হলো। আমরা খেয়ে উঠে বেসিনে দাঁত মাজার সময়, আমাদের কন্যা কি করে যেন, বেসিন থেকে জল নামার মুখে লাগানো ঢাকনা বন্ধ করে দেয়। আর ওটা খোলা যাচ্ছিল না। আমার পায়ের ব্যথাটা বেশী থাকায় আমি একবার চেষ্টা করে শুয়ে পড়েছিলাম। কন্যা প্রথমে ওদের রিসেপশনে ফোন করে জানানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ওরা নাকি ওর ইংরেজি বুঝতে পারছিল না। দরজার কার্ড নিয়ে, নিচে নেমে ওদের সমস্যাটা বোঝানোর পর, ওরা বুঝিয়ে দেয়, কলের পিছনের একটি হুক মত জিনিস টেনে বা চেপে ঢাকনা খুলে নেওয়া যায়। কিন্তু সেটা করা গেল না। এবার ফোন করতে, একজন হোটেলের কর্মচারি এসে চাপাচাপি করে দেখল, হলো না। তখন নিচে গিয়ে, যন্ত্র পাতি এনে ওটাকে ঠিক করে দেয়। 

 

সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, সুন্দর পাহাড় দেখা যাচ্ছে। কালো পাহাড়ের গায়ে সাদা মেঘ আটকে আছে। পাহাড় চূড়ায় একটু সাদা বরফও দেখা যাচ্ছে । এই পাড়ার বাড়িগুলি সবই আধুনিক, কিন্তু দুই তিন তলার বেশী উঁচু নয়। এই এলাকাটা ব্যাঙ্গালোরের বা হায়দরাবাদের কোন পাড়া বললেও ছবি দেখে লোকে মেনে নেবে। এদের এখান থেকে প্রাতরাশের পর তলপি গোটানো হল। এদের প্রাতরাশের ব্যবস্থাও আগের সব হোটেলের মতই। এখানে একটি ছবি তুলে রাখার মত জিনিস দেখলাম। গরম জল রাখার পাত্রটি অদ্ভুত সুন্দর। সম্ভবত স্টেইনলেস স্টিলের ; কিন্তু এত ঝকঝকে যে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। যেন আরব্য উপন্যাসের চরিত্র এই পাত্রটি। 

 

এই হোটেলের থেকে বেরিয়ে, মিনিট পনের কুড়ির মধ্যে আমরা পৌঁছলাম , সোরোভোস্কি ক্রিস্টাল মিউজিয়াম। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে, কী অপূর্ব সুন্দর, নয়নাভিরাম সব জিনিস তৈরী করেছে , তার বর্ণনা লেখা আমার অসাধ্য। আমার সামান্য মোবাইলে কিছু কিছু নমুনা তুলে এনেছি। আমার ইউ টিউব ভিডিও তে দেখলে কিছুটা আন্দাজ পেয়েছেন। ইউরোপ ভ্রমণ আট নং পর্বে রেখেছি। ঐ নিয়েই একটি গোটা পর্ব লিখতে হবে।

 

       এবার আমাদের গন্তব্য ইটালির ভেনিস শহর। আজও আমাদের বেশ লম্বা বাস যাত্রা। সকাল নটা থেকে বিকেল প্রায় চারটা বাজবে ভেনিসে পৌঁছতে। শুনতে কষ্টকর ব্যাপার মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই। না, এইসব দেশের রাস্তা এতোই ভালো যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বসে চলতেও কোন কষ্ট হয় না। আমরা ঘন্টা দুই চলার পর, রাস্তার পাশের একটি শপিং মলে ঢুকে, বিনাপয়সায় শৌচালয় ব্যবহার করে নিলাম। তারপর ওদের পণ্য সম্ভার এর ভেতরে ভেতরে একটু ঘুরে দেখে এলাম। দুই চারজন কিছু কিছু কেনাকাটা করে নিলেন। এই মলে দুটি জিনিস আমার চোখে পড়েছে। এক ওরা প্রায় কেউ ইংরেজি বলে না ; কোথাও ইংরেজী লেখাও নেই। লেখার ব্যাপারটা শৌচালয় ব্যবহার করতে গিয়েই দেখলাম। এরা মেল, ফিমেল, বা লেডিস - জেন্টস লেখেনি। লিখেছে উওমো আর ডোন্যা। পাশের ছবি দেখে বুঝে নিতে হল। আর একটা ছোট্ট কুকুর। এই প্রাণীটি আমার খুবই প্রিয়। বিদেশের রাস্তায়, মলে, জাহাজে, বরফ ঢাকা পাহাড় চূড়ায় পর্যন্ত ওদের নিয়ে ওদের মালিকেরা ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। এই ছোট্ট, ঝকঝকে কালচে বাদামী রঙের কুকুরটি আবার আমাদের অধ্যাপক মামাকে পেয়ে খুব খুশি। খুশীতে লেজ নাড়তে নাড়তে মামার হাঁটু পর্যন্ত দুই পা তুলে উঠে যাচ্ছিল। 

 

দুপুরের খাবারের জন্য আবার একটি মলে ঢুকলাম। এখানে আবার টেবিলে টেবিলে বার্গার কিং লেখা মোটা কাগজের রঙ্গিন টুপী রাখা ছিল। সবাই একটা করে মাথায় নিয়ে ছবি তোলা হল। আমরা বুড়োরা শিং ভেঙ্গে বাছুর না হয়ে, টুপী মাথায় খোকা খুকু সেজে নিলাম। এই জায়গাটি আমার বিশেষ করে মনে থাকবে বহুদিন। ঐ টুপী মাথায় বসে বসে মোবাইলে ছেলের কাছ থেকে একটা ভালো খবর পেলাম। বিদেশে ভ্রমণ করতে যাওয়ার সময়, ওর জন্য একটা উদ্বেগ নিয়েই যেতে হয়েছিল। ওর ঐ বার্তা পেয়ে, মহাপুরুষদের একটা কথা আমার মনে হয়েছিল; “ মৃগ নাভীর গন্ধ লুকিয়ে রাখা যায় না!” অনেকক্ষন ছেলের সাথে হোয়াটস অ্যাপ এ ভিডিও কল করে কথা বললাম। বাইরে বেরিয়ে দূরের নীল নীল পাহাড়গুলি ওকে দেখালাম। বিকেলে পৌঁছলাম ভেনিস। 

আজ আমাদের ভেনিসের গন্ডোলা রাইড করার পরিকল্পনা আছে। আগেরদিনই ম্যানেজার পবন একটি মারাত্মক খবর দিয়েছে। দুদিন আগে এই গো কোম্পানির একটি দল ভেনিসে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে বিপদে পড়েছে। ঐ দলের দুজনের পাসপোর্ট চুরি হয়ে গেছে। বিদেশে সে যে কি সাংঘাতিক বিপদ, ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। ভেনিস যতোই সামনে এসে যায়, আমরা সকলে সকলকে সাবধান করে দিচ্ছি, “ প্রাণ ভোমরা” ঠিক আছে তো? সাবধান! পাসপোর্ট সাবধান! 

আজ ১৭ই জুলাই। সকালে অনেকদিন পর পাড়ার পুকুরে জল আনতে গেলাম। আমার একটি রঙিন মাছের একুয়ারিয়াম আছে। বছর খানেক থেকে ওটাতে পুকুরের জল দিয়ে দেখছি, মাছেরা ভালো থাকছে। মাস দুই এর বেশী হল, সকালে ঐ রাস্তা এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। ওখানে আমাদের পরিচিত একটি কালো কুকুর আছে। ভোরে হাঁটতে বেরনোর সময় ও ঐ রাস্তায় থাকে। আমাকে দেখলেই ছুটে এসে, খুশীতে গায়ে ওঠার চেষ্টা করে। বিস্কুট বা খাওয়ার দিয়েও দেখেছি; খাবার ফেলে আমার হাঁটুতে মাথা ঘষাতে ওর আগ্রহ বেশি। এই করতে গিয়ে, বেড়াতে যাওয়ার মাস খানেক আগে, আমার পায়ে জড়িয়ে রাস্তায় আছাড় খেয়ে, হাত আর হাঁটু ছড়ে গেছল। আজ জল নিয়ে ফেরার সময় আমাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে গায়ে উঠল। বারবার ওর সেই পুরনো অভ্যাস মত, আমার হাঁটুতে মাথা ঘষতে থাকল। পিছন পিছন অনেকটা রাস্তা চলে এল। আজ থেকে একটা জরূরী কাজ শুরু করলাম। তাই পরে কখন আর এই লেখাগুলিতে ছবি যোগ করার সময় পাব জানিনা। আজ তাই এটিতে কয়েকটি ছবি যোগ করা হয়েছে।

        বিকেলে আমার পুরনো আপিসের এক কর্মচারী হোয়াটস অ্যাপ -এ একটি নিমন্ত্রন পত্র পাঠিয়ে দিয়েছে। আগামী কাল সকালে দশটার মধ্যে, “ নিধিরাম সর্দারকে আদালতে “ সাক্ষী দিতে যেতে হবে। আমি প্রায় দেড় বছর আগে অবসর নিয়েছি। আজ যে রুগীকে দেখার জন্য আমার সাক্ষ্য গ্রহণ জরুরী মনে হচ্ছে, মহামান্য আদালত এর , সেটি তিন বছর আগে দেখা। আজ বিকেল সাড়ে তিনটায় আমার পুরোনো আপিসে ঐ নিমন্ত্রন পত্র পৌঁছেছে। দেশের এত কিছু উন্নতি হয়েছে, এই ব্যাপারটি এখনও সেই মান্ধাতার আমলের মত থেকে গেল। আমি এই নিমন্ত্রণ নির্দিষ্ট তারিখের দশ -পনের দিন পরেও পেয়েছি। আমার মত, ওই মামলায় হয়তো সাত -দশ জন সাক্ষীকে ডাকা হবে। সবার জন্য দুই- তিন বার করে চিঠি যাবে। কাল গিয়ে দেখব, হয়তো কেউ একজন মারা যাওয়ার জন্য সব আদালত বন্ধ। কিংবা খুব বেশি গরম পড়ায়, আদালতে অঘোষিত ছুটি চলছে। নয়তো কোলকাতার রাস্তায় জল জমে সরকারী উকীল বাবু এসে হাজির হতে পারেন নি। প্রতিটি উদাহরণ আমার নিজের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। কাল না হলে, আবার হয়তো সাড়ে তিন বছর পর একটা তারিখ পড়বে। ততদিনে এই রকম কত নিধিরাম সর্দার সাধনোচিত ধামে গমন করেছে। ধন্য আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা। 



২০২৪ সালের ভ্রমণ
Download File
দয়ালের দেখা মন্দির
Download File
জব্বলপুরের দিকে
Download File
কন্যাকুমারী ও ওদিকে
Download File

পাহাড়ে ভ্রমণ-২০২৪

2024 সালের 31শে মার্চ আমার চাকরী জীবন শেষ হল। বছর খানেক আগে থেকেই এই বিশেষ দিনটির জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েছি। 65 বছর বয়স পর্যন্ত চাকরী করে একটা নির্ভেজাল ছুটি পাওয়া যাবে, এটাই ছিল প্রধান ব্যাপার। চাকরী জীবনে একটানা সাতদিন ছুটি পাওয়া বেশ কঠিন ছিল। তাই চাকরী জীবন শেষ হলেই একটা লম্বা ছুটিতে বেরিয়ে যাব, এই ছিল পরিকল্পনা। মাস দুই আগে ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি রাতের কোন গাড়ীতে জায়গা নেই। অগত্যা সকালের কাঞ্চনজঙ্ঘা গাড়িতেই যাব ঠিক করলাম।

23এ এপ্রিল সকালে বের হলাম বাড়ী থেকে। শিয়ালদা স্টেশন থেকে গাড়ী ধরে সন্ধ্যায় নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছলাম। ওখানেই রেলের রিটায়ারিং রুম বুক করা ছিল, সন্ধ্যা আটটা থেকে পরদিন সকাল আটটা পর্যন্ত। ছটা থেকে আটটা পর্যন্ত ওয়েটিং হল এ বসে থাকতে হল। NJP স্টেশনে আগেও থেকেছি। বেশ বড় ঘর, মোটামুটি পরিষ্কার। পরদিন বেশ ভোরেই ঊঠে স্নান করে তৈরী হয়ে নিলাম। সাড়ে সাতটায় গাড়ী আসার কথা ছিল, ঠিক সময়ে এসে গেল গাড়ী। ঐ 24 এপ্রিল সকাল থেকেই শুরু হল আমাদের আসল ভ্রমণ। শহর ছাড়িয়ে সেবকের কাছে পৌঁছতে আধ ঘণ্টা মত লাগল। তারপরই জঙ্গল আর পাহাড় শুরু হল।

তিস্তা নদীর ধার দিয়ে পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ি চলল। কালিঝোরায় তিস্তার ওপর বাঁধ পেরিয়ে অন্য পারে গেলাম। তারপরই শুরু হল শুধুই উপরে উঠতে থাকা। মাঝে মাঝে গাছপালার ফাঁক দিয়ে নিচে তিস্তা নদী দেখা যায়। বেশ কয়েক মাইল ওঠার পর, এক জায়গা থেকে নিচে সেবকের করোনেশন সেতু দেখা গেল। ড্রাইভার জানাল, পর আরও ভালো দেখা যাবে। তাই এগিয়ে চললাম। বেশ কিছুটা উপরে ওঠার পর, পানবু নামে একটা জায়গায় পৌঁছলাম। ড্রাইভার জানাল ওটা একটা ভিউ পয়েন্ট। নেমে , রাস্তা থেকে একটু এগিয়ে নিচে দেখলাম দূরে তিস্তা নদী দেখা যাচ্ছে। একটু কুয়াশা থাকায় করোনেশন সেতু বোঝা গেল না। ওখানে কয়েকটা ছোট ছোট চায়ের দোকান মত আছে। একটাতে বসে মোমো খাওয়া হল। উল্টো দিকে পাহাড়ের ঢালে কয়েকটা কটেজ দেখা যায়, আমরা আর ওদিকে গেলাম না। প্রায় তিন ঘন্টা চলার পর লোলেগাও পৌঁছলাম। রাস্তার পাশে একটি ছোট বুদ্ধ মন্দির দেখিয়ে ড্রাইভার বলল, এটা দেখে নিতে পারেন। ওখান থেকে আমাদের হোম স্টে কাছেই জেনে, পরে আসা যাবে ভেবে আর নামলাম না। এবার গাড়ী পাহাড়ের উল্টো দিকে নামতে শুরু করল। বেশ ঘন পাইন এর বনের ভেতর দিয়ে মাইল তিনেক নেমে পৌঁছে গেলাম কাফের হোমস্টে।

  এই প্রবল গ্রীষ্মে ও ওদের বাগানে প্রচুর ফুল। প্রথমেই ভালো লাগে। সাধারণ ভাবে লোকে যে সময় পৌঁছয় আমরা তার অনেক আগেই পৌঁছে গেছি, তাই একটু বাইরে বসে থাকতে হল। যে কোন কারনেই হোক, আমাদের একটা চার বেডের ঘর দেওয়া হলো। পরে জেনেছি, ওটা ওদের সবথেকে ভালো ঘর। এবারই প্রথম কোন হোমস্টেতে থাকা। তাই সব কিছুই নতুন নতুন লাগছিল। আসলে আমরা বছর দুই ধরে ইউটিউবে বিভিন্ন লোকের দেখানো অনেক হোমস্টে দেখেই, এবার চারটি জায়গায় থাকার জন্য বেড়িয়েছিলাম। স্বাভাবিক ভাবেই এটাই আমাদের প্রথম অভিজ্ঞতা। তিনদিন থাকার পর আমাদের অভিজ্ঞতা খারাপ না। 

কাফের হোমস্টেতে আমাদের রুম থেকে সামনের দিকে তাকালে, দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু এবার প্রায় সবদিনই আকাশে কুয়াশা থাকায় কাফের থেকে সামনের দুই সারি সবুজ পাহাড় দেখেছি। আমাদের রুম ছিল তিনতলায়। আমাদের থেকে ঘন্টা দেড়েক পরে আর একটা দলে সাত আট জন গেষ্ট এলেন। ওদের কয়েকজন আমাদের নিচের রুমে উঠলেন। আমরা একটার পর খাওয়ার খোঁজ করতে গিয়ে জানলাম, দুটোর আগে হবে না। এটা একটা সমস্যা। আমাদের একটার আগেই খাবার অভ্যেস। ওদের বলাতে এক কাপ করে লিকার চা পেলাম। তাই নিয়ে বাগানে রঙিন ছাতার নিচে বসে থাকলাম। আগেই বলেছি, ওদের বাগান খুব সুন্দর। ফুলের বাগান ছাড়াও একটু নিচেই ওদের সব্জী বাগানও আছে। এই হোম স্টের নিজের অনেকটাই সব্জী বাগান আছে। আলু পেঁয়াজ কপি মটরসুটি বাগানেই হচ্ছে। এছাড়া ওদের গোয়ালে দুধের গরু ও আছে। কিন্তু বাগান নষ্ট করে দেয় বলে মুরগী নেই। বাগানে বসলে, বা সামনের বারান্দায় বসলে পিছন দিকে বিরাট ঘণ পাইন গাছের জঙ্গল দেখা যায়। পিচের রাস্তা এদের হোমস্টে ছাড়িয়ে আরও দুই তিনশ মিটার নেমে গেছে, পঞ্চায়েত আপিস পর্যন্ত। কিন্তু গাড়ী সারাদিনে দশটাও চলে না। দূরে দূরে পাহাড়ের ঢালে গ্রামের বাড়ি দেখাযায়, কিন্তু মানুষের সাড়া শব্দ আসেনা। ভোরের দিকে মোরগের ডাক, আর মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক আসে। এই হোমস্টের সাত আট টি কুকুর আছে। যারা কুকুর পছন্দ করেন, তাদের ভালো লাগবে। আমরা যখনই যেদিকে হাঁটতে বেড়িয়েছি, গোটা দুই তিন কুকুর আমাদের সাথে সাথে চলেছে। এদের ডাইনিং হলটিও বেশ বড় আর সাজানো। এক সাথে বারো চোদ্দ জন বসে যাওয়া যায়। খাওয়া প্রায় সব হোমস্টেতে একই রকম। দিনে ডাল তরকারী আলু ভাজা পাঁপড় ভাজা আর ডিমের ঝোল। রাত্রে চিকেন, রুটি বা ভাত যে যা খায়। সকালের চা দিতেও বেশ দেরী করে, সব জায়গায়। সকালের টিফিন লুচি, পরোটা বা রুটি চাইলে রুটি। বিকেলে চায়ের সাথে পাকোড়া। শুধু এই একই রকম খাওয়ারের জন্যই একটানা তিন দিনের বেশী থাকা বিরক্তিকর হবে। আর আমাদের মত যারা আলু প্রায় খায় না, তাদের তো আরও মুশকিল। প্রথম দিন বিকেলে আমরা পাইন বনের ভেতরে হাঁটতে চললাম। সাথে চলল তিনটি কুকুর। বনের ভিতরে ট্রাক চলে যাওয়ার মত পাথর বাঁধানো রাস্তা আছে। আমরা প্রায় এক কিমি হেঁটে গেলাম, রাস্তা খুব একটা খাড়া নয়। একটিই ট্রাকে কাঠ কেটে ফিরল দেখেছি। সন্ধ্যার পর সব হোমস্টেতেই সময় কাটানো মুশকিল। এই সময় আইপিএল এর খেলা ছিল বলে মোবাইলে খেলা দেখে সময় কাটিয়েছি। এছাড়া ভোটের সময় বলে মাঝে মাঝে মোবাইলেই খবরও দেখেছি। সকাল বিকাল রাস্তা ধরে দেড় দু কিমি হাঁটা, তাছাড়া আর করার কিছুই নেই। 26 তারিখ ওখানে ভোট ছিল। আগের দিন সকালে মালিক সুনীল তামাং ভোটের ডিউটি করতে চলে গেল। ওর স্ত্রী আর অন্য কর্মচারীরা আমাদের দেখাশোনা করল। ভোটের দিন সকালে চা ফ্লাস্ক এ রেখে , ডাইনিং হলে বিস্কুটের কৌটোর সাথে রেখে সবাই ভোট দিতে চলে গেল। টিফিন পেতে দেরী হবে বুঝলাম। কিন্তু প্রায় অন্য দিনের মতই সময় টিফিন দিয়ে দিল। একটিই মেয়ে আমাদের খাওয়ার দিচ্ছিল। সে বলল, ভোরে উঠে ভোট দিতে গিয়েছিল। আমরা একদিন নিচের দিকে প্রায় এক কিমি হেঁটে কাফের গ্রামের শেষ পর্যন্ত গেলাম। আর একদিন উপরের দিকে হাঁটতে লাগলাম, বৌদ্ধ মন্দির পর্যন্ত যেতে পারি কি না দেখতে। কিন্তু মাইল দেড় দুই হেঁটে বুঝলাম, যেতে পারব না। ফিরে এলাম। 27 এপ্রিল সকালে টিফিন খেয়ে পরের হোম স্টে, সামথারে যাওয়ার জন্য দশটা নাগাদ গাড়ী ডাকা ছিল। গাড়ী ঠিক সময়ে চলে এল। কাফের হোম স্টে থেকে বিদায় নিলাম।

তৃতীয় পর্ব।

কাফের থেকে সামথার বেশী দূর নয়। গাড়ীতে দেড় ঘণ্টাও লাগল না। কাফের থেকে মাইল তিনেক উঠে এসে বৌদ্ধ মন্দির পেলাম। ওটা লেলেগাও এর ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে। মন্দিরের পাশে একটি সুন্দর বাগান আছে। আমরা মন্দিরে না ঢুকে ঐ বাগানের দিকে গিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে ফিরে এলাম। বড় রাস্তা ধরে কয়েক মাইল এগিয়ে আবার পাহাড়ী রাস্তায় ঢুকল গাড়ী। সামথার এর বাজার থেকে ডান দিকে সরু রাস্তায় ঢুকল গাড়ী। এক কিমি মত গিয়ে একটা সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র দেখা গেল। তারপর থেকেই পাথুরে রাস্তা ধরে নেমে চলল গাড়ী। দু কিমি মত নেমে আমিহুদ হোমস্টেতে পৌঁছলাম। বেশ ঝকঝকে তিনতলা বাড়ী। পাশের বড় বাড়িটা থেকে একজন পাহাড়ী লোক বেরিয়ে এসে, আমাদের ব্যাগ দুটি তিন তলায় তুলল। তিন তলার কোনের ঘরটি আমাদের দিল। এখানকার ঘরটি কাফেরের ঘরের প্রায় অর্ধেক। কিন্তু বারান্দায় বেরিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। এখানেও সামনে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ। কুয়াশার জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না।  হোমস্টের কর্মচারী ডোনাল্ড দেখিয়ে দিল, কোনদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর দূরের কোন পাহাড়ে কি কি বেড়ানোর আছে। এখানে নিচের দিকে তাকালে পর পর বাড়ী ঘর দেখা যায়। ডোনাল্ড দেখাল, বাঁ দিকে একটি চার্চ এর প্রেয়ার হল। ওটা ছাড়িয়ে এগোলে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে বলল। এদের খাওয়ার জায়গা বেসমেন্টে। এদের এখানে আবার কাসার থালায় খাওয়া। ডোনাল্ড ছাড়া আর জন দুই কম বয়সী কর্মচারী আছে। বিকেলে চার্চের মাঠ পেরিয়ে ভিউ পয়েন্ট এ গেলাম। সত্যিই দেখার মত। কয়েক হাজার ফুট নিচে গ্রামের বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে; যেন এরোপ্লেন থেকে দেখছি। এখানেও আমরা তিনদিন ছিলাম। কোনদিন নীচের দিকের রাস্তা ধরে হেঁটে মাইল খানেক নামলাম। কোনদিন উপরের দিকে উঠে চললাম। একদিন খুব সকালে উপরের দিকে হাঁটতে লাগলাম, স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত চলে গেলাম। অত সকালে হাসপাতালের কোন কর্মচারীকে দেখলাম না। একজন পাহাড়ী মহিলা বসে ছিলাম। উনি মাকে নিয়ে চিকিৎসা করাতে এসেছেন বললেন। পরে ডোনাল্ড এর কাছে জেনেছি, দুজন ডাক্তার আছেন। হাসপাতালের পরিষেবায় ওরা খুশী। হোমস্টের একটু উপরে একটি ডনবস্কো স্কুল। সোমবার সকাল থেকে নিচের গ্রামের দিক থেকে ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলের দিকে উঠে আসচে দেখলাম। উপরের দিক থেকেও অনেক বাচ্চা গাড়ী করে এল। আমরা বিকেলে স্কুলের মাঠে বাচ্চাদের খেলতে দেখলাম। রবিবার সকাল থেকেই নিচের গ্রামের থেকে লোকজন চার্চের দিকে আসছে দেখা গেল। অনেকে গাড়ী করেও এল। সারাদিন থেকে বিকেলের দিকে একে একে ফিরে গেলেন। চার্চের অনুষ্ঠানের জন্য, ডোনাল্ড আমাদের জন্যওমাটন পেয়ে গেল। একটা জিনিস লক্ষ করে খারাপ লাগছিল, এত ভালো একটা হোম স্টে অথচ গেষ্ট নেই। আমরা তিনদিন ছিলাম, তার মধ্যে একদিন রাত্রে নিচের একটি রুমে গেষ্ট এসেছিল। ডোনাল্ড একটা গাড়ি ঠিক করে দিলে আমরা একদিন ঘন্টা তিন চার ঘুরে এলাম। প্রথমে গেলাম লামাদারা । একটি পাহাড়ের মাথায় কয়েকটি কটেজ। আশপাশের দৃশ্য মনোরম। ওখান থেকে গেলাম চারখোল। পাহাড়ের মাথায় অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ কয়েকটি কটেজ আর হোটেল। কটেজের বাগান দেখে বোঝা যায় একসময় বেশ সাজানো ছিল। ড্রাইভার জানাল বছর ছয়েক আগে মালিক মারা যাওয়ার পর আর দেখার কেউ নেই। মালিকের একমাত্র কন্যা বিদেশে থাকেন, এদিকে আসেন না। সম্ভবত পুরোনো কর্মচারীরা গেষ্ট এলে কটেজ খুলে দেয়। একসময়ের প্রাণ চঞ্চল একটি জায়গা কেমন নির্জীব পড়ে আছে। মনটা ভারী হয়ে গেল। নামার সময় ড্রাইভার দেখাম, উল্টো দিকের পাহাড়ে আমাদের হোমস্টে আর ডনবস্কো স্কুল দেখা যাচ্ছে। ঐ গাড়িকেই বলে দিলাম, পরদিন সকাল দশটায় চলে আসতে, আমরা এখান থেকে যাব দার্জিলিং এর দিকে ঋষিহাটের হোমস্টেতে। অমিহুদ এর এই ডোনাল্ড লোকটি খুব ভদ্র। প্রথমদিন বলেছিলাম , আলু খাই না। ও আমাদের আর আলু দিল না। মাছ আছে কি না জানতে চেয়েছিলাম,; আমাদের প্রায় চার পাঁচ বার মাছ দিয়েছিল। তিনদিন সামথারে থেকে রওনা দিলাম ঋষিহাটের দিকে। পথে আমাদের জন্য একটা চমক অপেক্ষা করছে, জানতাম না।

চতুর্থ পর্ব।

সুন্দর নামের আমাদের ড্রাইভার। আমরা দুজন মাত্র যাত্রি, কিন্তু গাড়ি আট জন বসার মত, টাটা সুমো। সামথার বাজার থেকে ডান দিকে, সাতাশ মাইল এর রাস্তা ধরল। গাড়ির ভাড়া থেকেই বোঝা গেল আজ বেশ দূরে যাচ্ছি। পাহাড়ের ঢালে ঢালে গাড়ী নেমেই চলল। সাতাশ মাইল একেবারে তিস্তা নদীর পাড়ে। এখানে তিস্তা নদী পেরিয়ে আবার পাহাড়ী রাস্তায় উপরে ওঠা। এসব রাস্তায় কোনদিন আসিনি। ড্রাইভার কাকে যেন ফোনে বলল, মংপো হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার স্ত্রী কে বললাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত জায়গাটা মংপু। তাই কোনরকম মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। হঠাৎ দেখি পাহাড়ী রাস্তার পাশে একটি উঁচু তোরণে লেখা, রবীন্দ্র ভবন। হৈ হৈ করে গাড়ী থামাতে বললাম। এমন একটি পুন্যতীর্থের পাশ দিয়ে চলে যাবে, নামবে না, এমন আহাম্মক বাঙালি পাওয়া যাবে না। ডান দিকের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলাম রবীন্দ্র ভবন এর দিকে। একজন মহিলা ডেকে টিকিট নিতে বললেন। পঁচিশ টাকা করে টিকিট। পুরনো বাড়ীটি এখন একটি সংগ্রহশালা , আমরা দু জনই শুধু যাত্রী। নিজেরাই ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বাগানে কয়েকটা ছবি তুলে ফিরে এলাম। আমাদের উচ্ছাসের কারণটা ড্রাইভার বুঝলই না। এই মঙপু কে ড্রাইভার মঙ্গপো বলছিল। এমন আর একটি জায়গা আছে, রংপো। গত অক্টোবরে পুর্ব সিকিম থেকে ফেরার সময় ধ্বসে রাস্তা আটকে  ঋষিখোলা থেকে ফেরার সময়, রংপো ঘুরে ফিরেছিলাম। সে এক উৎকণ্ঠার যাত্রা ছিল। মঙ্গপু থেকে জোড়বাংলো পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ উপভোগ্য হয়েছিল। ঘন পাইন বনের ভেতর দিয়ে মাইল এর পর মাইল রাস্তা। মাঝ মাঝে মেঘ এসে রাস্তা ঢেকে দিচ্ছিল। জোড়বাংলায় এসে দার্জিলিং এর মূল রাস্তায় গাড়ি চলল। এটাই ঘুম। ঘুমে রাস্তায় একেবারে কলকাতার রাস্তার মত গাড়ীর ভিড়। কিছুটা এগিয়েই আমরা বাম দিকে ছোট রাস্তায় ঢুকে গেলাম। পরে জেনেছি, ওটাই মিরিক যাওয়ার রাস্তা। কয়েক কিমি এগিয়ে ডান দিকের রাস্তায় ঢুকল গাড়ী। এখন থেকে রাস্তা বেশ খারাপ। মাঝে মাঝে রাস্তা সারানোর কাজ চলছে। বেশ ঘন বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা। ফেরার সময় ড্রাইভার তার মোবাইলে ছবি দেখিয়েছে, সন্ধ্যার পর ঐ রাস্তায় চিতা বাঘ দেখা যায়। ঋষিহাট ঘুম থেকে অনেকটা নিচে। পিচের রাস্তা Rishihat ছাড়িয়ে চলে গেছে। একটা মোড়ের কাছের থেকে রাস্তা খাড়া উঠে গেছে, হোমস্টের নিচে পর্যন্ত। তারপরও প্রায় পঞ্চাশ গজ হেঁটে উঠতে হয়। ওদের ছেলেরাই লাগেজ তুলে নিয়ে যায়। এদের ও কয়েকটা কটেজ আর একটি তিনতলা বাড়ী। আমরা তিন তলার একটি ঘর পেলাম। এদের বাড়ী আর কটেজগুলি চা বাগানের মধ্যে, উপর নিচ সব দিকেই চা বাগান। এখানেও সামনে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ। একটু বাঁ দিকে তাঁর দেখা পাওয়ার কথা। দেখা যাক, দেখা যায় কি না। 

আগের পর্বগুলো পড়ে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। কেই 25 বছর আগে ললেগাও ঘুরে এসেছেন। কেউ যেতে চান। আমার কাছে যেটা সবথেকে বড় খবর মনে হয়েছে তা হল, আবহাওয়া। কলকাতায় তখন 40-42 চলছে। আমরা ওখানে কম্বল গায়ে ঘুমিয়েছি। সন্ধ্যার পর সোয়েটার আর মাথায় টুপি। চারটি জায়গার মধ্যে ঋষিহাটেই সবথেকে বেশী ঠাণ্ডা পেয়েছি।

পঞ্চম পর্ব

ঋষিহাটে আমাদের দু দিন থাকার কথা। প্রথমদিন বিকেলে ওদের চা বাগানের মধ্যে দিয়ে উপরের দিকে হাঁটতে লাগলাম। নিচে থেকে দেখে বোঝা যায় না, উপরে অনেক বাড়ী ঘর আছে। একটি প্রাইমারী স্কুল আর তার ছোট্ট মাঠও আছে। ঐ মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট খেলছিল। আরও উপরে উঠে একটি মোনাস্ট্রী পেলাম। বড় বাড়ী ঘর থাকলেও কোন মানুষ জন দেখলাম না। উল্টো দিকে বড় গেটের থেকে সোজা রাস্তা নেমে গেছে। ওদিকে কয়েকজন যুবক বসে ছিলেন। একজন এগিয়ে এসে আলাপ করলেন। ওনারা সাত জনের দলে এসেছেন। কোন্নগরের ওদিককার স্কুলের শিক্ষক। ওনারা বিকেল চারটে নাগাদ পৌঁছে খাওয়ার প্রায় কিছুই পাননি বলে অনুযোগ করলেন। সন্ধ্যা হতেই সামনের, বিশেষ করে ডান দিকের পাহাড়গুলি আলোয় ঝলমল করে উঠল। ওদিকটা দার্জিলিং শহর। সন্ধ্যার পর বেশ ঠাণ্ডা, বারান্দায় বসা যাচ্ছিল না। এদের খাওয়ার জায়গা বেশ ছোট। রাতের খাওয়ার আমাদের ঘরেই দিয়ে গেল। পরদিন সকালে আমরা নিচের দিকে হাঁটতে বেরোলাম। হোম স্টের একটি সাদা কুকুর আমাদের সাথে চলল। দেড়শ মিটার মত নেমে যেখানে পিচ রাস্তায় পড়লাম, সেখানের একটি বাড়ী থেকে একটি লাল কুকুরকে ডেকে আনল সাদা কুকুরটি। দুজনে চলল আমাদের সাথে। আমরা প্রায় এক কিমি নেমে আবার উঠে এলাম। এদের এখানে চায়ের সাথে বিস্কুট দেয় না, বলবার পর এনে দিল। ঐ দিন ছিল মে মাসের এক তারিখ। এগারোটা নাগাদ আমার মোবাইলে ব্যাংক থেকে মেসেজ এল, আমার প্রথম পেনশন পেয়েছি। বেশ অবাক করার মত ব্যাপার। মে ডে তে ব্যাংক খোলা থাকবে আশা করিনি। আমার বাবা পঞ্চাশ বছর আগে স্কুলের শিক্ষক হিসাবে অবসর নিয়ে, পেনশনের জন্য নয় বছর দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। আমি একেবারে প্রথম মাসেই পেয়ে গেলাম! দুই তারিখ আমাদের পরিবারের একটি বিশেষ দিন। এবার দিনটা ঋষিহাটে শুরু হল। ভোরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে মনে হল তাঁর দেখা পাওয়া যাচ্ছে। এবার সবদিনই, সব জায়গা থেকে ঘোলা আকাশ দেখেছি, তাই ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। সকাল হতেই দেখলাম, ঠিক, কাঞ্চনজঙ্ঘা। সারা সময় ঐ দিকেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। বারান্দায় বেরিয়ে কয়েকটা ছবি তোলা হল। আজও নিচের দিকে হাঁটতে বেরোলাম, সাথে সেই সাদা কুকুরটি। লাল কুকুরকে আজ আর ডাকতে হল না, নিজেই এসে আমাদের দলে যোগ দিল। আজ আরও প্রায় এক কিমি নিচে নামলাম। একটা মোড়ের মাথায় একটি লোহার বেঞ্চ তৈরী করা হয়েছে, এখান থেকে কাঞ্চন জঙ্ঘা সুন্দর দেখা যাচ্ছে। বসলাম। সাথে সাথে লাল কুকুর এসে পায়ে হেলান দিয়ে বসলো। এ যেন আমার কত দিনের বন্ধু। ওখান থেকে ফেরার রাস্তা ধরলাম। সেই হোমষ্টের মোড়ে এসে দেখি একটি ছোট্ট দোকান খুলেছে। ওদের কাছে একটি বিস্কুট এর প্যাকেট কিনে দুই কুকুরকে খাওয়ানো হল। এদের দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে বসে ছিলাম; হোম স্টে থেকে কম বয়সী দুই স্বামী স্ত্রী নেমে এল। এরা মোনাস্ত্রী কোন দিক দিয়ে ওঠা যায় জানতে চাইলে দু দিক দিয়েই ওঠা যায় জানালাম। আমরা চা খেতে খেতে দেখলাম ওরা পিচের রাস্তা ধরে উপরের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। আমরাও ওদিকে রওনা দিলাম। আমাদের সাথে চলল সাদা কুকুরটি। কয়েকশ গজ এগিয়ে যাওয়ার পর অন্য দুটি কুকুরকে দেখলাম, ওরা সাদা কুকুরকে তেড়ে গেল। একটু এগিয়ে দেখি দুটি বাচ্চা কুকুর রাস্তার পাশে খেলছে। একেবারে নেকড়ের বাচ্চার মত। অনেকটা উঠে, বাঁদিকে মোনাষ্ট্রীতে ওঠার রাস্তা পেলাম। সকালে এদিক থেকে মাইকে মন্ত্র পাঠের শব্দ শুনেছি। এখন আবার সব শুনশান। বড় গেটের পাশে ছোট গেট, তাই দিয়ে আমরা চারজন ঢুকলাম। বেশ বড় চত্বর কিন্তু একজনও লোক নেই। আমরা কয়েকটা ছবি তুলে পিছন দিকের রাস্তা দিয়ে নেমে এলাম। হোমষ্টের ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট করে অফিসে বিল করতে বলে গেলাম। কটেজগুলির পাশে একটি ছোট্ট ঘরই অফিস। ওখানেই ওদের নিজেদের বাগানের চা পাতার প্যাকেট কিনলাম। চায়ের চাষই ওদের আসল কাজ, কয়েক বছর হল হোমস্টে করেছে। এখনকার মালিকের বাবা একজন প্রাক্তন সেনা কর্মী। অন্য সব কর্মচারীর সাথে সমানে কাজ করে যাচ্ছেন। দশটা নাগাদ আমরা ঋষি হাট থেকে টুকভার হোম স্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তখনও কাঞ্চনজঙ্ঘা সুন্দর দেখা যাচ্ছে।

দার্জিলিং পর্ব

এবারও আমাদের দু জনের জন্য বড় গাড়ী। সেই ঘুম থেকে কলকাতার রাস্তার মত গাড়ীর ভিড়। বাতাসিয়া পৌঁছে ড্রাইভারকে বললাম, এখানে দশ মিনিট দাঁড়ানো যায়? সে বলল, এখানে না দাঁড়িয়ে ম্যাল এ চলুন। ঘন্টা খানেক লাগল ম্যালের কাছে পৌঁছতে। মাঝে দুবার পাশ দিয়ে ঝকঝকে টয় ট্রেন যেতে দেখলাম। পরে জেনেছি, এখন আর শিলিগুড়ি পর্যন্ত চলেনা টয় ট্রেন। আমরা সাড়ে এগারোটার পর ম্যালে পৌঁছালাম। তখনও সেখানে অনেক যাত্রী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এবার নতুন যা দেখলাম, ম্যাল রোডে সরকারী ভাবেই হকারদের বসানো হয়েছে। ঝকঝকে রোদ থাকলেও বেশ ঠাণ্ডা বাতাস ছিল। আমরা এক কাপ করে কফি খেয়ে গাড়ীতে ফিরে এলাম। দার্জিলিং ছাড়িয়ে গাড়ী চলল তুকভার এর দিকে। এবার গাড়ী পাহাড়ের ঢালে ক্রমশ নেমেই চলল। মাত্র আট কিমি রাস্তা। টুকভারের মিটমা হোম স্টে একেবারে রাস্তার পাশে। এই রাস্তা দিয়ে দিন রাত অবিরাম গাড়ী চলে। এটাকে ঠিক অফ বিট জায়গা বলা যায় না। এদেরও ঘর বেশ ভালো। খাওয়া দাওয়া খারাপ না। অনেকেই বলেছেন, বিকেলে এখান থেকে একটা গাড়ী নিয়ে দার্জিলিং ঘুরে যায়। আমরা বিকেলে পাহাড়ী রাস্তায় উপরে উঠলাম হেঁটে। আর সঙ্গীও একজন চারপেয়ে চলল আমাদের সাথে। এখানে রাস্তা বেশ খাড়া। উপরে উঠে সুন্দর চা বাগানের মধ্যে পৌঁছলাম। এরা বিকেলে চায়ের সাথে বিস্কুট দেয়, পাকোড়া নয়। এখানে একজন বয়স্ক সহ যাত্রী পেয়েছিলাম, তার সাথে গল্প করে অনেক সময় কাটল। পরদিন সকালে বেরোতে গিয়ে সমস্যা হল। এরা গেটে তালা দিয়ে রাখে। তালা খুলল সাতটা নাগাদ। চা খেয়ে হাঁটতে বেরোলাম, এবার নিচের দিকে। একশ মিটার মত নেমে বাঁ দিকে একটা ফুটবল মাঠ পেলাম। পাহাড়ের উপরে এত বড় মাঠ সহসা দেখা যায় না। মাঠে এক চক্কর দিয়ে ফিরে এলাম। দশটা নাগাদ শিলিগুড়ি ফেরার গাড়ীতে উঠলাম। আমাদের ট্রেন রাত্রে, তাই রাস্তায় কয়েকটা জায়গা ঘুরে নামব বলেছিলাম। হোমস্টে মালিকই বলে দিলেন, মিরিক ঘুরে নামতে। এবার আর দার্জিলিং এ নামলাম না। কিন্তু ঘুম পর্যন্ত আসতেই দেড় ঘণ্টা লাগল। ঘুমের পরে মিরিকের রাস্তা ফাঁকা। ঘুম থেকে দশ বারো কিমি নেমে একটা বাজার মত এলাকা পেলাম। ড্রাইভার বলল, লেপচা জগৎ। ওখানে না নেমে এক কিমি মত এগিয়ে একটি অপূর্ব সুন্দর জায়গায় পৌঁছলাম। একটু আগে থেকেই রাস্তার পাশে সব গাড়ী দাঁড়িয়ে গেছে। ডান দিকে রাস্তার পাশে সুন্দর পাইন গাছের জঙ্গল। এক একটা গাছ বোধহয় একশ ফুটের বেশি লম্বা। কুড়ি টাকা করে টিকিট কেটে পাইন বনের মধ্যে ঢুকলাম। সকলেই ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমরাও ছবি তুলে নেমে এলাম। রাস্তার পাশের দোকানে কফি খেয়ে গাড়ীতে ফিরে এলাম। কিছুটা এগিয়েই গাড়ী বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে উপরে উঠতে থাকল। ড্রাইভার বলল, সকলে এদিকে নিয়ে যায় না, এটাও একটা ভালো দেখার জায়গা। এক কিমি মত পাইন এর বনের ভেতর দিয়ে উঠে একটা ফাঁকা চত্বরে পৌঁছলাম। অনেকটা জায়গা জুড়ে দুটি বড় পুকুরের মত জল, সিমেন্টে বাঁধানো। বড় জলাশয়ে প্রচুর মাছ দেখলাম। এই জায়গার নাম জোড় পোখড়ি। এখানেই কয়েকটা কটেজ আছে দেখলাম। উল্টো দিকে দিয়ে নেমে বড় পিচ রাস্তায় পড়লাম। এবার আধ ঘণ্টা মত চলে বেশ একটা মজার জায়গায় পৌঁছলাম। ড্রাইভার জানাল রাস্তার ডান দিকের বাড়ী সকল নেপালের। আর বাঁ দিকে ভারত। কয়েকশ মিটার এগিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় পৌঁছলাম। ঐ জায়গার নাম সীমানা। অনেক গাড়ী দাঁড়িয়ে গেছে। আমরাও নামলাম। ড্রাইভার দেখল, দূরের বড় পাহাড়টার মাথায় সন্দাকফু। ফাঁকা চত্বরে অনেক দোকানপাট বসে গেছে, মেলার মত। বেশিরভাগই শীতের পোশাক। আমরা কিছু চকলেট কিনে ফিরে এলাম। গাড়ী পাহাড়ী রাস্তা ধরে কয়েক কিমি এগিয়ে আবার একটা বাজার এলাকায় পৌঁছল। ড্রাইভার বলল এখানে নামতে পারেন, নেপালে ঢুকতে হলে আ ই কার্ড লাগবে। দেখার কিছুই নেই জেনে আর নামলাম না। আরও আধ ঘণ্টা মত চলে একটি সুন্দর চা বাগানের মধ্যে পৌঁছালাম। গোপালধারা চা বাগান। অনেক গাড়ী থেমেছে। ড্রাইভার বলল ফটো তোলার জন্য নামতে পারেন। বেশ বেলা হয়েছিল, তাই নামলাম না। আমাদের মিরিক পৌঁছে খাওয়ার কথা। আমাদের তিরিশ বছর আগে দেখা মিরিক চেনা গেল না। এত বেশী গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে যে গাড়ী রাখার জায়গা পাওয়াই মুসকিল। লেকের পাশে একটি হোটেলে মাছ ভাত খেলাম। ভালো না। এরপর ব্রীজ পেরিয়ে অন্য পারে গিয়ে, হেঁটে প্রায় গোটা লেকই ঘুরে নিলাম। ঐ দুপুর রোদেও কেউ কেউ নৌকায় ঘুরছে, কেউ ঘোড়ার পিঠে। এক ঘন্টা ওখানে কাটিয়ে ফেরার রাস্তা ধরলাম। সেই তিরিশ বছর আগে মিরিক যাওয়ার রাস্তায় অনেক চায়ের বাগান দেখেছিলাম যেন। এবারও অনেক দেখলাম, কিন্তু আগের মত সেরকম সবুজ মনে হল না। এবার ক্রমশ নেমেই চলল গাড়ী। দুধিয়ায় একেবারে সমতলে পৌঁছলাম। আগেরবার যেন শিলিগুড়ি থেকে দুধিয়া অনেক কম সময়ে পৌছে ছিলাম। এবার রাস্তাটা অনেক চওড়া দেখলাম। বিকেলে শিলিগুড়ি শহরে ঢুকেও নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছতে প্রায় এক ঘন্টা লাগল। আমাদের গাড়ী রাত আটটা চল্লিশে। সাড়ে ছটা থেকে স্টেশন এ বসে থাকতে হল। এবার যাওয়ার সময়, ট্রেনে মালদা স্টেশন এ আর ফেরার সময় এনজেপিতে অন লাইনে খাওয়ার অর্ডার দিয়েছিলাম। IRCTC থেকে, ক্যাশ অন ডেলিভারী। খাওয়ার মোটামুটি। পদাতিক এক্সপ্রেস নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শিয়ালদা পৌঁছে গেলাম। এবারের ঘোর গ্রীষ্মের গরমের বেশিরভাগ সময় পাহাড়ে কাটিয়ে এলাম। এত লম্বা ছুটি চাকরীতে থাকলে পেতাম না।